1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

প্রশ্ন ফাঁসে, জাতি ফাঁসে

মাহমুদ কমল
১৮ আগস্ট ২০২৩

বিশাল বড় বাসায় একপাশ থেকে আরেকপাশ পেরেশানি হয়ে পায়চারি করছেন মাহমুদা আক্তার৷ আধ ঘণ্টা আগে ফিরেছেন অফিস থেকে৷ শরীর চলছে না কিন্তু এক গাদা কাজ পড়ে আছে ঘরে৷ এসেই তাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷ একই সঙ্গে কেঁদেও যাচ্ছেন৷

https://p.dw.com/p/4VKaE
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ
ছবি: Hossain Shahid

চোখের জলে নিজেই নিজেই বলছেন, সারা জীবনের পরিশ্রম আর স্বপ্ন এক নিমেষে মিশে গেছে ধুলোয়৷  ডাক্তার বানানোর আশায় যে মেয়ের জন্য ধুলো মাখা ঢাকা শহরের দিনরাত এক করে ফেলেছেন৷  সেই মেয়ের মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে৷ চান্স পায়নি৷  কষ্ট পাওয়ারই কথা৷ মেয়ের পড়ালেখায় যেন ক্ষতি না হয় সেজন্য বিসর্জন দিয়েছেন শ্বশুরবাড়ি কিংবা বাপের বাড়ি বেরানো৷ যা টাকা আয় তার পুরোটাই ব্যয় হতো সন্তানের পড়াশোনার পেছনে৷  প্রাইভেট টিউটর, কোচিং, অ্যাসইনমেন্ট, ক্লাস পার্টি মেইনটেইন৷ কত কিছুই করতে হয়েছে৷ স্বপ্ন একটাই মেয়ে ডাক্তার হবে৷ পরিশ্রম হবে স্বার্থক৷  বাবাও কখনও যেকোন চাহিদা অপূর্ণ রাখেননি একই স্বপ্নে৷ মেয়েকে পড়িয়েছেনও হলিক্রসের মতো নামী স্কুলে৷ সেই চতুর্থ শ্রেণী থেকে এইচএসসি পর্যন্ত৷ মেয়েও মায়ের পরিশ্রমের ফল ধরে রাখতে চেষ্টা করেছে আপ্রাণ৷ মেধা তালিকায় প্রথম পাঁচ জনেই ছিল৷  এমন মেয়ের জন্য বুক ভরা আশা রাখতেই পারেন যেকোন বাবা-মা৷  আজ সবই যেন ফিকে হয়ে গেছে৷ দরজা বন্ধ করে অঝোড়ে কেঁদে যাচ্ছে মেয়ে তানজিনাও৷  অ্যানাটমি রুমে আটকে থাকা রঙিন স্বপ্ন যে ভেঙেছে তারও৷ বারবারই শুধু আফসোস করে বলছিল, প্রশ্ন ফাঁস ধ্বংস করে দিল সব৷ তা না হলে সরকারি মেডিকেলে চান্স কেউ ঠেকাতে পারতো না তার৷

ঘটনাটি আমার পরিবারের মধ্যেই৷ মাহমুদা আক্তার সম্পর্কে আমার খালা৷ ২০১৫ সালের ওইদিন আমাদের পরিবারকেও আফসোসের সাগরে ডুবিয়েছিল৷  কারণ মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সবচেয়ে আলোড়ন হয়েছিল ওই বছর৷ হয়েছিল আন্দোলন৷  ফের পরীক্ষার দাবিতে বিষয়টি গড়িয়েছিল হাইকোর্ট পর্যন্তও৷ তখনকার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী প্রয়াত মোহাম্মদ নাসিম বেশ জোর গলায়ই অস্বীকার করেছিলেন প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি৷ পাশেই বসা ছিলেন তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী ও একই মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রী জাহিদ মালেক৷

আজ আট বছর পর এসে বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির তদন্তে বের হয়ে এলো বিশাল সে সত্য৷ শুধু ২০১৫ সালই নয়৷  সিআইডি বলছে, ২০০১ থেকে ২০১৭ সাল এই ১৬ বছরে অন্তত ১০ বার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস করেছে একটি চক্র৷  যাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও মিলেছে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য৷ এই চক্রের বেশিরভাগ মাস্টারমাইন্ড প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক৷ এদের অনেকেই পরিচিতি কোচিং সেন্টারও চালাতেন৷ ফাঁস হতো স্বাস্থ্য শিক্ষা ব্যুরোর প্রেস থেকে৷ সেখানকার মেশিনম্যান সালামের মাধ্যমে৷  তার মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে ২০০৬, ২০০৯, ২০১১, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের প্রশ্ন৷  ফাঁস করা সেই প্রশ্ন তার খালাতো ভাই জসীম বিভিন্ন কোচিং সেন্টার এবং তার নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতো৷  পারস্পরিক যোগসাজশে এই চক্রের সদস্যরা ডেন্টাল ও মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফাঁসকৃত প্রশ্নপত্র ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি করত৷  এভাবে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও শত শত শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন৷
ভাবা যায় জালিয়াতিটা শুরু কোথা থেকে৷ যেখানে গভীর শেকড় হিসেবে ওঠে আসে  স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিবের নামও৷!

সেই অপরাধ চক্রের একজন ডাক্তার সালেহীন শোভন৷  একটি বেসরকারি টেলিভিশনে তিনি সাক্ষাতকারে বলেছেন, ২০০৩ সাল থেকে শুরু হয়েছে এই প্রশ্নফাঁস৷  স্বীকার করেছেন, এটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার মতো অবস্থা৷  অকপটেই বলছিলেন, "আমার প্রফেশনকে আমিই সাইজ করে দিয়েছি৷ ”

এক অর্থে সাইজ তো তিনি গোটা জাতিকেই করে দিয়েছেন৷  চিকিৎসক বানানোর ঘরে ঘরিয়েছেন ঘুণ৷  যাদের হাতে একজন রোগী কিংবা তার স্বজন সঁপে দেয় জীবন৷  তাদের প্রতি ধরিয়েছেন অনাস্থা৷  জাতি কলঙ্কিত হয়েছে প্রকৃত মেধাবীদের অবমূল্যায়ণে৷

ফাঁসকৃত প্রশ্নে ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস-বিডিএস সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেন ৮৩ হাজার শিক্ষার্থী৷  অবিভক্ত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর যে ফল ঘোষণা করেছিল তাতে ভর্তি যোগ্য শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে ৪৮ হাজার ৪৪৮ জন৷ ঠিক কতজন তাদের মেধার মূল্যায়ণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে তা বলা মুশকিল৷ তবে সেই সংখ্যাটা হাজার তো হবেই৷  চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য সিআইডি জানিয়েছে অন্তত দেড় হাজার শিক্ষার্থী তাদের ফাঁস হওয়া প্রশ্নে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন৷ তাদের বেশিরভাগই এরই মধ্যে পাস করে চিকিৎসাও দিচ্ছেন৷ 

২০১৫ সালে মেডিকেলে ভর্তি হতে না পারা এক শিক্ষার্থী আক্ষেপ করেই বলছিলেন, "১৭-১৮ ঘণ্টা পড়াশোনা করে পরীক্ষার জন্য যারা প্রস্তুতি নিয়েছিল, তারা আজ পরাজিত হয়ে গেছে অসৎ লোকের অর্থশক্তির কাছে৷ তাদের স্বপ্নের সঙ্গে করা হয়েছে প্রতারণা৷ তাদের পরিশ্রম বৃথা গেছে৷ ”

কথা যিনি বলছিলেন তিনি নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান৷ এসব আর মনে করতে চান না৷  স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় এখন কি করছেন সেটিও আর জানাতে নারাজ তিনি৷

এরকম আক্ষেপে পোড়া বেশ কয়েকজন মেধাবিকে আমি চিনি৷  কেউ পরবর্তীতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন৷ কয়েকজন পড়েছেন বেসরকারি মেডিকেল কলেজে৷

এসব নিয়ে অন্য চিকিৎসকদেরও কপালেও পড়েছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ৷  প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রভাব নিয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ও শিক্ষক ডা. আশরাফুল হক বলছিলেন, "উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ মাধ্যমিকেই একজন ছাত্রের পথ তৈরি হয়ে যায় যে সে ভবিষ্যতে কি নিয়ে পড়ালেখা করতে পারবে৷  আমাদের দেশে তেমনটা না৷  এখানে ছাত্রদের জন্য রাস্তা খোলা থাকে একেবারে এইচএসসি পর্যন্ত৷ এরপর ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে সে তার গন্তব্য ঠিক করতে পারে৷  তাই ভর্তি পরীক্ষা হয় প্রতিযোগিতামূলক এবং সে কারণে এর মান নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়৷ 

চিকিৎসকদের অর্জিত জ্ঞান ও মান ঠিক আছে কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য বেশিরভাগ দেশ যেখানে প্রতি তিন, চার অথবা পাচ বছর পরপর পরীক্ষার বিধান রেখেছে৷ আমাদের এখানে তা নেই৷ একবার এমবিবিএস পাশ করলেই মিলে যায় সারাজীবনের জন্য রোগী দেখার অনুমতি৷ এই বিষয়টি এখন অনেক চিকিৎসকই সামনে নিয়ে আসছেন৷  কারণ সাম্প্রতিক সময়ে রোগী, ডাক্তার, হাসপাতাল এই তিন পক্ষের মধ্যেই চিকিৎসা পদ্ধতি ও সেবা ব্যবস্থাপনা নিয়ে বেশ বিতর্কও তৈরি হয়েছে৷  কমিশনের আশায় অযথা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অযথা বাড়তি ওষুধ প্রেসক্রাইব করা, ওষুধ কোম্পানি থেকে পাওয়া উপহার গ্রহণ এসব এখন আর গোপন নয়৷  কেনা প্রশ্নে অনৈতিকভাবে পাস করা ডাক্তার যে ক্ষতি পোষাতে এসব কাণ্ড আরও বেশ করে করছেন না তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে৷  তাই একে অন্যকে দোষারোপের মাত্রা কমানো যাচ্ছে না৷ এর ফলে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে৷ ভুগছেন রোগী-ডাক্তার দু'পক্ষই৷

ডা. আশরাফুল হকের তাই পরামর্শ গোড়া থেকেই এসব অসঙ্গতির শক্ত হাতে প্রতিরোধ করতে হবে৷ তিনি মতে, "মেডিকেলের অর্জিত জ্ঞান ও শিক্ষা যেহেতু সরাসরি মানুষের উপর প্রয়োগ করতে হয় তাই এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় যাচাইয়ের প্রয়োজন খুব বেশি৷

ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যদি ফাঁস হয় তাহলে মেধা যাচাইয়ের সুযোগ আর থাকে না৷ ফলে মেধাবীরা পিছিয়ে পরে আর অযোগ্যরা এগিয়ে যায়৷  বিগত একযুগ ধরে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের আত্মহননের সংখ্যা বাড়ছে৷ যার পেছনে পড়ার চাপ এবং সামগ্রিক বিষয়ে হতাশা৷ সারাজীবনের স্বপ্ন থেকে একজন যেভাবে নিজেকে গড়েছে তার সাথে সুযোগ পেয়ে কাজে লাগানো ছাত্রের মাঝে তফাৎ থাকবেই৷ নিজের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে মানুষ তার সর্বোচ্চটাই করে৷ কিন্তু সুযোগ পাওয়া মানুষ সেটা করার মত স্পৃহা পায় না৷

একজন যখন সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাস করার রাস্তা পায় সে প্রতি পরীক্ষাতেই সেই সুযোগ খুঁজে বেড়ায়৷ তাই এটি প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি হয়ে যায়৷ ”

Bangladesch Journalist Mahmud Komol
মাহমুদ কমল, সাংবাদিকছবি: private

"প্রশ্ন ফাঁসের খবর বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নয়, এখন দেশের বাইরেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সেটি জানে৷ বাংলাদেশের মেডিকেল সার্টিফিকেট দেশের বাইরে আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত নয়৷ এর উপর এই ধরনের খবর ভবিষ্যতে বড় নেতিবাচক  প্রভাব ফেলবে সেটি নিশ্চিত৷”

এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ক্ষোভ নিয়েই বলছিলেন, "মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস শুধুমাত্র এ দেশের শিক্ষাখাতের উপর আঘাত, তা নয়৷ এ আঘাত পুরো জাতির ভবিষ্যতের উপর৷ আমাদের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের উপর অন্যদের অভিযোগ; আমরা মেধাহীন, নিস্কর্মা, যারা টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনে৷ কিন্তু এখন আমরা কি দেখছি? সর্বোচ্চ ১২লাখ টাকা থেকে শুরু করে ফেসবুকে ফ্রিতে পাওয়া প্রশ্ন নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের মতো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেশসেরা মেধাবীদের সাথে কিছু নৈতিকতাহীন, বিবেকবর্জিত, উচ্ছন্নে যাওয়া ছাত্র একই কাতারে দাঁড়াতে যাচ্ছে৷ ভাবছি এখন ওইসব ব্যক্তিরা কি বলবেন, যারা এতোদিন আমাদের প্রাইভেট বলে নাক সিঁটকাতেন?”

আমার সেই খালাতো বোন পরে ঢাকার একটি নামকরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছে৷ প্রশ্ন ফাঁসে জড়িতরা গ্রেপ্তারের পর তার এক বাক্যের স্ট্যাটাস, "সারা জীবনের ক্ষত”৷
সত্যিই তো প্রযুক্তির উৎকর্ষতার যুগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এতো দিন ধরে চালানো এই কেলেঙ্কারি এগিয়ে যাওয়া একটি জাতির বুকে বিশাল ক্ষত তো বটেই৷  ফাঁসকৃত বছরে যেসব প্রকৃত মেধাবীরা বঞ্চিত হয়েছেন কিংবা ভাল মেডিকেলে চান্স পাননি৷  তাদের অন্তর যে ক্ষত রয়ে গেছে সেটা কি শুকাবে কখনো?

সাধারণ জনগণের অনেকেই দাবি তুলেছেন প্রশ্ন ফাঁসে এরই মধ্যে যারা ডাক্তার হয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের চিহ্নিত করে নিবন্ধন বাতিল করার জন্য৷ শাস্তির দাবীও তুলেছেন কেউ কেউ৷ যেন ভবিষ্যতে এমনটা করার সাহস কোন শিক্ষার্থীর না হয়৷ কারণ একজন রোগী বা তার স্বজন কিংবা সাধারণ জনগণের পক্ষে তো আর সেবা নেয়ার সময় প্রশ্ন করার সুযোগ নেই যে তার ডাক্তার পাস করেছেন কত সালে? তিনি প্রশ্ন ফাঁসে পাস করা ডাক্তার না বৈধ প্রকৃত মেধায় পাস করা ডাক্তার!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য