বই পার্বনে এত রাজনীতি কেন!
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫হ্যাঁ, সে সময় বইমেলা কলকাতা ময়দান থেকে ঠাঁইনাড়া হয়ে এই বাইপাসের ধারে এসেছিল৷ তবে না, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা ফের তার ঠিকানা বদলাচ্ছে, এমন কোনো সম্ভাবনা এখনও তৈরি হয়নি৷ তবু কথাটা বলা এই কারণেই যে ৩৯তম কলকাতা বইমেলায় যেটা মনে হলো, এতদিনে মিলনমেলা প্রাঙ্গনের সঙ্গে শরীরে, মনে ও মেজাজে ঠিক খাপ খেয়ে গিয়েছে কলকাতা বইমেলা৷ বিরাট মেলা, মাঝে মাঝে বসার জায়গা, গাছ, ফোয়ারা, চা-কফি আর খাবারের দোকান এবং প্রচুর প্রচুর লোক, যাঁরা ঘুরছেন, বই দেখছেন, কিনছেন – মানে বই নিয়ে বাঙালির যে চেনা উৎসাহ, উচ্ছ্বাস, সেটা পুরো মাত্রায়৷
লোকে বলতে পারে হুজুগে বাঙালি৷ সব কিছু নিয়েই বাঙালি হুজুগে মাতে, বইও আর একটা উপলক্ষ্য মাত্র৷ এই নিয়েই এবার মেলার মাঠে কথা হচ্ছিল কবি-গদ্যকার ঋজুরেখ চক্রবর্তীর সঙ্গে৷ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইংরাজি মুখপত্র ওয়েস্ট বেঙ্গলের সম্পাদনার দায়িত্বে আছেন ঋজুরেখ, যুক্ত আছেন অন্যান্য কিছু পত্রিকার সঙ্গেও৷ বইমেলার ১২টা দিন বেলা ১২টা থেকে রাত আটটা তাঁর ঠিকানা তাই এই বইমেলার মাঠ৷
এবার মেলায় ঋজুরেখের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হচ্ছে৷ কিন্তু ছাপাখানাগুলোর ওপর এত চাপ যে নির্ধারিত দিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর বই এখনও স্টলে এসে পৌঁছায়নি৷ সেই নিয়ে চিন্তায় ছিলেন ঋজুরেখ৷ কিন্তু এত বই ছাপা হয় প্রতিবছর বইমেলার সময়, এত প্রকাশন সংস্থা স্টল দেয় মেলায়, নিশ্চয়ই তাদের বিক্রিও ভালো হয়৷ কথাটায় সায় দিলেন ঋজুরেখ৷ প্রতিবছরই চেনা প্রকাশকেরা স্টল দিচ্ছেন, নতুন নতুন বই ছাপছেন৷ নিশ্চয়ই তাঁদের ব্যবসাও ভালো হচ্ছে, নয়ত তাঁরা আসবেন কেন!
বইমেলার লিটল ম্যাগাজিন স্টলগুলোর দিকে নজর দিলেও বাংলা সাহিত্যের এই শ্রীবৃদ্ধি কিছুটা বোঝা যায়৷ যথারীতি একই ছাউনির তলায় সার সার টেবল পেতে ছোট পত্রিকার সংসার৷ শুধু পত্রিকা নয়, এরা অনেকেই এখন বই ছাপছে৷ বাজারচলতি প্রথার বাইরে অন্য ধারার লেখালেখিও লোকে পরখ করে দেখতে যে আগ্রহী, লিটল ম্যাগাজিনের স্টলে মানুষের ভিড় দেখে সে আন্দাজও পাওয়া যাচ্ছে৷
কিন্তু আরও একটা ব্যপার ঘটছে ইদানীং কলকাতা বইমেলায়৷ বইয়ের সঙ্গে অহেতুক গুরুত্ব পেয়ে যাচ্ছে রাজনীতি৷ এবারই যেমন, মেলার মূল প্রবেশপথের ঠিক সামনেই রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্র জাগো বাংলা কাগজের বিশাল প্যাভেলিয়ন তৈরি হয়েছে, যেখানে পাওয়া যাচ্ছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বই৷ রাজ্য তথ্য সংস্কৃতি দপ্তর এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা অকাদেমির যে স্টল, সেখানেও একই প্রদর্শনী৷
এখন রাজনীতির লোক হলে সাহিত্যচর্চা করতে পারবেন না, বিষয়টা আদৌ এমন নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন জাগে, যেভাবে মুখ্যমন্ত্রীর আনাড়ি হাতের আঁকা ছবি, তাঁর স্তাবক শিল্পীকুলের মিথ্যে স্তুতির ফানুসে চড়ে এক সময় কোটি টাকায় বিক্রি হয়ে এখন মানুষের উপহাসের লক্ষ্য হয়েছে, তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্যও সেই একই ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে নেই তো!
কারণ মৌলিক প্রশ্নটা তো একই যে তিনি ভালো শিল্পী বা সুলেখক বলে তাঁর কাজ এভাবে সামনের সারিতে প্রদর্শিত হচ্ছে, নাকি তিনি মুখ্যমন্ত্রী এবং রাজ্যে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেত্রী বলে? এবং তাঁর লেখা যদি সাহিত্য পদবাচ্য না হয়, তা হলে রাজ্যের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর তাঁর লেখা বই শোকেসে সাজিয়ে কার সেবা করছে? বাংলা সাহিত্য?
শোনা যাচ্ছে, বাংলার বিশিষ্ট কবি ও চিন্তাবিদ, সর্বজনশ্রদ্ধেয় শঙ্খ ঘোষ শুধু এই কারণেই এবার কলকাতা বইমেলায় না আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে বইমেলাকেও রাজনৈতিক কারণে আজকাল ব্যবহার করা হচ্ছে৷ বইয়ের প্রতি নয়, উদ্যোক্তাদের আনুগত্য আজ অন্যত্র বাঁধা পড়েছে৷
কিছু অবাঞ্ছিত ঘটনাও এবার ঘটেছে বইমেলায়৷ বাংলাদেশের প্যাভেলিয়নে একটি স্টলে একটি বই পাওয়া যাচ্ছিল, যাতে এক মানচিত্রে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরকে ভারতের অংশ হিসেবে দেখানো ছিল না৷ এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস বাংলাদেশের ওই স্টলটিতে গিয়ে হাঙ্গামা করে৷ উদারমনস্ক এবং মুক্তচিন্তার মানুষজন এত রীতিমত ক্ষিপ্ত হয়েছেন যে এবার থেকে কি বই লিখতেও আরএসএস-এর অনুমোদন লাগবে!
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলিম সংগঠন কলকাতা বইমেলার উদ্যোক্তা বুকসেলার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স গিল্ডের কাছে লিখিত আপত্তি জানিয়ে বইমেলায় তসলিমা নাসরিনের কোনো বই বিক্রি না করার দাবি জানিয়েছে! শোনা গিয়েছে, একই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ভয়ে সদ্যপ্রয়াত বামপন্থি চিন্তাবিদ যশোধরা বাগচির নারী অধিকার বিষয়ক একটি বইয়ের আনুষ্ঠানিক প্রকাশের কর্মসূচি বাতিল করেছে গিল্ড৷
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, বাংলা সাহিত্যে এ কাদের তাণ্ডব শুরু হয়েছে!