1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশকে হারিয়ে সেমিফাইনালে এক পা ভারতের

রাহেনুর ইসলাম
২৩ জুন ২০২৪

অ্যান্টিগায় বাংলাদেশকে ৫০ রানে হারাল ভারত। রোহিত শর্মার দলের ৫ উইকেটে ১৯৬ রানের জবাবে বাংলাদেশ থামে ৮ উইকেটে ১৪৬ রানে। অপরাজিত ৫০ রানের পাশাপাশি ১ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরা হার্দিক পাণ্ডিয়া।

https://p.dw.com/p/4hOOL
ঋষভ পন্থের বাউন্ডারি
ভারতের ইনিংসে ছক্কা ছিল ১৩টি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটা তাদের সর্বোচ্চ।ছবি: Lynne Sladky/AP/picture alliance

আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছিল সকালে বজ্রঝড় হবে অ্যান্টিগায়। বৃষ্টির শঙ্কা ছিল ৫১ শতাংশ। শহরজুড়ে ঝড়-বৃষ্টি হয়নি। তবে স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের বোলারদের উপর ঝড় বইয়ে ভারত পায় ১৯৬ রানের পুঁজি। এই মাঠেটি-টোয়েন্টিতে সর্বোচ্চ স্কোর এটাই।

বাংলাদেশের নড়বড়ে ব্যাটিংয়ে ম্যাচ সেখানেই প্রায় শেষ। জিততে হলে অ্যান্টিগায় না হওয়া বজ্রঝড় তুলতে হতো কারও ব্যাটে। সেটাই তুলতে পারলেন না বাংলাদেশের কেউ। তাই বাংলাদেশ হারল ৫০ রানে। অস্ট্রেলিয়ার পর সুপার এইটে টানা দ্বিতীয় হার বাংলাদেশকে একপ্রকার  ছিটকে দিল সেমিফাইনালের দৌড় থেকে।

পিচ শেষ দিকে ধীর গতির হবে ভেবে টস জিতলে ব্যাটিং নিতেন বলে জানিয়েছিলেন রোহিত শর্মা। টস হারলেও নাজমুল হোসেন শান্ত ব্যাটিংয়েই পাঠান ভারতকে!

দুই প্রান্ত দিয়ে দুই স্পিনার দিয়ে বোলিং শুরু করে শান্ত চমকে দিতে চেয়েছিলেন ভারতকে। উল্টো স্পিনে শক্তিশালী রোহিত শর্মা ও বিরাট কোহলি চড়াও হন শুরু থেকে। শেখ মেহেদী হাসান প্রথম ওভারে দেন ৮ রান। সাকিব আল হাসানের করা পরের ওভারে আসে ১৫।

বিস্ময় জানিয়ে মাইকেল ভন এক্সে লিখেন, ‘‘স্পিনে অসাধারণ দুই ব্যাটারের বিপক্ষে আক্রমণ শুরু করল দুই স্পিনার ! দুজনই যখন বাঁহাতি পেসারের বিপক্ষে নড়বড়ে তখন মোস্তাফিজ নয় কেন?''

রোহিত শর্মা
পিচ শেষ দিকে ধীর গতির হবে ভেবে টস জিতলে ব্যাটিং নিতেন বলে জানিয়েছিলেন রোহিত শর্মা।ছবি: Lynne Sladky/AP/picture alliance

এবারের বিশ্বকাপে আজকের আগে ভারতের ওপেনিংয়ে সেরা জুটি ছিল ২২ রানের, আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে। অ্যান্টিগায় প্রথম দুই ওভারেই সেটা পেরিয়ে যায় ভারত। খরুচে শুরুর পর সাকিব আর হাসান ভাঙেন ৩৯ রানের উদ্বোধনী জুটি। চতুর্থ ওভারের প্রথম তিন বলে ১০ নেওয়ার পর চতুর্থ বলটা তুলে মারতে গিয়ে জাকের আলীকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন রোহিত শর্মা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটা সাকিবের ৫০তম উইকেট, আর কোনও বোলারের নেই এই কীর্তি।

পাওয়ার প্লেতে এক উইকেটে ৫৩ রান করেছিল ভারত। ছন্দ হারানো বিরাট কোহলির উপর আস্থা রাখতে বলেছিলেন সুনীল গাভাস্কার, ব্রায়ান লারার মত তারকারা। ২৮ বলে একটি বাউন্ডারি, তিনটি ছক্কায় ৩৭ রান করে নিজের জাতও চেনাচ্ছিলেন কিং কোহলি। কোহলি-ঋশভ পন্তের দাপটে নিজের  প্রথম ওভারে ১৫ রান দিয়ে বসেন রিশাদ হোসেন।

তানজিম হাসান সাকিব নবম ওভারে কোহলির পর সূর্যকুমার যাদবকে আউট করে ম্যাচে ফেরান বাংলাদেশকে। তানজিমের স্লো অফকাটার ডাউন দ্য উইকেটে তুলে মারতে গিয়ে বোল্ড হন কোহলি।

আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ সেরা হওয়া সূর্যকুমার যাদব প্রথম বলেই ছক্কা মেরেছিলেন তানজিমকে। কিন্তু ঠিক পরের বলেই সূর্যের ‘আলো' নেভান এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সেরা এই বোলার। তার শর্ট লেংথের বলটা পেয়েছিল এক্সট্রা বাউন্স, যা ড্যাব করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে লিটন দাসকে ক্যাচ দেন সূর্যকুমার। ৩ বলে ২ উইকেট নিয়ে ম্যাচে ফিরে বাংলাদেশ।

মোস্তাফিজের করা ১১তম ওভারে একাই ১৪ রান নিয়েছিলেন ঋষভ পন্ত। পরের ওভারে রিশাদকে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে শর্ট থার্ডে তানজিমকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন ২৪ বলে ৩৬ করা এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। আফগানিস্তানের বিপক্ষে আরেক লেগ স্পিনার রশিদ খানকে রিভার্স সুইপ করতে গিয়েই আউট হয়েছিলেন তিনি।

১৫ ওভার শেষে ভারতের রান ছিল চার উইকেটে ১৩৪। শেষ পাঁচ ওভারে তারা তোলে ৬২ রান। মোস্তাফিজুর রহমানের করা শেষ ওভারে ভারত নেয় ১৮ রান।  ১৮তম ওভারে ২৪ বলে তিন ছক্কায় ৩৪ করা শিবম দুবেকে বোল্ড করেন রিশাদ হোসেন। টার্ন করে একটু ভেতরে ঢোকা বল মিস করে বোল্ড হন তিনি।

এরপর আউট হননি আর কেউ। হার্দিক পাণ্ডিয়া অপরাজিত থাকেন ২৭ বলে চার বাউন্ডারি তিন ছক্কায় ৫০ রানে। মোস্তাফিজের করা ইনিংসের শেষ বলে শর্ট থার্ড দিয়ে বাউন্ডারিতে পাঠিয়ে ফিফটি পূরণ করেন তিনি।

ভারতের ইনিংসে ছক্কা ছিল ১৩টি। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটা তাদের সর্বোচ্চ। আগের রেকর্ড ছিল ২০০৭ সালে ডারবানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১১টি। মোস্তাফিজুর রহমান ছিলেন বিবর্ণ। চার ওভারে ৪৮ রান খরচায় পাননি উইকেটের দেখা। অথচ গ্রুপ পর্বে ২০ দলের বোলারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৬৭টি ডট বল দেওয়ার রেকর্ড ছিল তার।

আজ বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে ২টি করে উইকেট তানজিম হাসান ও রিশাদ হোসেনের। দুজনই এবারের বিশ্বকাপে নিয়েছেন সমান ১১টি করে উইকেট, যা বিশ্বকাপের এক আসরে বাংলাদেশি বোলারদের মধ্যে যৌথ সর্বোচ্চ। ২০২১ বিশ্বকাপে সাকিব আল হাসানও নিয়েছিলেন ১১ উইকেট।

স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামটা অ্যান্টিগার প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ২০০৭ বিশ্বকাপের আগে বানিয়ে দিয়েছিল চীন। এই স্টেডিয়ামে এবারই প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলছে বাংলাদেশ। এর আগে খেলেছিল ২টি করে টেস্ট আর ওয়ানডে। তবে সেই অভিজ্ঞতা সুখের ছিল না, সবগুলো ম্যাচ হেরেছিল বাজেভাবে। 

‘অপয়া' এই মাঠে এবারের বিশ্বকাপে প্রথম টি-টোয়েন্টি খেলে অস্ট্রেলিয়ার কাছে নাজমুল হোসেন শান্তর দল বৃষ্টি আইনে হেরেছে ২৮ রানে। আজ ভারতের বিপক্ষেও হারল ৫০ রানের বড় ব্যবধানে।

২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে লিটন দাসের ২৭ বলে ৬০ রানের ঝড়ে প্রায় উড়ে যাচ্ছিল ভারতের গর্বের মিনার। বৃষ্টিতে লিটন ছন্দ হারালে শেষ পর্যন্ত ৫ রানে হারে বাংলাদেশ। সেই লিটন আজ শুরুটা ভালো করলেও ইনিংসটা বড় করতে পারেননি। অক্ষর প্যাটেলকে বাউন্ডারি আর হার্দিক পাণ্ডিয়াকে পুল করে ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। তবে ছক্কার পরের বলেই হার্দিকের স্লোয়ার অন সাইডে তুলে মারতে গিয়ে বাউন্ডারি লাইনে সূর্যকুমারকে ক্যাচ দেন লিটন (১০ বলে ১৩)।

ভাঙে বাংলাদেশের ৩৫ রানের ওপেনিং জুটি, যা এবারের বিশ্বকাপে নাজমুল হোসেনের দলের সর্বোচ্চ। প্রথম পাঁচ ম্যাচ মিলিয়ে ওপেনিং জুটিতে বাংলাদেশের রান ছিল ১৩ (১,৯,৩, ০, ০)।

যশপ্রীত বুমরার করা পাওয়ার প্লের শেষ ওভারটা ছিল ঘটনাবহুল। ফুলটস হওয়া প্রথম বলটা নো দেননি আম্পায়ার, সিদ্ধান্তটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। আগের দুই ম্যাচে শূন্য করা তানজিদ হাসান পরের বলে সহজ ক্যাচ দিয়েছিলেন পন্তকে, যা গ্লাভসে রাখতে পারেননি এই উইকেটরক্ষক। ছয় ওভার শেষে এক উইকেটে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪২।

গ্যালারিতে ভারতীয়দের উচ্ছ্বাস
এক উইকেটে ৬৬ থেকে তিন উইকেটে ৭৬ রানে পরিণত হওয়ায় ম্যাচটা আরো কঠিন হয়ে যায় বাংলাদেশের।ছবি: Lynne Sladky/AP/picture alliance

হার্দিক পাণ্ডিয়ার করা নবম ওভারে দুটি ছক্কা মেরেছিলেন বাংলাদেশি অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। কিন্তু কুলদীপ যাদবের করা দশম ওভারে গুগলিতে পেছনের পায়ে খেলার চেষ্টায় এলবিডাব্লিউ হন তানজিদ। ২০০ ছুঁই ছুঁই স্কোর তাড়া করতে নেমে তাঁর ৩১ বলে ২৯ রানের ইনিংসটা ছিল বেমানান।

এই কুলদীপের বলেই এলবিডাব্লিউ হয়ে ফিরেন তাওহিদ হৃদয়। ৬ বলে ৪ করেছিলেন তিনি। এক উইকেটে ৬৬ থেকে তিন উইকেটে ৭৬ রানে পরিণত হওয়ায় ম্যাচটা আরও কঠিন হয়ে যায় বাংলাদেশের। কুলদীপ ফেরান ১১ রান করা সাকিব আল হাসানকেও।

দলের সেরা ব্যাটারদের হারিয়ে জয়ের জন্য রানের সঙ্গে বলের ব্যবধান যত বেড়েছে, চাপ থেকে ভয়ঙ্করতম চাপের গিরিখাতে হারিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। নামজুল হোসেন শান্তর ৩২ বলে ৪০ আর রিশাদ হোসেনের  ১০ বলে ২৪ রানের ইনিংসটা পরাজয়ের ব্যবধানই কমিয়েছে শুধু। বুমরাহর বলে আর্শদীপকে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন শান্ত। রিশাদকেও ফেরান বুমরা।

ব্যাটিং শক্তি বাড়াতে তাসকিন আহমেদের জায়গায় বাংলাদেশ একাদশে ফিরেয়েছিল জাকের আলীকে। সেই জাকের আউট হন কেবল এক রানে। কুলদীপ যাদব নেন ১৯ রানে তিন উইকেট। চার ওভারে ১৩ রানে দুই উইকেট পান বুমরাহ।

ভারত-পাকিস্তানের যে উত্তেজনা, ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের পারদ ঠিক সেই উচ্চতায় উঠে না। তারপরও গত এক দশকে বারুদে ঠাসা অনেক ম্যাচ উপহার দিয়েছে দুই দল। সেই ২০০৭ ওয়ানডে বিশ্বকাপে তেণ্ডুলকার-সৌরভদের হারিয়ে দেওয়া, ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপে রোহিত শর্মার আউটের পর রুবেল হোসেনের বলে ‘নো' ডাকা কিংবা ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বেঙ্গালুরুতে ভারতের কাছে জয়ের মুখে থেকেও মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর ভুলে মাত্র ১ রানে হার-দুই দলের লড়াইকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।

বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা
ভারত-পাকিস্তানের যে উত্তেজনা, ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচের পারদ ঠিক সেই উচ্চতায় উঠে না।ছবি: Lynne Sladky/AP/picture alliance

আজ অ্যান্টিগায় তেমন কিছু ঘটেনি। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে টিকে থাকার ম্যাচটা ৫০ রানে হেরে বিদায় নেওয়াটা সময়ের অপেক্ষা হয়ে উঠল বাংলাদেশের। আর ভারত সেমিফাইনালে দিয়ে রাখল একটা পা। দুই ম্যাচ শেষে ভারতের পয়েন্ট চার, বাংলাদেশের শূন্য। এক ম্যাচ খেলা অস্ট্রেলিয়ার পয়েন্ট দুই ও আফগানিস্তানের শূন্য।

বাংলাদেশের কোচ চণ্ডিকা হাথুরুসিংহে বলেছিলেন, ‘‘সুপার এইটে ওঠা ছিল প্রথম লক্ষ্য, এরপর যা হবে সবই বোনাস।'' তানজিম, রিশাদের বোলিং ছাড়া বোনাস হিসেবে এ পর্যন্ত পাওয়া গেল না কিছুই।

সবমিলিয়ে ১৪ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে (এশিয়ান গেমসসহ) বাংলাদেশের বিপক্ষে ভারতের জয় ১৩টি। বিশ্বকাপে পাঁচ দেখাতেই জিতল ভারত। তবে সবশেষ ২০১৬ বিশ্বকাপে এক রান আর ২০২২-এ হার ছিল পাঁচ রানে। এবার ব্যবধানটা ৫০ রানের।

সংক্ষিপ্ত স্কোর

ভারত :  ২০ ওভারে ১৯৬/৫ (পাণ্ডিয়া ৫০*, কোহলি ৩৭, পন্ত ৩৬, দুবে ৩৪ ; রিশাদ ২/৪৩, তানজিম ২/৩২, সাকিব ১/৩৭)।

বাংলাদেশ :  ২০ ওভারে ১৪৬/৮  (নাজমুল ৪০, তানজিদ ২৯, লিটন ১৩, মাহমুদউল্লাহ ১৩ ; কুলদীপ ৩/১৯, ২/১৩)

ফল : ভারত ৫০ রানে জয়ী।

ম্যান অব দ্য ম্যাচ : হার্দিক পাণ্ডিয়া

রাহেনুর ইসলাম সাংবাদিক