1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বার বার শিশু হত্যা কেন?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩১ আগস্ট ২০১৮

বাংলাদেশে আবারো এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ আগের মতোই তাকে ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ অনেকে দাঁড়িয়ে তা দেখলেও কেউ শিশুটিকে রক্ষায় এগিয়ে আসেনি৷

https://p.dw.com/p/346x7
প্রতীকী ছবিছবি: Fotolia/Firma V

সিলেটে শিশু রাজন হত্যার ঘটনা এখনো দেশের মানুষ ভুলে যায়নি৷ তাকেও চোর অপবাদ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল৷ ওই ঘটনায় আসামিদের আটক এবং শাস্তির আওতায় আনা হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না৷ অপরাধজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর বাংলাদেশে দুই থেকে আড়াইশ' মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ তার মধ্যে একটি অংশ শিশু-কিশোর৷ আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চোর অপবাদ দিয়ে এই পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটানো হয়৷ এর সঙ্গে জড়িত থাকে প্রাভাবশালীরা৷ 

‘‘শিশুটি মারা যায় আটটার দিকে’’

ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ে চুরির অপবাদ দিয়ে  রিয়াদ নামে ১৪ বছর বয়সি এক স্কুলছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বৃহস্পতিবার সকালে৷ উপজেলার উথুরী ঘাগড়া টাওয়ার মোড় বাজার এলাকায় এই ঘটনা ঘটে৷

উথুরা ঘাগড়া টাওয়ার মোড় বাজারের আশরাফুলের মনোহারী দোকানের তালা ভেঙে চুরির চেষ্টার অপবাদ দিয়ে প্রথমে রিয়াদকে আটক করা হয়৷ তারপর বাজারের ব্যবসায়ী আশরাফুল, কামরুল,  রশিদ ও তার সহযোগীরা তাকে গাছের সঙ্গে বেঁধে বেদম মারধর করে৷ ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়৷ এ সময় অনেকে সেখানে থাকলেও কেউ তাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেননি৷ প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তার মৃত্যু নিশ্চিত করেই দুর্বৃত্তরা সেখান থেকে চলে যায়৷

শিশুটির বাবার নাম সাইদুর রহমান৷ তিনি সৌদি প্রবাসী৷ তাঁর দু'টি বোন আছে৷ মা বাকপ্রতিবন্ধী৷ এলাকায় তাঁদের আর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই বলে ডয়চে ভেলেকে জানান গফরগাঁও সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শামসুল আলম খোকন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি সকাল আটটার দিকে খবর পাই৷ খবর পেয়েই গ্রাম পুলিশ পাঠাই৷ কিন্তু সে গিয়ে দেখে রিয়াদ মারা গেছে৷'' 

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সেখানে অনেকে থাকলেও কেউ রক্ষায় এগিয়ে যায়নি৷ আর আমাকেও যদি আরো আগে খবর দেয়া হতো তাহলে আমি গিয়ে হয়তো রক্ষা করতে পারতাম৷ কিন্তু কেন যথাসময়ে খবর দিলো না সেটা আমারও প্রশ্ন৷''

স্থানীয় সাংবাদিক আতাউর রহমান জুয়েল ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘শিশুটি মারা যায় আটটার দিকে৷ ঘটনা শুরু হয় সকাল ৬ টার দিকে৷ প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে গাছের সঙ্গে বেঁধে তাকে নির্মমভাবে পিটানো হয়৷ স্থানীয় কয়েকজন আমাকে জানিয়েছেন, তারা গাছের সঙ্গে বাঁধার পরপরই থানায় খবর দিয়েছেন৷ কিন্ত পুলিশ আসে সকাল ১০টার দিকে৷ শিশুটিকে হত্যার দুই ঘণ্টা পরে৷ কিন্তু গফরগাঁও থানা ঘটনাস্থল থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে৷ ঘটনাস্থল সদর ইউনিয়নে৷ পুলিশ সময়মতো এলে হয়তো শিশুটিকে প্রাণ দিতে হতো না৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘শিশুটিকে পিটিয়ে হত্যার সময় সেখানে আরো ২০-২৫ জন লোক ছিল৷ তারা এগিয়ে গেলে তাদের হুমকি দেয়া হয়৷ যারা শিশুটিকে হত্যা করেছে, তারা এলাকায় প্রভাবশালী৷''

এই ঘটনায় আশরাফুল, কামরুল,  রশিদসহ ৯ জনকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা হয়েছে৷ কিন্তু পুলিশ এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করেনি৷

গফরগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুল আহাদ খান ঘটনার দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘স্থানীয় চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সকাল ৮টার দিকে খবর পাই, এক কিশোরকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে৷ পরে তার লাশ উদ্ধার করি৷ ঘটনাস্থলে যেতে একটু দেরি হয়েছে, কারণ, ফোর্স অন্য ডিউটিতে ছিল৷ তাদের প্রস্তুত  করতে এই দেরি হয়েছে৷ ঘটনার পর হত্যাকারীরা এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে৷ তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে৷''

থানা সূত্র জানায়, চুরির অপবাদ দিয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলেও এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে৷

এদিকে বাংলাদেশে শিশু হত্যার এই প্রবণতা সম্পর্কে মানবাধিকার কর্মী এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দু-একটি ঘটনার বিচার হলেও অধিকাংশ ঘটনায় বিচার হয় না৷ তাই অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে৷ যারা এই সব ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তারা সমাজের প্রভাবশালী৷ ফলে তাদের বিরুদ্ধে কেউ সাক্ষী দিতেও সাহস পায় না৷'' 

‘‘সে গিয়ে দেখে রিয়াদ মারা গেছে’’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই৷ ফলে কেউ সাক্ষী দিলে তাকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়৷ কেউ কোনো অপরাধ প্রতিরোধ করতে গেলে তাকেই অনেক সময় আসামি হতে হয়৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ বা মানবিকতা নেই, তা নয়৷ মানুষ বর্তমান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় তার প্রকাশ ঘটাতে পারে না৷ কারণ, বিচারহীনতায় সে ভীত এবং নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে৷ কোনো ভালো কাজ বা  অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে এখানে বিপদে পড়তে হয়৷''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন এমন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাংলাদেশে প্রতি বছর দুই থেকে আড়াইশ' মানুষকে এভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়৷ এরমধ্যে একটি অংশ শিশু৷'' তাঁর মতে, ‘‘এর দু'টি দিক আছে৷ প্রথমত, মানুষ বিচার না পেয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে৷ আর এই বিচারহীনতার সুযোগ নিয়ে আরেকটি গ্রুপ তাদের স্বার্থে শিশুদের হত্যা করছে, নানা ধরনের অপরাধ করছে৷''

তিনি বলেনন, ‘‘আমাদের সমাজ শিশুবান্ধব নয়৷ যতই বলি না কেন গফরগাঁওয়ে যথন শিশুটিকে হত্যা করা হয়, দীর্ঘ সময় গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটানো হয়, তখন সেখানে আরো অনেকে ছিলেন৷ তারা কোনো-না-কোনোভাবে শিশুটিকে রক্ষায় উদ্যোগ নিতে পারতেন৷  তাদের সে উদ্যোগ না নেয়া আমাদের সমাজের নির্মম নিষ্ঠুরতারই প্রকাশ৷''