প্রথা ভেঙ্গে কলকাতায় দুর্গাপুজোয় এবার চার নারী পুরোহিত
১৪ আগস্ট ২০২১বারোয়ারির ইতিহাসে এমন আগে কখনো হয়নি৷ এর আগে দুর্গাপুজোতে নারীরা আংশিক দায়িত্বে ছিলেন৷ এমনকি নারী পরিচালিত পুজোও হয়েছে৷ কিন্তু অকালবোধন থেকে বিসর্জন অবধি সব কিছুর দায়িত্বে নারীরা কখনও ছিলেন না৷
‘শুভমস্তু’ ও মেয়েরা
নন্দিনী ভৌমিক যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতের অধ্যাপক৷ তাদের সংগঠনের নাম ‘শুভমস্তু'৷ তিনি রুমা, পৌলমী, সেমন্তীর সঙ্গে একত্রে ১২ বছর ধরে বিবাহের পৌরহিত্য করছেন৷ করছেন অন্নপ্রাশনের কাজও৷ সামাজিক অনুষ্ঠান, আচার ইত্যাদি বিষয় নিয়েই পড়াশোনো করেছেন৷ সংস্কৃত ভাষায় পিএইচডি করেছেন৷ প্রাচীন সাহিত্যকে নির্ভর করেই তিনি পুরোহিতের কাজ সম্পন্ন করছেন৷ সঙ্গে জুড়েছেন মন্ত্র ও সঙ্গীতকে৷
কলকাতার বুকে তাঁদের কাজের অভাবনীয় জনপ্রিয়তা দেখে আন্দাজ করা যায়, সমাজও গড্ডালিকা প্রবাহের শেকল ছিঁড়ে বেরোতে চায়৷ নন্দিনী বলেন, ‘‘আমাদের কাজের শেষ নেই৷ এত কাজ, যে অনেককেই না বলে দিতে হয়৷ মানুষ গ্রহণ করছে৷ এটা তারই নিদর্শন৷’’ নন্দিনীর জীবন নিয়ে বড়পর্দায় মুক্তি পেয়েছে ঋতাভরী চক্রবর্তী অভিনীত বাংলা ছবি ‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি'৷ তাতেও সমাজের প্রথা বদলের কথাই বলা হয়েছে৷
নন্দিনী মনে করেন পুরোহিত হওয়ার অধিকার পুরুষের যেমন আছে তেমন নারীরও আছে৷ এমনকি শাস্ত্রেও এ সংক্রান্ত কোন বাধা নেই৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এটা গণতন্ত্রের দেশ৷ কারো কারো অপছন্দ হতেই পারে৷ কিন্তু আমরা আত্মবিশ্বাসী৷ আমরা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কিছু করি না৷ দু তিন বছর ধরেই আমাদের দুর্গাপুজোতেও ডাক এসেছে৷ তখন শুধু সামাজিক অনুষ্ঠান করার কথা ভেবে রাজী হইনি৷’’
চমক নাকি প্রথা বিরোধিতা
২০১৮ সালে কেরালার শবরীমালায় ঋতুমতী নারীর প্রবেশ নিয়ে চলে আইনি লড়াই, তৈরি হয় তুমুল বিতর্ক৷ তার বিপরীতে কলকাতায় নারীদের হাতে এবার দুর্গাপুজোর দায়িত্ব তুলে দিয়েছে ৬৬ পল্লী দুর্গোৎসব কমিটি৷ আগামী ২২ আগস্ট এই দুর্গোৎসবের খুঁটিপুজোয় চার পুরোহিতই উপস্থিত থাকবেন৷ ‘মায়ের হাতে মায়ের আবাহন’ এই স্লোগানে ৭১তম বছরে কি নেহায়েতই চমক নাকি প্রথা ভাঙার দিকে হাঁটতে চাইছেন তারা? পুজো কমিটির প্রদ্যুম্ন মুখোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা প্রথা ভাঙতে চাইছি না বা চমক দিতেও চাইছি না৷ আমরা মেয়েদের পুরোহিত হিসেবে যুক্ত করতে চাইছি৷ আমরা মহিলা বা পুরুষ হিসেবে কোনো বৈষম্য করছি না৷ অন্য কোনো ক্লাবও যদি একই পথে হাঁটে, তাহলেই আমরা সফল৷’’
সময়ের ডাক
একুশ শতকে দাঁড়িয়ে সময়ের গল্প বদলাতে চেয়েছেন নন্দিনীরা৷ শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বারোয়ারি পুজোতে মেয়েদের পৌরহিত্য একটি জয়৷ শাস্ত্রে পুরুষের প্রতি যে পক্ষপাতিত্ব করা হয়েছে, সেটা যদি কিছুটাও নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহলে সেই জয় আরও নৈতিক হয়ে উঠবে৷’’
শাস্ত্রে মেয়েদের মন্ত্রোচ্চারণ বা উপবীত ধারণের অনুমোদন নেই৷ ঋতুমতীদের নিয়েও অনেক ট্যাবু৷ নন্দিনী বলেন, ‘‘ওটা তখনকার সময়ের ইতিহাস৷ আমরা যখন ঋতুমতী হই, তখন অশুচি দূরের কথা, সেটা উৎসবের দিন হওয়া উচিত৷ মাতৃত্ব এত সুন্দর তো ঋতুর জন্যই৷ সুতরাং শুচিতা অন্তরে, দেহে নয়৷’’ নারীরা এখন সর্বত্র উচ্চপদে আসীন৷ ধর্ম, সংস্কারের ক্ষেত্রে বাধা ভাঙার চেষ্টা চলছে৷ ‘শুভমস্তু' যে বিয়েতে পৌরোহিত্য করে, সেখানে কন্যাদান বা কনকাঞ্জলির মতো আচার বাদ রাখা হয়৷ এবার তাদের সংস্কারের পতাকা উড়বে পুজো মণ্ডপে৷