বার্লিনালেতে অন্যরকম অভিজ্ঞতা
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮এসে দেখি কয়েকটা প্রোগ্রাম শেষ , বড়ো বড়ো তারকারা সব চলে গেছেন৷ কিন্তু তাতে কি বার্লিনালেতে প্রথমবার আসার মজাটা কি নষ্ট হতে দেয়া যায়!
ফ্লাইট থেকে নেমে বিমান বন্দর থেকেই বার্লিনালের ছোঁয়া, অর্থাৎ এখানে পোস্টার, ওখানে হয়তো ভাল্লুকের লোগো লেখা বার্লিনালে, আর এয়ারপোর্টে এত তরুণ তরুণী বার্লিন বিমানবন্দরে আগে দেখিনি আমি৷ উৎসবে যোগ দিতেই যেন সবার আসা৷
যাই হোক, পটসডামার প্লাৎসে হোটেল ঠিক করা ছিল, কারণ মূল ভেন্যু সেখান থেকে কাছে৷ তাই হোটেলে গিয়ে ব্যাগ রেখে দৌঁড়াতে হলো মূল ভেন্যুর দিকে৷ গ্রান্ড হায়াৎ হোটেলে নিবন্ধন করে প্রেস কার্ড নিয়ে জানলাম কোথায় কি হচ্ছে, আমি কোথায় কোথায় যেতে পারি, কোথায় পারি না৷
এছাড়া বলা হলো যেখানে রেড কার্পেট আছে সেখান থেকে সাংবাদিকদের জন্য কিছু জিনিস আছে, সেগুলো সংগ্রহ করতে৷ বার্লিনালে পালাস্টে রেড কার্পেটসহ বিশেষ অনুষ্ঠানগুলো হয়৷
সেখানে গিয়ে জাঁকজমক দেখে কেমন একটা ঘোর লাগলো৷ টিভিতে কত দেখেছি এই রেড কার্পেট, আর এখন তার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, কেমন যেন একটা অনুভূতি!
ওই ভবনে একটা প্রেস লাউঞ্জ আছে , যেখানে ওয়াইফাই, চার্জার থেকে শুরু করে সব সুবিধা আছে সাংবাদিকদের জন্য৷ দর্শকরা পাগলের মতো এক হল থেকে বেরিয়ে আরেক হলে ঢুকছে, কারো যেন দম ফেলার সময় নেই৷
মূল রেডকার্পেট ছাড়াও কিন্তু ছোটো ছোটো রেডকার্পেট আছে, সিনেমা হলগুলোর পেছনের দরজার কাছে৷ সিনেমা শেষ হওয়ার ৫ মিনিট আগে সেখানে গাড়ি এসে হাজির হয়৷ ভক্তরা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর জন্য তাদের ছবি সম্বলিত কার্ড নিয়ে অপেক্ষা করে অটোগ্রাফের জন্য৷ আর বের হওয়া মাত্রই অটোগ্রাফ আর ফটোগ্রাফ শিকারিরা ঝাঁপিয়ে পড়েন৷
হায়াৎ হোটেলে প্রেস কার্ড নেয়ার সময় আমার সাথে দেখা হয় তথ্যচিত্র নির্মাতা শাহীন দিল রিয়াজ এর সঙ্গে৷ তিনি থাকায় বেশ সুবিধা হলো৷ কোথায় কি আছে, কোন সিনেমাটা ভালো সেগুলো সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল৷ কেননা উৎসবের সব ছবি মোটামুটি দেখানো শেষ, সেখান থেকে বেছে কিছু ছবি আবার দেখানো হচ্ছে৷
বার্লিনের যত সিনেমা হল আছে, প্রায় সবগুলোতেই কিন্তু উৎসবের ছবি দেখানো হচ্ছে৷ ছবিগুলো মূলত ৪টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা৷ প্রধান ভাগ হলো প্রতিযোগিতা, এছাড়া আছে ফোরাম, প্যানারোমা, বার্লিনালে স্পেশাল৷ তবে এর বাইরেও কিছু ছবি দেখানো হয় যেমন বার্লিনালে ক্লাসিকস , জেনারেশন, বার্লিনালে শর্টস, রেট্রোস্পেক্টিভ, হোমএজ, নেটিভ৷
প্রতিযোগিতার ছবিগুলো বেশিরভাগই ভালো৷ তবে ফোরাম এর সিনেমাগুলো বেশিরভাগ মাথার উপর দিয়ে যায়৷ এটা আমার কথা না, বললেন শাহীন দিল রিয়াজ৷
তার মতে, প্রতিযোগিতা আর ফোরাম এর মাঝামাঝি যেগুলো, অর্থাৎ যেসব সিনেমাকে এ দুটোর কোনোটাতে ফেলা যাবে না, সেগুলো থাকে প্যানোরামাতে৷ তবে তার কথার সত্যতা পেলাম, যখন এই তিনটি ক্যাটাগরির মুভি দেখলাম৷
যেমন, ফোরাম এর একটা মুভি দেখে আর কোনোটা দেখার ইচ্ছে হয়নি৷ বিখ্যাত পরিচালক জেমস বেনিং-এর ‘ইলেভেন বাই ফোরটিন'৷ একটা দৃশ্যের কথা বললেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন৷ একটা ছেলে ট্রামে বসে বই পড়ছে, ছেলেটার মুখ দেখা যাচ্ছে না৷ কিন্তু ট্রামটা চলছে, এর যেন শেষ নেই, ১০ থেকে ১৫ মিনিট ধরে চলছে, একসময় হঠাৎ পাশ থেকে নাক ডাকার শব্দ পেয়ে দেখি আমার পাশের তরুণ দর্শক ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ তো এই হলো ফোরামের ছবি৷
প্যানোরামার একটা ছবি দেখেছি, যা আমার কাছে অসাধারণ লেগেছে৷ আর্জেন্টিনার ছবি ‘মেরিলিন'৷ মার্টিন রদ্রিগেজ রেডোনডো এক সমকামী কিশোরের ঘটনা নিয়ে সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন, যা সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত৷
সিনেমার প্রতিটি অভিনেতা অসাধারণ অভিনয় করেছেন৷ সিনেমাটির শেষ দৃশ্যের পর পুরো হলে ছিল পিনপতন নীরবতা, সবার মন এতটাই ছুঁয়ে গেছে৷
প্রতিযোগিতা ক্যাটাগরিতে তিনটি মুভি দেখেছি , একটি জার্মান, একটি পোলিশ এবং আরেকটি ইয়াকুশিয়া ভাষায়৷ জার্মান মুভি ‘ইন দি আইলস' চমৎকার একটি মুভি৷ গল্পটা ভীষণ সুন্দর৷ পোলিশ মুভি ‘মাগ' ভালো লেগেছে সিনেমাটোগ্রাফি আর গল্প দু'টো মিলিয়ে৷ আর সাইবেরিয়ার ইয়াকুশিয়া ভাষার চলচ্চিত্র ‘আগা' আসলে অনেকটা তথ্যচিত্রের মতো৷
বার্লিনালেতে বাংলাদেশের কোনো ছবি নেই, তবে বাংলা ভাষায় আছে৷ কলকাতার নির্মাতা কিউ-এর ছবি ‘গার্বেজ' নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে৷ দেখানো হয়েছে দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ইয়ে দ্য আদার্স'৷
তবে এই উৎসবে এসে যে জিনিসটা সবচেয়ে ভালো লেগেছে, তাহলো কোনো শোতে হল খালি থাকে না৷ সকাল সাড়ে ৯ টায় গিয়েও দেখেছি মানুষের ভিড়৷ এই যে চলচ্চিত্রের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এটা দেখেই তো মানুষ আরো ভালো ভালো সিনেমা বানানোর অনুপ্রেরণা পায়৷