বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জীবনে ধীর উন্নয়ন
১৯ মার্চ ২০২২প্রতিবন্ধীদের জীবনসংগ্রাম অনেক বেশি কঠিন৷
বাংলাদেশে ০৮-১০ শতাংশ মানুষ নানা রকমের প্রতিবন্ধিতার শিকার। এত মানুষকে মূলধারায় আনতে আইকনিক চরিত্র তৈরির উদ্দেশ্যে কয়েক বছর ধরে নানা উদ্যোগে দেশে শারিরীক প্রতিবন্ধীদের ক্রিকেট চালু করা হয়। সেখানকার এক ক্রিকেটার বলছেন, এই আইকনিক চরিত্রদের অবস্থাই বাংলাদেশে এখনো বেশ খারাপ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের অবস্থা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ আফগানিস্তানেরও পেছনে।
ক্রিকেটার মনির হোসেন মনে করেন, ক্রিকেটের এই খারাপ অবস্থা দেখে প্রতীকীভাবে সমাজে প্রতিবন্ধীদের অবস্থাও অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, ‘‘কোভিডের আগে দেখেছি, আফগানিস্তান-পাকিস্তানেও প্রতিবন্ধী ক্রিকেটাররা তাদের বোর্ড বা কর্তৃপক্ষ থেকে নিয়মিত বেতন পান। তাই পেশাদারভাবেই তারা খেলে। কিন্তু আমাদের এখানে একবার আমরা খেলতে যাই, এরপর অনেকদিন আমাদের খবর কেউ নেয় না। যে খেলাগুলো হয়, সেগুলোও ক্রিকেট বোর্ডের উদ্যোগে নয়। বরং নানা সংগঠন এগুলো পরিচালনা করে।''
তার মতে, ‘‘বিষয়টা এমন নয় যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সামর্থ নেই। আমরাতো শুনেছি, তাদের ৯০০ কোটি টাকা জমা আছে। এটা অন্য অনেক দেশের বোর্ডের চেয়ে বেশি। এখানে সমস্যা হচ্ছে মানসিকতা।''
"আমরা অনেকেই ক্রিকেট খেলতে এসে অন্য কিছুর চেষ্টা করতে পারিনি। এখন ক্রিকেটের উপরও আমরা নির্ভর করতে পারছি না। এরকম একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে বিসিবির মানসিকতার কারণে। চাইলে বিসিবি শারীরিক প্রতিবন্ধী ক্রিকেট, হুইল চেয়ার ক্রিকেট, অন্ধদের ক্রিকেট- সবার দায়িত্ব নিতে পারে।”
মনির বলেন, ‘‘প্রতিবন্ধীদের অবস্থার পরিবর্তন করতে এ রকম সব জায়গাতেই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।''
প্রতিবন্ধীদের প্রতি বোর্ডের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রতীকীভাবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও প্রতিফলিত হয়, সেটা বোঝাতে গিয়ে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারীদের বাসের অ্যাকসেসিবিলিটির কথা তুলে ধরেন মনির। তিনি বলেন, ‘‘ক্রিকেট খেলতে গিয়ে ইংল্যান্ডে একটা বাসে দেখলাম, ড্রাইভার সুইচ টিপে দিলেন আর একটি দরজা খুলে রোবটিকভাবে একজন হুইল চেয়ার ব্যবহারকারী তার হুইল চেয়ারে বসেই বাসে উঠে গেলেন। কোনো কষ্ট হলো না। ঢাকায় তো আমি এ রকম একটা বাসও দেখিনি।''
প্রতিবন্ধীর যত অধিকার, প্রতিবন্ধিতার যত রকম
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতে বাংলাদেশে ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন পাস হয়। এই আইনে প্রতিবন্ধিতার ১০টি নির্দিষ্ট ধরনের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, অটিজম বা অটিজমস্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারস, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, মানসিক অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, বাকপ্রতিবন্ধিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, শ্রবণ-দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রোম। এর বাইরে বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য প্রতিবন্ধিতার কথাও একইসঙ্গে বলা হয়েছে।
এই আইনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ২০টি অধিকারের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে, পূর্ণমাত্রায় বেঁচে থাকা ও বিকশিত হওয়া; সর্বক্ষেত্রে সমান আইনি স্বীকৃতি এবং বিচারগম্যতা; উত্তরাধিকারপ্রাপ্তি; স্বাধীন অভিব্যক্তি ও মত প্রকাশ এবং তথ্যপ্রাপ্তি; মাতা-পিতা, বৈধ বা আইনগত অভিভাবক, সন্তান বা পরিবারের সহিত সমাজে বসবাস, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও পরিবার গঠন; প্রবেশগম্যতা; সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে, প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী, পূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ; শিক্ষার সকল স্তরে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা প্রাপ্তি সাপেক্ষে, একীভূত বা সমন্বিত শিক্ষায় অংশগ্রহণ; সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মে নিযুক্তি; কর্মজীবনে প্রতিবন্ধিতার শিকার ব্যক্তি কর্মে নিয়োজিত থাকবার, অন্যথায়, যথাযথ পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণপ্রাপ্তি; নিপীড়ন থেকে সুরক্ষা এবং নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশের সুবিধাপ্রাপ্তি; প্রাপ্যতা সাপেক্ষে, সর্বাধিক মানের স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি; শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রসহ প্রযোজ্য সকল ক্ষেত্রে ‘প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তি; শারীরিক, মানসিক ও কারিগরী সক্ষমতা অর্জন করে সমাজজীবনের সকল ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে একীভূত হওয়ার লক্ষ্যে সহায়কসেবা ও পুনর্বাসন সুবিধাপ্রাপ্তি; মাতা-পিতা বা পরিবারের উপর নির্ভরশীল প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মাতা-পিতা বা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বা তার আবাসন ও ভরণ-পোষণের যথাযথ সংস্থান না হলে, যথাসম্ভব, নিরাপদ আবাসন ও পুনর্বাসন; সংস্কৃতি, বিনোদন, পর্যটন, অবকাশ ও ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ; শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী, যথাসম্ভব, বাংলা ইশারা ভাষাকে প্রথম ভাষা হিসাবে গ্রহণ; ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা; স্ব-সহায়ক সংগঠন ও কল্যাণমূলক সংঘ বা সমিতি গঠন ও পরিচালনা; জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তি, ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, ভোট প্রদান এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণ।
প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, অ্যাডভোকেসি নিয়ে কাজ করছে সিআরপি (সেন্টার ফর দ্য রিহ্যাবিলিটেশন অব দ্য প্যারালাইজড)। এর নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ সোহরাব হোসেনের মতে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতে ৫টি ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে। শিক্ষা, অ্যাকসেসিবিলিটি, চিকিৎসা, পুনর্বাসন এবং কর্মসংস্থানে।
"উন্নত বিশ্বে কোনো মানুষকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে না। তাদেরকে যেন আলাদা করে না দেই, তাকে যেন সুযোগ করে দেই।”
"একজন প্রতিবন্ধী মানুষের অ্যাকসেসিবিলিটি থাকতে হবে। অনেক দেশে ট্রেন বা বাস স্টেশনে একজন প্রতিবন্ধী মানুষ বা একজন বৃদ্ধ মানুষ কারো সাহায্য ছাড়াই চলতে পারে। তিনি নিজেই হুইল চেয়ার নিয়ে যেতে পারেন, কারণ, সেখানে সেই ব্যবস্থা করা আছে।”
"বাসে উঠার জন্য আলাদাভাবে র্যাম্প বা সিঁড়ির ব্যবস্থা আছে। বাস থামলে র্যাম্প নেমে যায়, সে উঠে যায়। রাস্তা পারাপারের জন্য ব্যবস্থা থাকতে হবে। যারা কানে শুনে না, তাদের জন্য ব্যবস্থা থাকতে হবে।”
"উন্নত বিশ্বের সাথে তুলনা করলে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে আছি। তবে আমি এটা লক্ষ্য করেছি, গত ১০ বছরে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে অনেক সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে এটাকে আরো পরিবর্তন করতে হবে।”
"তাদের শিক্ষা, অ্যাকসেসিবিলিটি, চিকিৎসা, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থানে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। এগুলো ঠিক হলে উন্নত বিশ্বের মতো এদেরকে সুযোগ দিতে পারবো। এটা বলা হয়, ‘তারা প্রতিবন্ধী না। আমাদের দৃষ্টিটা প্রতিবন্ধী'।”
শিক্ষা অর্জনই বড় চ্যালেঞ্জ
লালমনিরহাটের কৃষক আব্দুর রশিদ ২০১০ সালে তার খালাতো ভাইয়ের মেয়েকে ভর্তি করাতে স্কুলে যান। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ শিশুটিকে ভর্তি নিতে রাজি হয়নি। কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই একটি প্রতিবন্ধী স্কুল খুলে বসেন। বর্তমানে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত এই স্কুলে পড়ালেখা হয়।
সেই স্কুলে এখন ২১০জন শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদের পড়াশোনা ও দেখাশোনার জন্য ৩০জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। স্কুলের দুটি গাড়ি রয়েছে, যেগুলো দিয়ে ৪-৫ কিলোমিটার দূর থেকেও বাচ্চাদের নিয়ে আসা হয়, আবার বাড়ি পৌঁছে দেয়া হয়।
এই স্কুলের বয়স পেরিয়ে গেছে ১১বছর। সরকারের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত ১৩০ওয়াটের সোলার প্যানেল ছাড়া আর কিছু পাননি বলে জানান প্রতিষ্ঠাতা কৃষক আব্দুর রশিদ। এমপিওভুক্ত না হওয়ায় শিক্ষক-কর্মচারীরা কাজ করছেন বিনা বেতনে।
আব্দুর রশিদ জানান, তার স্কুলে প্রাথমিকের পড়াশোনার পাশাপাশি নাচ-গানসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়। এখানে পড়াশোনা শেষ হলে বাচ্চাদের মাধ্যমিক স্তরে অন্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়।
স্কুলের এমপিওভুক্তি না হওয়ায় নানা সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর কাছেও গিয়েছি। তিনি আশ্বাসও দিয়েছিলেন। এরপরও এখনো হয়নি।''
প্রায় দুই দশক আগে নিজের প্রতিবন্ধী সন্তানকে ভর্তি করাতে গিয়ে সাজিদা রহমান ড্যানিকে ঘুরতে হয়েছে ৩৩টি স্কুলে। এ ঘটনা খোদ রাজধানীর উত্তরা-গুলশান-ধানমণ্ডি-মিরপুর এলাকায়। এরপর একটি স্কুলে দিতে পারলেও একটা সময় তিনি জানতে পারেন, শিক্ষকরা তার সন্তানের প্রতি যেভাবে খেয়াল রাখার কথা, সেটা রাখছেন না। বরং তাকে কেবল বসিয়ে রাখা হয়।
অন্য একটি স্কুলের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান, তার সন্তান কম্পিউটার শিক্ষায় ভালো ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি খবর পান যে, সেই বিষয়েই সে ফেইল করেছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানতে পারেন, তার সন্তানকে ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় এবং তিন মাস ধরে এ আচরণ করছেন স্কুলের কম্পিউটার শিক্ষক।
‘‘কেন শিক্ষক তাকে ক্লাসে গ্রহণ করে না? কারণ শিক্ষকের ধারণা, সে এই ক্লাসে পারবে না'', বলছিলেন সাজিদা।
এটি এমন এক স্কুলের ঘটনা যেখানে সাজিদা নিজের টাকায় সন্তানের জন্য ‘শ্যাডো-শিক্ষক' নিয়োগ দিয়েছিলেন। বছরে দুইবার তিনি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দিতেন। স্কুলে ফান্ড দিতেন।
সাজিদা বলেন, ‘‘তখন আমি প্রিন্সিপালকে বললাম, শিক্ষক এভাবে অ্যাবিউজ করবে, সেটা তো হওয়ার কথা না।''
ধীরে ধীরে সাজিদা জানতে পারেন, কেবল ওই শিক্ষক নয় আরো অনেক শিক্ষকই তার সন্তানকে অ্যাবিউজ করে।
তিনি বলেন, ‘‘একটা সময় প্রিন্সিপাল তাকে বের করে দিলেন, বললেন, ওকে অন্য জায়গায় নিয়ে যান, ওকে এখানে রাখবো না।''
এখন কি সেই অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়েছে? সাজিদা বলেন, ‘‘মানুষের জানাটা বেড়েছে। কিন্তু তাদের গ্রহণ করাটা কতটা বেড়েছে আমি জানি না। তারপর এক্সিকিউশনের কথা বলেন, অনেক দেরি আছে। স্পেশাল নিডস স্কুলগুলোর দিকে যদি দেখেন, স্কুলগুলোতে বাচ্চারা অ্যাবিউজড হচ্ছে। কারো কোনো অ্যাকাউন্টিবিলিটি নেই। স্কুলগুলোর কোনো স্ট্যান্ডার্ড আমরা এখনো সেট করতে পারিনি। মিনিমাল স্ট্যান্ডার্ড। স্কুলগুলোর বেসিক কারিকুলামে কারা পড়াবে, কী কী টপিক পড়াবে, কোন কোন ইস্যু এখানে থাকবে...।''
তিনি বলেন, ‘‘সেদিনও আমি বলছিলাম, সেই ২০১৩-তে আমরা আইন পাস করেছি। আজকে ২০২২। এখন পর্যন্ত আমরা শিক্ষক-কেয়ার গিভার ও ইনস্টিটিউশনের বেসিক কোয়ালিফিকেশন ঠিক করতে পারিনি। এ লজ্জার জন্য আমি নিজেও একটা অংশীদার।''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘মূল ধারার স্কুল তো আরো অনেক দূরে।''
২০১৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন হৃদয় সরকার। শারীরিক প্রতিবন্ধিতার কারণে তার মা তাকে কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন পরীক্ষা কেন্দ্রে। সেই ছবি ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সেই হৃদয় সরকার এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পড়ছেন। ভর্তি পরীক্ষার দিনের মতো স্কুল কলেজেও তিনি মায়ের কোলে চড়েই যেতেন।
উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় বাধ্য হয়ে মা তাকে কোলে চড়িয়ে নিতেন কিনা জানতে চাইলে হৃদয় জানান, তার মা এই কাজটি নিজে থেকেই করেছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে হৃদয় বলেন, "প্রতিবন্ধী অনেক শিশু স্কুল পর্যন্ত পৌঁছালেও বাধা সেখানেই শেষ হয় না। ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই ধরনের কথাই শোনা যায়। তবে নেতিবাচক কথাই বেশি। এদেরকে পড়াশোনা করিয়ে কী হবে, এটা লস প্রজেক্ট-এ রকম নানা কথা বলে।”
‘‘এখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার জন্য যতটুকু সুবিধা দরকার, তা থেকে আমরা বহুদূরে আছি। অনেকে বলে, বাবা-মায়ের খারাপ কাজের জন্য সন্তানরা প্রতিবন্ধী হয়েছে। এতে বাবা-মা চাপ অনুভব করেন। ফলে এই সন্তানের প্রতি অনীহা চলে আসতে পারে।''
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতটা প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীবান্ধব-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘একটা সময় প্রতিবন্ধী বলতে তারা ভেবেছে দৃষ্টি-শ্রবণ-বাক প্রতিবন্ধীদের নিয়ে। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য কোটা রাখতে হবে- এটা তাদের মাথায়ই আসেনি। ক্লাস রুম, বিভাগে যে ধরনের পরিবেশ থাকতে হবে, সেটাও ভাবেনি তারা।''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার বিষয়টা যখন আলোচিত হলো, তখন আমাদের বিষয়টা নতুন করে ভাবনায় এসেছে। কিছু কিছু র্যাম্প তৈরি হয়েছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় করলে এখনো অনেক কিছু করা বাকি আছে।''
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, দুই কারণে তিনি হলে থাকতে পারছেন না, ‘‘তার সাথে সার্বক্ষণিক একজন লোক থাকা লাগে। দ্বিতীয়ত: ওয়াশ রুম, রিডিং রুম এগুলো আমার জন্য সুইটেবল না, অ্যাকসেসেবল না।''
লড়াই আছে আরো নানা জায়গায়
নাজনীন আক্তার পড়াশোনা শেষে সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে নিজের ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন বিয়ের আগেই।
বাচ্চা হওয়ার পর শুরু হয় তার নতুন সংগ্রাম। তিনি বলেন, ‘‘তখন আমি চাকরি একবার ছাড়ি, আবার নেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরিটা ছেড়ে দিতে হয়। আমার পেশাকে স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে।''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমি অতীতে কী পার করেছি তার চেয়েও আমি বেশি উদ্বিগ্ন ভবিষ্যৎ নিয়ে। এটা হতে পারতো, ওয়ান-টু-ওয়ান গাইডেন্সে একটা বাচ্চাকে গড়ে তোলা, এর জন্য যে মানুষটা ডেভোটেড হবে, তাকে বা তাদেরকে সেই ফ্যাসিলিটিগুলো দিয়ে রাখা।''
"সমস্যাটা যেটা, আমার অবর্তমানে পরিবারের কারো দায়িত্ব থাকতেও পারে না-ও থাকতে পারে। ওর এই জায়গাটা কীভাবে দেখা হবে? আমাদের দেশের কোনো সরকারি ব্যবস্থা, বেসরকারি ব্যবস্থা-কোথাও আমি এটা পাচ্ছি না যে, ও ওর স্বাভাবিক জীবন-যাপন, ও ওর দক্ষতা নিয়ে কাজ করবে, সেটাতে আমার মতো করে কেউ তাকে গাইড করবে বা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।”
সমাজের শিক্ষিত-স্বচ্ছল অংশের বাইরে থাকা মানুষদের অবস্থা আরো খারাপ। এমনই অভিজ্ঞতার কথা বলছেন প্রতিবন্ধী নারীদের জাতীয় পরিষদের সভাপতি নাসিমা আক্তার। নাসিমার দাবি, ২৩টি জেলায় প্রতিবন্ধী নারীদের ১১১টি সংগঠনের প্রায় ১০ হাজার নারীকে নিয়ে কাজ করে এই পরিষদ।
তিনি বলেন, ‘‘এখানে প্রতিবন্ধী নারীদের সামর্থ উন্নয়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ, তাদেরকে মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কাজ করা, নির্যাতনের শিকার হলে আইনি সহায়তা দেয়া, তাদের শিক্ষা কর্মসংস্থান নিয়ে আমরা কাজ করি।''
"সমাজে নারীদের চেয়ে প্রতিবন্ধী নারীরা আরো পিছিয়ে থাকে। তারা নারী হিসাবে, প্রতিবন্ধী হিসাবে বাধার মুখে পড়েন। এ সময় অনেকে পরিবারেরও সাহায্য পায় না। তাদের মধ্যে আবার বড় একটি অংশ হতদরিদ্র। নারীদের কথা ভাবলেও আমরা সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের কথা ভাবি না। সুযোগও দেয়া হয় না।”
গণপরিবহণ যেখানে সাধারণ নারীদেরেই নিতে চায় না, সেখানে প্রতিবন্ধী নারীদের কী অবস্থা?
নাসিমা বলেন, ‘‘গণপরিবহনে প্রতিবন্ধী নারীরা উঠতে পারে না, যারা হুইল চেয়ার ব্যবহার করে, তাদের জন্য আরো বেশি সমস্যা। টিকেট কাউন্টারে গিয়ে টিকেট কাটা যায় না। টিকেটের ব্যবস্থা সহজ না।''
"হুইল চেয়ারটা এগিয়ে দেবে, তারা দিতে চায় না। এটা খুবই বাজে অভিজ্ঞতা। কিছুদিন আগে আমাদের এক প্রতিবন্ধী বোন বাসে ভাড়া দিতে না পারায় তাকে বাস থেকে ফেলে দিয়েছে। সে কিন্তু মারা গেছে। এটা নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি।”
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার নিশ্চিতে ২০১৩ সালের আইনে জাতীয় সমন্বয় কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জেলা কমিটি, শহর কমিটি, উপজেলা কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে জাতীয় সমন্বয় কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সচিব পদে রাখা হয়েছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। বর্তমানে এই পদে রয়েছেন অতিরিক্ত সচিব মো. আনিসুজ্জামান।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে যে কোনো মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ বা নির্দেশনা প্রদান জাতীয় সমন্বয় কমিটির কাজ। এই কমিটির সদস্য সচিবের কাছে প্রশ্ন ছিল, সড়ক-নৌ-আকাশপথে ৫ শতাংশ আসন প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দে সরকারি প্রজ্ঞাপন হয়েছে কিনা, জবাবে তিনি বলেন, ‘‘বিষয়টি দেখে বলতে হবে।''
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি বৈষম্য করায় কোনো কমিটি আইন অনুযায়ী কাউকে ক্ষতিপূরণ আদায়ে পদক্ষেপ নিয়েছে কিনা, এমন প্রশ্নে তিনি জানান, তার জানা মতে এমন কোন পদক্ষেপ এখনো নেয়া হয়নি।
প্রতিবন্ধী সুরক্ষা বিমা ও আরো কিছু অগ্রগতি
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা নিশ্চিতে অনেক অগ্রগতিও রয়েছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হিসাবে ধরা হয় প্রতিবন্ধী সুরক্ষা বিমাকে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট এবং সাধারণ বীমা কর্পোরেশন যৌথভাবে এই বিমা চালু করেছে বলে জানিয়েছেন ট্রাস্ট্রের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোঃ আনোয়ার উল্ল্যাহ্।
তিনি বলেন, ‘‘এই বীমার মাসিক প্রিমিয়াম ৬০০টাকা। ৩ থেকে ২৫ বছর বয়সিরা এই বিমা সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। তবে কারো অভিভাবকের বাৎসরিক আয় ৩ লাখ টাকার কম হলে তিনি মাসে দেড়শ টাকা পরিশোধ করলেই হবে। বাকি টাকা ট্রাস্ট পরিশোধ করবে।''
তিনি বলেন, ‘‘বিনিময়ে বছরে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকার কাভারেজ পাওয়া যাবে। এটা আবার দুই ভাগে বিভক্ত। হাসপাতালে ভর্তি হলে ৭০হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা যাবে। এর বাইরে চিকিৎসার জন্য যাতায়াত, চিকিৎসকের ফি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির জন্য বছরে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা যাবে।''
গত ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা দেয়ার পর পাইলট প্রকল্পের আনুসঙ্গিক কাজ শুরু হয়েছে। এজেন্ট নিয়োগে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে। এজেন্ট নিয়োগ হলে ঢাকা ও সিলেটের প্রতিবন্ধীরা এই বীমা গ্রহণ করতে পারবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, পাইলট প্রকল্প চলচে এক বছর। এতে অটিজম, ডাউন সিনড্রোম, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও সেরিব্রাল পালসি-এই চার ধরনের প্রতিবন্ধীরা সুবিধা পাবেন।
"পাইলটের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এমনও হতে পারে, প্রিমিয়ামও বাড়বে। সুবিধাও বাড়বে।”
বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে সাধারণভাবে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যবিমা নেই, সেখানে প্রতিবন্ধী সুরক্ষা বিমাকে বড় একটা অগ্রগতি হিসেবেই দেখছেন এই কর্মকর্তা।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা মো. আনিসুজ্জামান বলেন, ‘‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুসারে সারা পৃথিবীর ৮ থেকে ১০ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধিতার শিকার। সেই হিসাবে বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীর সংখ্যা দেড় কোটির উপরে। সমাজসেবা অধিদপ্তর তাদেরকে খুঁজে বের করতে একটা জরিপ করছে। এটা প্রতিদিনই আপডেট হয়। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে এটা ২৬ লাখ।''
"এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে ভাতার আওতায় আনা হয়েছে, সকল প্রতিবন্ধী প্রতি মাসে সাড়ে ৭শ টাকা করে ভাতা পান। প্রতিবন্ধী ছাত্র-ছাত্রীরাও এটা পান।”
"আমাদের ফাউন্ডেশন থেকে আমরা ৭৪টি বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল পরিচালনা করছি। ১২টি স্পেশাল স্কুল রয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে স্কুল প্রতিষ্ঠা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। প্রতিটা জেলায় একটা করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হবে। এটা করলে তারা দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত হবে।”
"প্রতিবন্ধীদের খেলাধুলার জন্য একটা ক্রীড়া কমপ্লেক্সও হচ্ছে সাভারে।”
২০১৯ সালের ছবিঘর