1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ফরেনসিক রিপোর্টে প্রশ্নে আরজি করের সিবিআই তদন্ত

২৪ ডিসেম্বর ২০২৪

গত ৯ আগস্ট আরজি করের সেমিনার রুম থেকে উদ্ধার হয় চিকিৎসকের দেহ। হাসপাতালের মধ্যে ধর্ষণ ও খুন করা হয় তাকে। এই ঘটনার তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই। তাদের তদন্ত আগেও বার বার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ বার বিতর্ক অকুস্থল নিয়ে।

https://p.dw.com/p/4oXjS
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের সামনে অবস্থান মঞ্চ
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজছবি: Payel Samanta/DW

সেমিনার রুমে দেহ মেলার পর এমনটাই প্রচারিত হয়েছিল, সেখানেই যৌন নির্যাতনের পর খুন করা হয়েছে তরুণী চিকিৎসককে। রুমের একটি পোডিয়ামের উপর পাতা ম্যাট্রেসে রক্তাক্ত দেহ মিলেছিল। প্রথমে পুলিশ ও পরে সিবিআই তদন্তে এমন কোনো জোরালো সূত্র মেলেনি যাতে বলা যায়, এই রুমের বাইরে কোথাও অপকর্ম ঘটানো হয়েছে।

দেহ উদ্ধারের পর সেখান থেকে বিশদ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। দেহের নমুনার পাশাপাশি যে জায়গায় দেহ পাওয়া যায়, সেখানকার নমুনাও নেয়া হয়। এই নমুনা পাঠানো হয়েছিল কেন্দ্রীয় ফরেনসিক ল্যাবরেটরি বা সিএফএসএলে।

ফরেনসিক থেকে যে রিপোর্ট পাওয়া গিয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে জল্পনার জন্ম হয়েছে। সিবিআইকে পাঠানো রিপোর্টে সিএফএসএলের দাবি, চিকিৎসক পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুন সেমিনার রুমেই হয়েছে, তা নিশ্চিত করে বলার মতো প্রমাণ মেলেনি। বিশেষ করে কারো দ্বারা বলপ্রয়োগ করা হলে ধস্তাধস্তির যে নিদর্শন থাকার কথা ম্যাট্রেসে, সেটা পাওয়া যায়নি।

এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর পুরোনো একটি প্রশ্ন জোরালোভাবে উঠতে শুরু করেছে। তা হলে কি বাইরে কোথাও খুন করে দেহ সেমিনার রুমে রেখে দেয়া হয়েছিল? আদৌ মূল অভিযুক্ত সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায় রুমে ঢুকে এই কাণ্ড ঘটায়নি?

তরুণী খুনের সুবিচারের দাবিতে পথে নামা জুনিয়র চিকিৎসক ও নাগরিক সমাজ থেকে বারবার দাবি করা হয়েছে, এই কাজ একা সঞ্জয় করতে পারে না। যেভাবে চিকিৎসককে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে তা কোনো একজনের কাজ নয়। ফরেনসিক রিপোর্ট সামনে আসার পর আবার সেই তত্ত্ব জোরালো হচ্ছে।

ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্টের সদস্য ডাঃ অনিন্দ্য মণ্ডল ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমরা বারবার বলে আসছি যে, এই ঘটনা একজন মানুষের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। সিবিআইয়ের চার্জশিট দেখে আমরা প্রবল হতাশ হয়েছিলাম। গতকাল ফরেনসিক রিপোর্ট আমাদের সন্দেহকে আরো পোক্ত করেছে। বিশাল পরিকল্পনা করেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কিছু বিষয় সিবিআই জানার পরেও এড়িয়ে যাচ্ছে। চার্জশিটে এ সবের উল্লেখ থাকছে না। তাই সুবিচারের জন্য ধারাবাহিকভাবে আমরা আন্দোলনে আছি।"

সাবেক পুলিশকর্তা ডিডব্লিউকে নজরুল ইসলাম বলেন, "সঞ্জয়ের মতো লোক তরুণী চিকিৎসককে ওভাবে একাই ধর্ষণ, খুন করবে, এটা নিয়ে আগে থেকেই সন্দেহ ছিল। তবে সঞ্জয় যে ধর্ষণকারী, এটা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণিত। তার ডিএনএ পরীক্ষায় সেটা প্রমাণ হয়েছে। কিন্তু সে একাই ধর্ষণ করেছে কি না, বা খুন ও প্রমাণ লোপাটের চেষ্টায় অন্য কেউ জড়িত আছে কি না, সেটা নিয়ে প্রশ্ন প্রথম থেকেই রয়েছে। ফরেনসিক রিপোর্ট সেই প্রশ্নকে বৈধতা দিল।"

সুবিচার চেয়ে রাত দখলের আন্দোলনে নেমেছিলেন শহর থেকে জেলার নারীরা। কলেজ পড়ুয়া থেকে প্রবীণ নাগরিক, সকলেই পথে হেঁটেছিলেন। সেই স্পিরিট বজায় রেখে ছাত্রী বিশাখা সমাদ্দার বলেন

 তার দাবি, "আমরা চাইছি যেন সত্যিটা বেরিয়ে আসে। চার মাসের বেশি সময় ধরে সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে আছে। মানুষকে যেটা বাস্তবে দেখানো হচ্ছে সিবিআই দ্বারা, সেটা ঠিক নয়। আমরা জানতে চাই সে দিন ঠিক কী ঘটেছিল, কারা প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাদের উপযুক্ত শাস্তি চাই।"

তদন্তে অনাস্থা

নিহত চিকিৎসকের অভিভাবক থেকে শুরু করে আন্দোলনকারী কেউই সিবিআই তদন্তে খুশি নন। চার্জশিটে শুধু সঞ্জয়ের নাম থাকায় অসন্তোষের শুরু। সময় মতো সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট জমা দিতে না পারায় আরজি করের সাবেক অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ ও টালা থানার ওসি অভিজিৎ মণ্ডল জামিন পেয়ে যাওয়ায় তুঙ্গে ওঠে ক্ষোভ। এর প্রতিবাদে ফের ধর্মতলায় মঞ্চ তৈরি করে শুরু হয়েছে লাগাতার ধরনা।

‘এই আন্দোলনের সামনে নতজানু হয়ে দাঁড়াতে চাই’

নির্যাতিতার অভিভাবকরা গোড়া থেকেই তদন্ত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, "মেয়ের গায়ের উপর থাকা চাদর বারবার বদলে গিয়েছে। কেউ কি প্রমাণ লোপাট করার জন্য এমনটা করল? প্রথম যখন মেয়ের দেহ দেখলাম, আমাদের মনে হয়েছিল, সাজিয়ে-গুছিয়ে সবটা তৈরি করা হয়েছে।"

ইতিমধ্যেই সিবিআই তদন্তে অনস্থা জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়েছেন নির্যাতিতার বাবা। হাইকোর্ট সিবিআইকে এ ব্যাপারে রিপোর্ট দিতে বলেছে। মঙ্গলবার বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষের এজলাসে এই মামলার শুনানি শুরু হয়েছে। পরবর্তী শুনানি ১৫ জানুয়ারি।

আইনজীবীদের একাংশ আগেও বলেছেন, চিকিৎসক হত্যার পিছনে বৃহত্তর ষড়যন্ত্র আছে। আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউ কে বলেন, "ফরেনসিক রিপোর্ট আসার আগে, বহুদিন থেকেই যে কথা আমি বারবার বলে আসছি, এটা একটা বৃহত্তর ষড়যন্ত্র। আমাদের আশঙ্কা, এই ঘটনা একজনের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। সুতরাং এটা নিয়ে আরো গভীর তদন্ত হওয়া দরকার। আজকে সিএফএসএলের রিপোর্ট আমাদের সেই আশঙ্কাকে প্রমাণিত করেছে। তার ভিত্তিতে সিবিআইকে তদন্ত করে নির্দিষ্ট ভাবে অপরাধীদের খুঁজে বার করতে হবে।"

অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরসের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "সিবিআই যদি সদিচ্ছা প্রকাশ করত, তারা ফরেনসিক রিপোর্ট নিয়ে ঠিকঠাক চার্জশিট জমা দিতে পারত। তাদের ভূমিকা নিয়ে সে জন্যই প্রশ্ন উঠছে।"

চিকিৎসক ও তৃণমূল নেতা শান্তনু সেন বলেন, "৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতা পুলিশ যাকে ধরল, ১০০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও সিবিআই তার থেকে একচুলও এগোতে পারল না। এই সমস্তটাই উত্তর দেয়ার কথা সিবিআইয়ের। আমার কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছে দাবি, হয় তোমরা এর উত্তর দাও, না হলে স্বীকার করে নাও যে তোমরা অকৃতকার্য হয়েছ। রাজ্য সরকারের হাতে এই মামলা তুলে দাও।"

বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কথা অনেকেই বলছেন। নজরুলের ইসলামের মতে, "ফরেনসিক রিপোর্ট দেখাচ্ছে যে, এই কুকর্ম সেমিনার রুমে হয়নি, অন্য কোথাও হয়েছে।ধর্ষণ ও খুন দুটোই অন্যত্র করা হয়ে থাকতে পারে। হাসপাতালে যে দুর্নীতি চক্র চলছিল, এই ঘটনা তাদের ষড়যন্ত্র হতে পারে। নইলে সঞ্জয়ের মতো সিভিক ভলেন্টিয়ার ওভাবে স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারে কীভাবে?"

ইতিমধ্যেই শিয়ালদহ আদালতে ট্রায়াল শুরু হয়েছে এই মামলার। সঞ্জয় রায়কে চিহ্নিত করে সেই ট্রায়াল অনেকটাই এগিয়েছে। এখন এই অকুস্থল নিয়ে ধন্দ থাকলে তাহলে ট্রায়াল কোন পথে এগোবে?

বিকাশরঞ্জন বলেন, "ট্রায়াল নতুন করে আবার শুরু হতে পারে। তদন্তের ক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করে কিছু করা মানে প্রকৃত অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা। ফরেনসিকের যা রিপোর্ট বেরিয়েছে, এটা যদি সত্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে, তাড়াহুড়ো করার মধ্যে দিয়ে তদন্তের মূল উদ্দেশ্য নষ্ট করা হয়েছে। বিশেষ করে সঞ্জয় রায় যখন বারবার বলছে যে সে খুন করেনি। এই রিপোর্টের যা নির্যাস, তার সঙ্গে সঞ্জয়ের বক্তব্যের একটা যোগসূত্র রয়েছে। এটাকে খুঁজে বার করতে হবে।"

তার বক্তব্য, "একটি জায়গায় খুন করে আর এক জায়গায় দেহ ফেলে দিলাম, এই যে একটা ষড়যন্ত্র , এর গোটা জাল সিবিআইকে উদ্ধার করতে হবে। আশা করা যায় নতুন তথ্যের ভিত্তিতে তারা আরো তদন্ত করবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷