1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বই কেনার প্রকল্পটি যেন বন্ধ না হয়ে যায়

শাহনাজ মুন্নী
২ সেপ্টেম্বর ২০২২

এবারই প্রথম মাঠপর্যায়ে জেলা উপজেলায় বই কেনার জন্য ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল৷ বিতর্কের মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বই কেনার পুরো তালিকাই বাতিল ঘোষণা করেছে৷ কিন্তু ঘটনাটি বেশ কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে তুলে এনেছে৷

https://p.dw.com/p/4GLg6
Bangladesch Dhaka Amar Ekushey Buchmesse 2022
ছবি: Mortuza Rashed/DW

এবারই প্রথম মাঠপর্যায়ে জেলা উপজেলায় বই কেনার জন্য ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল৷ বিতর্কের মুখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বই কেনার পুরো তালিকাই বাতিল ঘোষণা করেছে৷ কিন্তু এই ঘটনাটি বেশ কিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে তুলে এনেছে৷

উদ্যোগটা আপাতদৃষ্টিতে ভালই ছিল৷ ‘জ্ঞান চর্চা ও পাঠাভ্যাস বাড়ানো’র প্রচেষ্টা৷ সেটা সরকারি কর্মচারি, বেসরকারি চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী বা অন্য যে কোন পেশাজীবীর জন্যই গ্রহণ করা হোক না কেন, অবশ্যই প্রশংসনীয়৷ এমনকি পাঠাগারের বিপক্ষেও কেউ নয়৷ সরকারি কার্যালয়ে পাঠাগার থাকলে, সেই পাঠাগারে পড়বার জন্য বই কেনা হবে সেটাও স্বাভাবিক৷ প্রতিবছরই মন্ত্রণালয়গুলিতে বই কেনার জন্য কিছু না কিছু বাজেট থাকে, তবে এবারই প্রথম মাঠপর্যায়ে জেলা উপজেলায় বই কেনার জন্য ৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল৷ উদ্যোগটি প্রশ্নের মুখে পড়লো যখন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বই কেনার তালিকায় নিজের লেখা ২৯টি বইয়ের নাম ঢুকিয়ে দিলেন৷ তার এই স্বেচ্ছাচারিতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার সমস্ত প্রক্রিয়াটিকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলো৷

প্রথমত, এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য যদি হয় পাঠাভ্যাস বাড়ানো, তবে কেনো একটু যত্ন করে, সময় নিয়ে বাছাই করে, এ বিষয়ে জানা বোঝা মানুষদের মতামত নিয়ে কমিটি গঠন করে সুন্দর একটা গ্রন্থ তালিকা করা হলো না? এটা সত্য, শতভাগ নিখুঁত নিরপেক্ষ কোন তালিকা তৈরি করা কঠিন৷ তবে সদিচ্ছা থাকলে সেটা করা অসম্ভব নয়৷ কিন্তু যদি উদ্দেশ্য হয় সরকারি টাকা ইচ্ছে মতো নয় ছয় করে খরচ করা বা নিজেদের পকেটে টাকা আনা অথবা বিশেষ কাউকে লাভবান করা, তবে সেই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক৷

এমন প্রশ্নও অনেকে করেছেন, সরকারি এই উদ্যোগ আসলে কতটা ফলপ্রসূ হবে? সরকারি পাঠাগারে সংরক্ষিত বই সরকারি কর্মকর্তা/ কর্মচারীরা পড়বেন কখন? অফিস বাদ দিয়ে তারা নিশ্চয়ই বই পড়বেন না, পড়া উচিতও হবে না৷ ছুটির দিনে তো অফিস সংলগ্ন পাঠাগারও বন্ধ থাকে৷ আবার খোলা থাকলেও শুধু বই পড়ার জন্য কেউ অফিসে যাবেন তেমনটি ভাবা যায় না৷ ফলে আশংকা থাকে যে, শেষ পর্যন্ত বইগুলো হয়তো অফিস ঘরের চার দেয়ালে সাধারণ শো পিসের মতো শোভা পাবে এবং অপঠিত ও অস্পৃশ্যই থেকে যাবে৷ আর মাঠে মারা যাবে কর্মকর্তা কর্মচারীদের জ্ঞান চর্চা ও পাঠাভ্যাস জোরদার করার এই আয়োজন৷

অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন জনগণের করের টাকায় সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের বই কিনে দিতে হবে কেনো? তাদের পদোন্নতি বা অন্য কোন স্বীকৃতির ক্ষেত্রে পাঠাভ্যাস বা জ্ঞানচর্চাকে গুরুত্ব দিলেও তো চলে৷ পড়ার ইচ্ছা থাকলে নিজেদের বেতনের টাকা দিয়েই তারা বই কিনে পড়তে পারেন, সরকারি কোষাগারের টাকা খরচ করে কেন তাদের জন্য বই কেনা?

এই তালিকা নিয়ে আরেকটি অভিযোগ ছিল তালিকায় সরকারি কর্মকর্তাদের লেখা বইয়ের প্রাধান্য৷ এটা ঠিক যে, সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারিরাও ভাল লেখক হতে পারেন৷ অনেকে হয়েছেনও৷ যদি সত্যিই তারা সাহিত্যগুণসম্পন্ন উন্নতমানের লেখা বা তথ্যসমৃদ্ধ প্রয়োজনীয় গ্রন্থ লেখেন এবং সেসব বই যদি সরকারি ক্রয় তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করা হয় তবে তা নিয়ে হয়তো এত বেশি বিতর্কের অবকাশ থাকত না৷ কিন্তু কোন সরকারি কর্মকর্তা যদি কেবল পদাধিকার বলে সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জন করতে চান এবং অন্যায় সুবিধা নিতে চান তবে তা অবশ্যই নিন্দাযোগ্য৷

এছাড়া দেখা গেছে, ১৪৭৭ টি বইয়ের তালিকায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নামে লেখা বই ছিল ১৬৬ টি৷ ইদানীং এই একটা প্রবণতা হয়েছে, যেনতেন ভাবে বঙ্গবন্ধুর নাম নিয়ে বই প্রকাশ করা৷ জাতির পিতাকে নিয়ে গবেষণামূলক, তথ্য সমৃদ্ধ, বিশ্লেষণধর্মী বই লেখা অবশ্যই দরকার৷ কিন্তু তা না করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেসব বই প্রকাশিত হয় তার বেশির ভাগই চর্বিত চর্বণ ও পুনরাবৃত্তিতে ভরা৷ সরকারকে তুষ্ট করতে বা সরকারি বই ক্রয়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে অনেকে এধরনের কাঁচা হাতের দুর্বল লেখা দিয়ে বই প্রকাশ করে চলেছেন, যা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না৷ কিন্তু আজকাল, এমনকি বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় স্কুল কলেজে, সরকারি অনুষ্ঠানে পুরস্কার হিসেবে দেখা যায় সুযোগসন্ধানীরা ক্রয়তালিকায় এধরনের নিম্নমানের বই ঢুকিয়ে দেয়৷ দেশে এখন এমন অনেক মানুষ দেখা যায় যারা ঠিকমত বাক্যগঠন করতে পারেন না, সাহিত্যের সাম্প্রতিক গতি প্রকৃতি সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই, পূর্বসুরীরা বা সমকালীন লেখকরা কি লিখেছেন তাও পাঠ করেননি, তিনিও হয়তো গোটা কয়েক বই লিখে বসে আছেন৷ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে এধরনের মানহীন বই বিক্রির ধান্ধা ফিকিরেও তারাই বেশি এগিয়ে৷

শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিক
শাহনাজ মুন্নী, সাংবাদিকছবি: privat

অথচ স্কুল কলেজের শিশু কিশোরদের উন্নত, মানবিক ও রুচিশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তাদের হাতে ভালমানের নির্ভুল বই তুলে দেওয়া খুবই জরুরি৷ বিশেষ করে ধ্রুপদী সাহিত্য, গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের রচনা, মনীষীদের জীবনী, মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন ও ইতিহাসভিত্তিক বই তাদের শিক্ষার ভিত্তিকে মজবুত করে৷ পাশাপাশি আনন্দদায়ক. বিনোদনমূলক বই, ছড়া, কবিতা, গল্প, রূপকথা শিশুদের সৃজনশীলতা বিকাশে এবং সুন্দর বাক্যগঠন ও ভাষার মাধুর্য বুঝতে সহায়তা করতে পারে৷

শুরুতেই যেমন বলেছি, সরকারি কর্মচারীদের পাঠাভ্যাস ও জ্ঞান চর্চা বাড়ানোর জন্য নেয়া উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে মহৎ৷ সরকারি টাকা অনেকরকম কাজেই খরচ হয়, ফলে সেই টাকায় বই কেনাতে দোষের কিছু নেই৷ বরং দেশ বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের বই কেনা হোক৷ সাহিত্য, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ভাল বই কেনা হোক৷ তাতে যদি এক শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীর মান উন্নয়ন হয়, তবে সেটাও কম প্রাপ্তি নয়৷

এতসব বিরূপ মন্তব্যের মুখে পড়ে প্রকল্পটি যেন একেবারে বন্ধ হয়ে না যায়্ বরং দ্রুত বাছাই কমিটি করে নতুন তালিকা অনুযায়ী বই কেনা হোক৷ কারণ, ভাল বই যেখানে যেভাবেই থাকুক না কেনো তা আলো ছড়ায়৷ সেই আলোক বিচ্ছুরণে দূর হোক সব অনিয়ম, অন্যায়, অসততা আর দুর্নীতির অন্ধকার৷