বাংলাদেশের এক গ্রামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মসজিদ
ময়মনসিংহের এক গ্রামে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য আলাদা একটি মসজিদ চালু হয়েছে, যা তারা নিজেরাই গড়েছেন৷ মসজিদটি হিজড়াদের সম্পর্কে স্থানীয়দের কুসংস্কার দূর করায় ভূমিকা রাখছে৷
স্ব-উদ্যোগে ‘নিজেদের’ মসজিদ
বাংলাদেশের ময়মনসিংহের দক্ষিণ চর কালীবাড়িতে সবুজ মাঠের মাঝখানে টিনের একতলা একটি কাঠামো৷ খুব সাদামাটা এ মসজিদ সবার কাছে আলাদাভাবে পরিচিত৷ কারণ, এটি হিজড়াদের উদ্যোগে তৈরি৷ সমাজের অন্যদের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায়ের সুযোগ পেতেন না বলে এ মসজিদ তৈরি করেছেন তারা৷
যেভাবে গড়ে উঠেছে
ময়মনসিংহের দক্ষিণ চর কালীবাড়ি সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর পেয়েছেন ৪০জন হিজড়া৷ সেখানে নিজেদের গোরস্থান থাকলেও ছিল না মসজিদ৷ আবেদনের পর প্রশাসনের দেয়া জমিতে নিজেদের অর্থ ও শ্রমে তারা এই মসজিদ গড়ে তোলেন৷
বঞ্চনা
স্থানীয় গোরস্থানে নিজেদের একজনকে কবর দিতে গিয়ে গত বছর বাধার মুখোমুখি হয়েছিলেন এখানকার হিজড়া বাসিন্দারা৷ পরে নিজেদের জন্য আলাদা গোরস্থানের ব্যবস্থা করেন তারা৷ বাসিন্দারা জানান, স্থানীয় মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেও তারা বাধার মুখোমুখি হন৷ এমন পরিস্থিতিতেই আলাদা মসজিদ করার চিন্তা আসে তাদের৷
‘আমাদের মসজিদ’
সোনিয়া নামের একজন বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘‘ মানুষ আমাদরকে বলতো, তোমরা হিজড়ারা কেন মসজিদে আসো? তোমরা ঘরে নামাজ পড়বে, মসজিদে না৷...এটা আমাদের জন্য লজ্জার ছিল৷ তাই আমরা আর যাইনি৷ এটা আমাদের মসজিদ, এখন কেউ কিছু বলতে পারবে না৷’’ তবে তাদের মসজিদে অন্যদের নামাজ পড়ায় বাধা নেই৷
‘কেউ বাধা দেবে না’
৪২ বছরের সোনিয়া শৈশবে পবিত্র কোরআন বিষয়ে শিক্ষা নিলেও হিজড়া হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পর থেকে আর মসজিদে প্রবেশের সুযোগ পাননি৷ তিনি বলেন, ‘‘জীবনে আর কখনো মসজিদে ঢুকতে পারবো ভাবিনি৷’’ হিজড়াদের দলনেতা জয়িতা তনু বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘‘এখন থেকে একজন হিজড়াকে (মসজিদে) নামাজ পড়তে কেউ বাধা দিতে পারবে না৷...কেউ আমাদের নিয়ে উপহাস করতে পারবে না৷’’
প্রথম এমন উদ্যোগ
এ ধরনের মসজিদ বাংলাদেশে প্রথম বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে হিজড়াদের মধ্যে ইসলাম ধর্মের শিক্ষা প্রচারে কাজ করা মুফতি আব্দুর রহমান আজাদ৷ ফেব্রুয়ারিতে আরেক শহরে এমন মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হলে স্থানীয়দের বিরোধিতায় তা বন্ধ হয়ে যায় বলে জানান তিনি৷
‘তাদেরও অধিকার আছে’
মসজিদের ইমাম ৬৫ বছরের আব্দুল মোতালেব৷ তিনি বলেন, ‘‘হিজড়ারা অন্য মানুষদের মতোই আল্লাহর সৃষ্টি৷ আমরা সবাই মানুষ, কেউ হয়ত নারী, কেউ হয়ত পুরুষ৷ আল্লাহ পবিত্র কোরান সবার জন্য উন্মুক্ত করেছেন৷ তাই প্রত্যেকের প্রার্থনার অধিকার আছে, যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না৷’’
এক কাতারে অন্যরাও
হিজড়াদের সঙ্গে এক কাতারে নামাজ পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও৷ ৫৩ বছর বয়সি তোফাজ্জল হোসেন দ্বিতীয়বারের মতো জুমার নামাজ পড়তে এসে বলেন, ‘‘তারা যখন আমাদের সঙ্গে বাস করতে শুরু করলো, অনেকেই অনেক কথা বলতো৷ কিন্তু পরে বুঝলাম এসব কথা ঠিক না৷ অন্য মুসলিমদের মতোই তারা যথাযথভাবে জীবন যাপন করে৷’’ স্থানীয় শত শত মানুষে তাদের সাথে নামাজ পড়বেন এমন স্বপ্ন দেখেন তনু৷ তার জন্য মসজিদটিকে আরো বড় করতে চান তারা৷
আইনি স্বীকৃতি
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠী প্রথমবারের মতো বেশ কিছু আইনি অধিকার পেয়েছে৷ ২০১৩ সালে সরকার তাদেরকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনীতির ময়দানেও প্রবেশ করেছেন তারা৷ জয়ী হয়েছেন স্থানীয় নির্বাচনে৷ তবে হিজড়ারা এখনও সমাজে মৌলিক স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন৷ সম্পত্তি ও বিয়ের ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি অধিকার নেই তাদের৷ কর্মক্ষেত্রেও বৈষম্যের শিকার তারা৷