1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে পর্যটন খাত আর সোনার ডিম পাড়া হাঁস খেয়ে ফেলা জাতি

শামীমা নাসরিন
শামীমা নাসরিন
৩১ মে ২০২৪

উচ্চ শব্দে সাউন্ডবক্সে গান বাজছে, তালে তালে হৈ হৈ করে নাচছে এক দল মানুষ। চারিদিকে ছড়ানো-ছিটানো প্লাস্টিকের পানির বোতল আর চিপসের প্যাকেট, গাদাগাদি ভিড় আর গলা কাটা দাম।

https://p.dw.com/p/4gTtP
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৈকত থেকে প্লাস্টিক সংগ্রহ করছেন দুই নারী
দূষণ আর পর্যটনের চাপে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ সৌন্দর্য হারাচ্ছেছবি: DW/M. M. Rahman

বাংলাদেশে পর্যটন বলতে এখন এসবই দেখতে পাওয়া যায়। না আছে প্রকৃতিকে বাঁচানোর চেষ্টা, না আছে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন করার দায়।

গত শতাব্দীর শেষভাগে শৈশব পার করা বাঙালিদের একজন আমি। ছোটবেলায় বেড়াতে যাওয়া মানেই ছিল দাদা বাড়ি বা নানা বাড়ি। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে দেশের কয়েকটি জেলায় গেলেও সেগুলো ঘুরে দেখার খুব একটা সুযোগ হয়নি। কারণ, মধ্যবিত্ত বাঙালির কাছে তখন বেড়াতে যাওয়া মানেই ছিল স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে তাদের বাড়িতে যাওয়া। আমার পরিবারও সেই দলেই ছিল।

বিয়ের ঠিক পরপর ২০০৯ সালের জুলাই মাসে স্বামী ও তার বন্ধু-বন্ধুপত্নীদের সঙ্গে প্রথম বেড়াতে যাই প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে। ভ্রমণের মৌসুম না হওয়ায় সেন্টমার্টিন যাওয়ার ফেরি বন্ধ ছিল। অগত্যা স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে ট্রলারে করেই সাগর পাড়ি দেওয়ার দুঃসাহস দেখাই। নানা অভিজ্ঞতার পর দ্বীপে পৌঁছে দেখতে পাই আমরাই তখন সেখানে একমাত্র পর্যটক দল। খাবার নিজেদের রান্না করে খেতে হয়েছে, হোটেলে কারেন্ট দিত মাত্র তিন ঘণ্টা। কিন্তু যে প্রকৃতি, যে পান্না সবুজ জলরাশি আর যে সমুদ্রের গর্জন শুনেছি তা ভাবলে এখনো আমার গায়ে কাঁটা দেয়। সেন্টমার্টিনে একরাত থেকে আমাদের পরিকল্পনা ছিল বাকি দুই রাত কক্সবাজারে থাকার। কিন্তু আমরা কক্সবাজার বাদ দিয়ে তিনরাতই সেন্টমার্টিনে থেকে যাই। শুধুমাত্র সমুদ্রের জলে ভিজে থেকে যাই। বিশ্বাস করুন, আমাদের কারো একবারও মাছের বারবিকিউ খেতে ইচ্ছা হয়নি…

এত কথা বললাম কেনো জানেন? এখন সেন্টমার্টিনের সৈকত ঘিরে যে আলোর রোশনাই আর পোড়া মাছের গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে যাওয়ার কথা শুনি, তাতে সেন্টমার্টিন আর আমাকে টানে না। শুনেছি, প্রবালগুলোও অনেকটাই মরে গেছে।

একই অভিজ্ঞতা আমার বান্দরবানের বগালেকের বেলাতেও হয়েছে। দুই-তিনমাস পরই আমরা বান্দরবান বেড়াতে যাই। সফরসঙ্গীরাও প্রায় একই ছিল। ঢাকা থেকে রাতে রওয়ানা হয়ে বিরতি না নিয়ে বান্দরবান হয়ে আরো দুই তিনটি জায়গা ঘুরে আমরা সন্ধ্যার আগে দিয়ে চান্দের গাড়িতে বগালেকে পৌঁছাই। ঢাকায় তখন শীত ছিল না, কিন্তু বগালেকে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। টানা জার্নির ধকলে খেয়েই আমরা শুয়ে পড়ি। পরদিন ঘুম ভাঙতে বেলা হয়ে যায়। নাস্তা সেরে যখন আমরা বগালেক থেকে কেওক্রাডংয়ের পথে হেঁটে যাত্রা শুরু করি, বেলা ১১টা বাজি বাজি করছে। তখন বেশিরভাগ অভিযাত্রীরাই কেওক্রাডং জয় করে ফিরে আসছেন। তারা পথে আমাদের দেখে আর মুচকি হাসে। এক দল তো বলেই বসলো, ‘‘রোদ চড়া হওয়ার আগেই ঘুরে আসতে হয়। আর আপনারা এখন চলেছেন। সাথে আবার তিন নারী! ফিরবেন কখন?'' সেবার কিন্তু আমরাও কেওক্রাডং জয় করেছি। খাড়া পথে রীতিমতো হামাগুড়ি দিয়ে উপরে ওঠা বা গড়িয়ে নিচে নামা। এখন তো রাস্তা হয়েছে, কেওক্রাডংয়ের চূড়াতেই হয়েছে হোটেল!

জানি অনেকে বলবেন, আপনার দুর্গম প্রকৃতি ভালো লাগতে পারে। আমাদের তো সঙ্গে স্বচ্ছন্দও চাই। তা বলে প্রকৃতিকে শেষ করা স্বচ্ছন্দ কী আসলেই আপনাদের চাই?

বগালেক যাওয়ার সময় আমিও টয়লেট নিয়ে ভেবেছি। ব্যবস্থা আছে কিনা? নিরাপত্তা, দুর্ঘটনায় পড়লে বা অসুস্থ হলে কি করবো? কিন্তু যদি পাহাড়ে গিয়ে আপনার এসি ঘরের বন্ধ দরজায় ঠান্ডা বাতাস খাওয়ার ইচ্ছাই থাকে তবে আপনার হাতে তো অনেক বিকল্প রয়েছে। কেন প্রকৃতির কাছে আসা, কাকে দেখবেন, যদি প্রকৃতিই হারিয়ে যায়?

বাংলাদেশে ঐতিহাসিক স্থাপনার ক্ষেত্রেও একই কাণ্ড হচ্ছে। বরং আরো দ্রুত ও ভয়ঙ্কর রূপ হচ্ছে। ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে ভেঙেচুরে সব কিছু দখলের খেলায় মত্ত উন্মাদ একদল মানুষ।

রূপলাল হাইসের ভঙ্গুর দশা
ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে তৈরি হওয়া রূপলাল হাউস ধ্বংসের পথেছবি: DW/M. Mamun

নারী হিসেবে আমার কাছে ভ্রমণের বেলায় নিরাপত্তা একটি বড় বিষয়। এই খাতে বাংলাদেশের পর্যটন একদম শূন্য পাবে। সাংবাদিক আর সাহসী নারী হয়েও আমি আজ পর্যন্ত এমনকি কক্সবাজারেও একা যাওয়ার সাহস করতে পারিনি এই নিরাপত্তার অভাবে। বান্দরবান, সিলেট, খাগড়াছড়ির প্রত্যন্ত পর্যটন স্পটগুলোর কথা তো চিন্তা করতেই ভয় হয়।

অনেক হোটেলে একা মেয়েকে রুম ভাড়াও দিতে চায় না। সাজেক বা সিলেটের সাদা পাহাড়, টাঙ্গুয়ার হাওড়ের নৌকায় এখনও একা ঘুরে বেড়ানোর মতো নিরাপদ মনে হয় না আমার মতো অনেক মেয়ের কাছেই।

বর্তমানে মেয়েদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য সামাজিক মাধ্যম নির্ভর অনেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে। যেখানে মেয়েরা নিজেরা ইভেন্ট আয়োজন করে দল বেঁধে বেড়াতে যায়। পর্যটন নিয়ে নানা আয়োজনের পরেও একা একটি মেয়ের ঘুরে বেড়ানোর মতো নিরাপদ পরিবেশ এখনও দেশে তৈরি করা যায়নি।

কিন্তু পাশের দেশ ভারতেই দেখেছি, নেপালে দেখেছি, অনেক মেয়ে একা একা বেড়াতে এসেছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে। থাকার জায়গা, নিরাপত্তা, টয়লেট- কোনো কিছু নিয়েই তাদের ভাবতে হচ্ছে না।

এসব দেশের সাথে তুলনা করে আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে হয়ত পর্যটন বান্ধব পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে, অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, কিন্তু এখনও পর্যটন পরিবেশের মানসিকতা তৈরি হয়নি

আমার মতে, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে পর্যটন খাতে বাংলাদেশের পাল্লা দিয়ে উঠতে না পারার আরেকটি বড় কারণ এখানে বেড়ানোর খরচ অনেক বেশি। কক্সবাজারে দুই রাত থাকতে যে খরচ, তার চেয়ে কম খরচে ভারতের দার্জিলিংয়ে দুইরাত থেকে আসা যায়। এমনকি ঢাকার কাছের একটি রিসোর্টে দুই রাত থাকা-খাওয়া মিলে যে খরচ হবে, তার সাথে অল্প কিছু মেলালে নেপালে যাওয়া যায়। প্রতিবেশী ভারতের যেকোনো পর্যটন স্পটের তুলনায় এখানে হোটেল ভাড়া, পরিবহণের খরচ অনেক বেশি। তাই তো বাংলাদেশের মানুষ ভিড় করে ভারত, নেপাল, ভূটান, থাইল্যান্ড বেড়াতে যায়।

একবার কোরবানি ঈদের পরদিন আমরা ভারতের সিকিমে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সিকিমে প্রবেশ করতে ভারতের ভিসা থাকার পরও বিদেশিদের সেখানে গিয়ে আলাদা করে সিকিমে প্রবেশের অনুমতি নিতে হয়। সেখানে যে লম্বা লাইন পড়েছিল! সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে যায়। তবুও লাইন শেষ হয় না। সেদিন ভারতীয়দের দেখে খুব হিংসা হয়েছিল। ওরা যে সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে।

গ্যাংটকে গিয়েও দেখি বাঙালি আর বাঙালি। ঘুরে বেড়াবার জন্য গাড়ি ঠিক করতে গিয়েও দেখি বেহাল দশা। গাড়ি নেই কেন প্রশ্ন করাতে তাদের একজন হেসে বললেন, ‘‘বাংলাদেশে কি কোনো ছুটি চলছে? সবাই তো মনে হয় আমাদের এখানে চলে এসেছে।”

যদিও বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবারের পক্ষেই আসলে বিদেশে বেড়াতে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। অধিকাংশ পরিবার হয়তো সারাবছর ধরে পরিকল্পনা করে, টাকা জমিয়ে বছরে মাত্র একবার বা দুই বছরে একবার কোথাও বেড়াতে যায়। অনেকের কাছে সেটাও কঠিন। খরচ কমলে হয়তো সবাই আরেকটু বেশি বেড়ানোর পরিকল্পনা করতো।

ঘুরে বেড়ানো, পর্যটন তো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক কোনো ব্যাপার না। কোথাও বেড়াতে যাওয়া মানে আমার কাছে সেটা মনের শক্তি সঞ্চয় করে আসা। পুরোনো মানসিক চাপ ঝেড়ে ফেলে আবার কিছুদিনের জন্য সতেজ হয়ে ফেরা।

কিন্তু সেটার জন্য যদি খরচ, নিরাপত্তা, পরিবেশ- ইত্যাদি নিয়ে এত চিন্তা করতে হয় তবে আনন্দ অনেকটাই ফিকে হয়ে যায়।

বেড়ানোর বিষয়টা যত সহজ হবে, সাশ্রয়ী হবে আর নিরাপদ হবে, তত মানুষ আরও আরও বেশি করে বেড়াতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। দেশের অর্থনীতিও তাতে গতি পাবে।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য