1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের নড়বড়ে ক্রিকেটে যুক্তরাষ্ট্রের ধাক্কা

২২ মে ২০২৪

হারমিত সিং যখন মাহমুদউল্লাহর বল সীমানা ছাড়া করে উল্লাসে ফেটে পড়লেন টেক্সাসের প্রেইরি ভিউ ক্রিকেট কমপ্লেক্সে তখন খুব বেশি দর্শক নেই।

https://p.dw.com/p/4g9Qd
ক্রিকেটের ব্যাট এবং বল
ব্যাটিং বাংলাদেশ দলের জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা হয়ে দেখা দিয়েছেছবি: Getty Images

সাড়ে আট হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের  এই জয় বাংলাদেশের জন্য নিঃসন্দেহে বড় এক ধাক্কা৷ নাজমুল হোসেন শান্তদের সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্নটা আরও বড় করে দিলো এই হার৷

হিউস্টনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মঙ্গলবার রাতে ৫ উইকেটের হারটা আসলে বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেতই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ দলের প্রস্তুতিতেও তা বড়সড় একটা হোঁচট। বিশ্বকাপ শুরুর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম ম্যাচটা হতে পারতো বাংলাদেশ দলের জন্য, বিশেষ করে রানখরায় ভুগতে থাকা ব্যাটারদের জন্য আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়ার উপলক্ষ। কিন্তু কোনো ব্যাটার বা বোলারই নিজের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলেন না। ৩ বল বাকি থাকতেই তাই যুক্তরাষ্ট্র পেয়ে গেল এক ঐতিহাসিক জয়।

টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনা করলে এই হারটা যে অনেক বড় বিস্ময়, সেটাও বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ দল এর আগে ২০ ওভারের ফর্ম্যাটে আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, স্কটল্যান্ড, এমনকি হংকংয়ের কাছেও হেরেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত মনে রাখার মতো তেমন কিছুই করতে পারেনি বাংলাদেশ, সর্বশেষ আসরেও শুধু জিম্বাবুয়ে আর নেদারল্যান্ডসকে হারিয়েছিল বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে। তবে র‍্যাংকিংয়ের ১৯ নম্বরে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের এই দলের কাছে এমন আত্মসমর্পণ বলে দেয় এবারের বিশ্বকাপে হয়তো আগের বারের চেয়েও খারাপ কোনো অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে। অথচ এই যুক্তরাষ্ট্র দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটারই অভিবাসী, এক কোরি অ্যান্ডারসন ছাড়া বড় মঞ্চে খেলার অভিজ্ঞতাও খুব বেশি ক্রিকেটারের নেই। এমনকি হিউস্টনের মাঠের কন্ডিশনও বাংলাদেশের খুব অচেনা ছিল না। মন্থর আউটফিল্ড, উইকেটে বল ধরে আসছে- এমন পিচে খেলতে কম-বেশি অভ্যস্তই বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা। কিন্তু মাঠে সেই অভ্যস্ততার কোনো চিহ্নও খুঁজে পাওয়া গেল না।

বাংলাদেশ দলের জন্য সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার জায়গা এখন অবশ্যই ব্যাটিং। দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ে সিরিজে রানের দেখা পাননি লিটন দাস আর অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের অনভিজ্ঞ বোলিংয়ের বিপক্ষেও তাদের খুঁজে পাওয়া গেল না।ওপেনার লিটন দাস দুইবার জীবন পেয়েও ১৫ বলে ১৪ রানের দৃষ্টিকটু এক ইনিংস খেলেছেন। আর নাজমুল নিজে আউট হয়েছেন ১১ বলে ৩ রান করে। বলে বলে রান নিতেই জেরবার বাংলাদেশের টপ অর্ডার, আর  টি-টোয়েন্টির মারকাটারি ব্যাটিং তো বাংলাদেশ দলের জন্য অনেক দূরের গল্প। কালকের ম্যাচের পর অধিনায়ক নাজমুলের স্ট্রাইক রেট ১০৯-এর কাছাকাছি। এই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সব অধিনায়কের মধ্যে একমাত্র উগান্ডার অধিনায়ক ব্রায়ান মাসাবার স্ট্রাইক রেটই তার চেয়ে কম। আয়ারল্যান্ড অধিনায়ক পল স্টার্লিং বা যুক্তরাষ্ট্রের মোনাংক প্যাটেলের স্ট্রাইক রেটও ১৩০-এর ওপর। জিম্বাবুয়ে সিরিজের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থ নাজমুলের সামনে তাই নিজের ফর্ম খুঁজে পাওয়ার পাশাপাশি দলকে উদ্দীপ্ত করার ডাবল চ্যালেঞ্জ।

পরের চ্যালেঞ্জের সময়ও এখন নাজমুলের পায়ের নিচের মাটি বেশ নড়বড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাচের পর যদিও বলেছেন, ব্যাটারদের তাড়নার অভাব ছিল না, মূল সমস্যা ছিল মানসিকতার। কিন্তু বিশ্বকাপের আগে এমন চাপহীন ম্যাচে কেন মানসিকতার সমস্যা থাকবে, তার উত্তরও নাজমুলদের খুঁজে বের করা জরুরি। ব্যাটিং মূল সমস্যা হলেও বোলিং আর ফিল্ডিং নিয়েও উঠবে প্রশ্ন। কাল সাকিব আল হাসানের ওভার বাকি থাকলেও শেষ ওভারে মাহমুদউল্লাহকে আনলেন নাজমুল, স্পষ্টতই ক্রিজে দুজন বাঁ-হাতি থাকায় একজন বাঁ-হাতি বোলারকে তিনি আনেননি। কিন্তু এই যুগে এমন মান্ধাতা আমলের টি-টোয়েন্টি কৌশল বাংলাদেশ ছাড়া আর কয়টা দেশের আছে, সেটাও প্রশ্ন। দলের মূল বোলারদের একজনকে বাদ দিয়ে কেন একজন পার্ট টাইমারকে শেষ ওভার দেওয়া হলো সেই প্রশ্নও আসবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের শরীরী ভাষাতেই যে আত্মসমর্পণের সুর ছিল, সেটা চোখ এড়ায়নি ইএসপিএনক্রিকইনফোর বাংল্কাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসামের, ‘‘এই ম্যাচে দুই দলের মধ্যে বিশাল একটা ব্যবধান ছিল। আমি খুবই হতাশ বাংলাদেশ দলের শরীরী ভাষা, পরিকল্পনা ও কৌশলে। ছোটখাটো ব্যাপারসহ অনেক কিছু দেখেই মনে হয়েছে তাদের মাঠেই থাকার ইচ্ছা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু প্রথম থেকেই ম্যাচে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। ফলটাও তাই একদমই বিস্ময়কর মনে হয়নি।'' তিনি বরং প্রশ্ন তুললেন বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের নিবেদনের অভাব নিয়ে, ‘‘বাংলাদেশ দলকে দেখে মনে হয়নি তারা আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলছে। ২০০৩ বিশ্বকাপের আগে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাদেশিক দল  কোয়াজুলু নাটালের কাছে হেরেছিল। কিন্তু আপনি যখন একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলবেন, সেটা যার সাথেই হোক, সেই মর্যাদা দিয়ে খেলতে হবে। আমার মনে হয়, এই দলে দেশের হয়ে খেলাটা যে গর্বের ব্যাপার, সেই বোধের অভাব আছে।''

ক্রিকেট কোচ ও ক্রিকেট বিশ্লেষক নাজমূল আবেদীন ফাহিম এই দলের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাবই দেখছেন সবার আগে, ‘‘টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে আত্মবিশ্বাস। এখানে পিছনে ফিরে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই। জিম্বাবুয়ের সাথে আমাদের সর্বশেষ সিরিজ দেখুন, সেখানেও আমরা খুব সাহসী ছিলাম না। জিম্বাবুয়ের সাথে আমরা টসে জিতেও ব্যাটিং করলাম না। আমাদের সেই সাহস নেই আগে ব্যাটিং করে বড় স্কোর করবো। এভাবে হয়তো সিরিজটা জিতেছি, কিন্তু যে আত্মবিশ্বাস আমরা নিয়ে গেছি সেটাকে আমি বলবো ‘ফেক কনফিডেন্স' ।  যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামর্থ্যের তুলনা করলে ওদের চেয়ে আমরা দ্বিগুণ এগিয়ে। কিন্তু পিছিয়ে গেছি আত্মবিশ্বাসে। এবং বিশ্বকাপের আগে এটা ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সত্যি বলতে এখন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কেউ বড় কথা নয়, আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ।‘'

কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, এই আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগতে থাকা ক্রিকেটারদের নিয়েই বাংলাদেশ দলকে পরিকল্পনা সাজাতে হবে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচক গাজী আশরাফ হোসেন লিপু একরকম অসহায়ত্ব নিয়েই বলেছিলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় দল ঘোষণার জন্য খুব বেশি অপশন তাদের হাতে থাকে না। ২০-২৫ জনের মধ্যে থেকেই তাদের বাছাই করতে হয়। তাই কালকের একাদশের বাইরে থাকা বা এই স্কোয়াডের বাইরে থাকা কেউ যে কাল বড় কিছু করে ফেলতেন, সেটাও জোর গলায় বলার উপায় নেই। কিন্তু ক্রিকেট দুনিয়ায় এত সময় পার করার পর যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে এই ১১ জনও কেন জিততে পারবেন না , এই বাস্তবতাও বোঝা জরুরি

বিশ্বকাপের যখন মাত্র কয়েক দিন বাকি, এমন সময়ে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ও প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিয়ান আমিনুল ইসলাম বুলবুল সমস্যা দেখছেন মানসিকতায়, ‘‘এখন আমাদের কাজ করতে হবে মানসিকতা আর ট্যাকটিকস নিয়ে। এখন  আমাদের শান্ত বা লিটনের ব্যাটিং গ্রিপ নিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই। আমার কাছে মনে হচ্ছে দলের মানসিকতার জায়গাটা বেশ দুর্বল। যে ছেলেটা অংকে শুন্য পায়, সেও কিন্তু পরীক্ষায় পাশ করার পড়ে। এখন আমরা সেই পরীক্ষার মধ্যে ঢুকে গেছি। আমাদের কাজ হবে এখন দলের মানসিকতা ঠিক করার জন্য ওদের পাশে থাকা। আর টিম ম্যানেজমেন্টকে ভাবতে হবে যে ভেন্যুগুলোতে খেলা হবে সেখানকার উইকেট, কন্ডিশন, প্রতিপক্ষ বিবেচনা করে কৌশল সাজানো।''

তবে সব মিলে এই অবস্থায় বাংলাদেশ দলের সামনে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে, সেটাই মনে করেন ইএসপিএনক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম, ‘‘এই সিরিজ হয়তো বাংলাদেশ দল জিতে যেতে পারে। কিন্তু এই ম্যাচের ধকল থেকে বের হওয়া কঠিন হবে। বাংলাদেশ দল শ্রীলংকা  আর দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে বিশ্বকাপের প্রথম দুই ম্যাচ খেলবে, তার আগে এই ধাক্কা ভুলতে কষ্ট হবে। এর আগে হংকং, আয়ারল্যান্ডের মতো দলের কাছে হারের পর সেটা কাটিয়ে উঠতেও বাংলাদেশের সময় লেগেছিল। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশ দল ছোট দলের কাছে হারের পর সেটা চট করে কাটিয়ে উঠতে পারে না।''

বিশ্বকাপ শুরুর আগে তাই বাংলাদেশের জন্য অপেক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্রের দুর্গম গিরি আর ওয়েস্ট ইন্ডিজের দুস্তর পারাবার পাড়ির চ্যালেঞ্জ।