1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বজ্রপাত: কীভাবে বাঁচবে দেশ?

সুলাইমান নিলয় ঢাকা
১১ জুন ২০২১

২০২০ সালে সারা দেশে যেখানে বজ্রপাতে ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে সেখানে চলতি বছরে মার্চ থেকে জুনের মধ্যেই ঝরেছে ১৭৭টি তাজা প্রাণ৷

https://p.dw.com/p/3uliW
ছবি: Patrick Pleul/ZB/picture-alliance

শুক্রবার এই হিসাবটি দিয়েছে সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম-এসএসটিএএফ৷

সম্প্রতি গত ৬ জুন বজ্রপাতে একদিনে সর্বোচ্চ ১৭ জনের মৃত্যু ঘটেছে৷ এর আগে ২০১৬ সালের মে মাসে মাত্র দুই দিনে একইভাবে ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছিল৷

এ বছর বজ্রপাতে মৃত্যুবরণকারীদের নানা গল্প কাঁদিয়েছে অনেককে৷ যেমন, ফেনীতে তামান্না ও আল আমিন নামে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে পাশাপাশি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার সময়৷ আম কুড়াতে গিয়ে দিনাজপুরে মারা গেছে অন্য দুই শিশু৷

তবে বজ্রপাতের শিকার মানুষদের বড় অংশ কৃষক, যারা সবার মুখে অন্ন তুলে দিতে মাঠে যান৷ সেখানেই মরে পড়ে থাকেন৷

চিরবিদায়ের এত এত করুণ গল্প, এত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পরও বিষয়টি খুব একটা দৃষ্টি কাড়তে পারছে না উর্ধ্বতন মহলের৷ দেশে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর খবর যেভাবে গণমাধ্যম বা সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয় হয়েছে, সেরকম গুরুত্ব পাচ্ছে না বজ্রপাতে মৃত্যু৷

বজ্রপাতনিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহর নাঈম ওয়াহারার মতে, এই উপেক্ষার কারণ বজ্রপাতে মারা যায় সাধারণ মানুষ৷ কোনো পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা যেহেতু বজ্রপাতের শিকারে পরিণত হন না, তাই এটা নিয়ে তোড়জোড়ও কম৷

তিনি বলেন, ‘‘বজ্রপাত কিন্তু সার্বিকভাবে উপকারী৷ আমাদেরকে কেবল প্রাণক্ষয় এড়াতে হবে৷ ভূমির উর্বরা শক্তিতে এর অবদান রয়েছে৷’’

পূর্বাভাস সেটা খুব একটা কার্যকরী নয়: ড. আবদুল মান্নান, বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ

বজ্রপাত থেকে প্রাণ ক্ষয় কমাতে হলে, যা যা ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন, তার কোনোটিই দেশে ঠিকঠাক মতো হয় না বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷ এই গলদ শুরু হয় খোদ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস থেকেই৷

গলদ পূর্বাভাসেই

বজ্রপাত থেকে বাঁচতে যে তিনটি ধাপের কথা বলা হয়, তার প্রথমেই রয়েছে পূর্বাভাস৷ তবে খোদ আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল মান্নানের মতে, আবহাওয়া অধিদপ্তর বর্তমানে যেভাবে পূর্বাভাস দেয় সেটা খুব একটা কার্যকর নয়৷

তিনি বলেন, ‘‘কারণ আমরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বলি, এই এলাকায় বজ্রপাত হতে পারে বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে৷ এখন সকাল কয়টা থেকে কয়টায় হবে-সেটা নির্ধারণ করা বাংলাদেশের কনসার্নে কঠিন কাজ৷’’

এ ধরনের সর্তকতা মানুষ শোনে না বলেও মনে করেন তিনি৷

তিনি বলেন, ‘‘সময় ও স্থান সুনির্দিষ্ট করে আমাদের ওয়েবসাইটে কিছু তথ্য দেয়া থাকলেও এগুলো সাধারণ মানুষের কাছে ব্যাখ্যা করার মতো পর্যাপ্ত সময় আমরাও যেমন ব্যয় করতে পারছি না, কোনো সেক্টর থেকেও সেভাবে করা হচ্ছে না৷ যার কারণে অনেকে জানেই না, আবহাওয়ার পূর্বাভাস আছে কিনা৷ তবে বর্তমানে একেবারে সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়৷’’

তিনি জানান, তাৎক্ষণিক সতর্কতার এই বিষয়টাকে বলা হয় নাউকাস্টিং৷

‘‘এ ধরনের ফ্রিকোয়েন্সিয়াল ব্যবস্থাপনার জন্য অনেক উচ্চ প্রযুক্তি দরকার৷ এটা পাওয়ারফুল কম্পুটেশন দরকার, একইসাথে দক্ষ লোক দরকার৷ এগুলোর সংযোগ করা গেলে এই ধরনের পূর্বাভাস দেয়া সম্ভব৷ এরপর এই খবর ছড়িয়ে দিতে এলাকায় এলাকায় নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে হবে এবং মানুষকে রেসপন্সও করতে হবে৷’’

মৃত্যুর হার কমাতে উপকূলীয় এলাকার দৃষ্টান্ত টেনে এনে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দক্ষিণাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা কমার কারণ কেবল আগাম সতর্কবার্তা নয়৷ কেবল ব্যবস্থাপনাও নয়৷ স্থানীয়দের সচেতনতাও দরকার৷ দক্ষিণাঞ্চলে সতর্কতার সময়ে কেউ সাইক্লোন সেন্টারে না গেলে পুলিশ দিয়েও নিয়ে আসা হয়৷’’

আমরা হাওর অঞ্চলে একটা প্রকল্প করেছি: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘পূর্বাভাস জানার প্রযুক্তিটা আমাদের ক্ষেত্রে এফেক্টিভ নাই৷ স্ট্রং রাডার নেটওয়ার্ক ও স্যাটেলাইট নেটওয়ার্ক আমাদের নাই৷ সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস পেতে হলে রাডারের সাথে স্যাটেলাইট প্রযুক্তির উন্নয়ন করতে হবে৷’’

বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিয়া শাহনাজের মতে, ‘‘পুরনো ডেটা ও তাৎক্ষণিক ডেটা এআই দিয়ে বিশ্লেষণ করে খুবই সুনির্দিষ্ট পূর্বাভাস দেয়া যেতে পারে৷ এর জন্য দরকার উদ্যোগ৷ কিন্তু আমরা সেখানেই থমকে আছি৷’’

প্রাকৃতিক প্রতিরোধক ধ্বংস হয়ে গেছে

ফাউন্ডেশন ফর ডিজাস্টার ফোরামের সদস্য সচিব গওহর নাঈম ওয়াহারার মতে, ‘‘এক সময় আমাদের গ্রামে-গঞ্জে মাঠের মধ্যে গাছ থাকতো৷ কিন্তু আমরা এসব গাছ কেটে ফেলেছি৷ সেটা তালগাছই হোক বা অন্য গাছ৷ এসব গাছ আবার লাগাতে হবে৷’’

‘‘সরকার তালগাছ লাগানোর উদ্যোগ নিয়েছে৷ কিন্তু সেই গাছ লাগাচ্ছে রাস্তার পাশে৷ এটা দিয়ে কিছুই হবে না৷ আরো নানা রকমের প্রকল্প নেবে, রাডার কিনবে৷ কিছু মানুষের চাকরি হবে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছু হবে না৷’’

তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত বর্ধনশীল গাছ লাগাতে হবে৷ লাগানোর জায়গাটা হতে হবে বিলের মাঝখানে৷ খোলা জায়গার মাঝখানে৷ তাহলেই সেটা বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে পারবে৷’’

উপেক্ষিত বজ্রনিরোধক

বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে সব জনসমাগমের স্থানে বজ্রনিরোধক লাগানোর দাবি করেছেন জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ, বজ্রপাত বিশেষজ্ঞ ড. আবদুল মান্নান৷

লাইটনিং অ্যারেস্টার বা বজ্রনিরোধক কী, এটা কীভাবে কাজ করে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা আসলে মূলত তামার তার৷ চমকানো বিদ্যুৎ তামার তার দিয়ে মাটিতে চলে যায়৷ এটা বিদ্যুৎ সুপরিবাহী৷ খোলা জায়গা যেখানে আছে, সেখানে ৩০০ ফিট উপরে যদি এই তার স্থাপন করা হয়৷ তাহলে সেটা দিয়ে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটিতে চলে যাবে৷

তিনি বলেন, ‘‘তবে সাধারণ তামার তার ফেল করতে পারে৷ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তামার তার দিয়ে করতে হবে৷’’

এসএসটিএএফের ছয় দফা

সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরাম-এসএসটিএএফ বজ্রপাতে মৃত্যু কমাতে ছয় দফা দাবি তুলেছে৷ দাবিগুলো হচ্ছে :

১৷ বজ্রপাতের ১৫ মিনিট আগেই আবহাওয়া অধিদপ্তর জানতে পারে কোন কোন এলাকায় বজ্রপাত হবে৷ এটাকে মোবাইল মেসেজ আকারে সংশ্লিষ্ট এলাকার সকল মানুষকে জানানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে৷ 

২৷ ঝড়/জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দূর্যোগে মানুষের মৃত্যুর হার যতটা, তার চেয়ে অনেক বেশি মৃত্যুর হার বজ্রপাতে৷ এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঘোষণা করলেও এই খাতে বরাদ্দ কম৷ মানুষের জীবনরক্ষার্থে এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে৷

৩৷ মাঠে, হাওর, বাওরে বা ফাঁকা কৃষি কাজের এলাকায় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে৷ তার উপরে বজ্রনিরোধক স্থাপন করতে হবে যেন বজ্রপাতের সময় কৃষকগণ সেখানে অবস্থান বা আশ্রয় নিতে পারে৷

৪৷ বিদেশ থেকে আমদানির ক্ষেত্রে থান্ডার প্রটেকশন সিস্টেমের সকল পণ্যে শুল্ক মওকুফ করতে হবে৷

৫৷ সরকারিভাবে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বাড়ি বাড়ি বজ্রনিরোধক স্থাপনের ঘোষণা দিতে হবে৷

৬৷ বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা/ থান্ডার প্রটেকশন সিস্টেম যুক্ত না থাকলে নতুন কোনো ভবনের নকশা অনুমোদন করা যাবে না৷

সরকার কী করছে

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বলেন, ‘‘আমরা হাওর অঞ্চলে একটা প্রকল্প করেছি৷ সেখানে বিশাল ভূমিতে বজ্রপাতের সময় কৃষকরা কোনো আশ্রয় নেয়ার জায়গা পায় না, জায়গা থাকলেও সেখানে বজ্রনিরোধক থাকে না৷

তিনি বলেন, ‘‘নেত্রকোণা থেকে কিশোরগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেট, হবিগঞ্জ অঞ্চলের জন্য করা এই প্রকল্প আমরা পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়ে দিচ্ছি৷

‘‘এই প্রকল্পের আওতায় বজ্রপাত শুরু হলে মাঠে থাকা কৃষকদের তাৎক্ষণিক আশ্রয় নেয়ার মতো কিছু শেল্টার তৈরি করে দেবো৷ ওই এলাকার সরকারি বেসকারি যেসব ভবনে বজ্রনিরোধক নাই, সেগুলোতে আমরা বজ্রনিরোধক লাগিয়ে দেবো৷

অন্য এলাকার জন্য সরকার কী করছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এ রকম অন্য এলাকায় জায়গাগুলো চিহ্নিত করতে আমরা কাজ করছি৷ যেমন, বরেন্দ্র অঞ্চলে আমরা একটা প্রকল্প নিতে চাই৷’’

আগামী বছর বিভিন্ন এলাকায় টিআর-খাবিখার বরাদ্দ দিয়ে বজ্রনিরোধক স্থাপনের কাজ করা হবে বলেও জানান তিনি৷

শুক্রবারও বজ্রপাত নিয়ে সভা করেছেন জানানোর পর বিকালে সভার ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘এটা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করা যায় না৷ আমরা কাজ করছি৷’’