1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘অদক্ষতা বা পক্ষপাতিত্ব বিনা বিচারে জেল খাটার প্রধান কারণ’

সমীর কুমার দে ঢাকা
১৩ আগস্ট ২০২১

জামিন পাওয়া না পাওয়ার বিষয়টি কি শুধুই আইনের নিরিখে নির্ধারণ করা সম্ভব? সব ক্ষেত্রে কি তা হয়? অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক মনে করেন, সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণেই তা সবসময় হয়ে ওঠে না৷

https://p.dw.com/p/3yx7i
ছবি: Mortuza Rashed/DW

ডয়চে ভেলে : জামিন পাওয়ার প্রধান শর্ত কী?

অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক : আমাদের অপরাধগুলো দুই ভাগ করা হয়৷ একটা জামিনযোগ্য, আরেকটা জামিনঅযোগ্য৷ জামিনযোগ্য হলো ছোটখাট অপরাধ, যেগুলোর সাজা সাধারণত দুই-তিন বছরের জেল৷ এই ধরনের মামলায় ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে গেলে জামিন দিয়ে দেয়৷ আর বাকি সব অপরাধ হলো জামিনঅযোগ্য৷ কিন্তু জামিনঅযোগ্য অপরাধেও জামিন হয়৷ পার্থক্য হলো সময় একটু বেশি লাগে৷ তবে এগুলো ঢালাওভাবে বলা মুশকিল৷

অনেকে বড় অপরাধেও জামিন পান, আবার অনেকে ছোট অপরাধেও জামিন পান না৷ এক্ষেত্রে আইনের কোনো ফাঁক আছে ?

যদি সাধারণভাবে আমি বলি, একটা মাঝারি অপরাধ, সেখানে আসামি যদি হয় ১০ জন, ধরেন ছিনতাই করেছে ১০ জন আসামি, অথবা অন্য কোনো মামলায় আসামী মাত্র একজন, সাধারণত একজন হলে জজসাহেবরা জামিন দিতে চান না৷ আর আসামি ১০ জন হলে আমরা দাঁড়িয়ে বলি, এতজন আসামির মধ্যে আমার মক্কেল হয়ত সেখানে ছিলই না, তার কোনো ভূমিকা নেই৷ এতে জামিন পেতে সুবিধা হয়৷ যে কোনো মামলায় প্রথম দুই-তিনজন জামিন পেয়ে গেলে অন্যদেরও জামিন পেতে সুবিধা হয়৷ তবে একাধিক মামলার আসামী হলে জজসাহেবরা সহজে জামিন দিতে চান না৷

আইনজীবীর দূর্বলতার কারণে কি অনেক সময় জামিন আটকে যায়?

যে কোনো পেশায় এমন হতে পারে৷ ধরেন, একজন ছোট ডাক্তার রোগ না বুঝেই ওষুধ দিয়ে দিতে পারে, বড় ডাক্তার হলে আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে হয়ত ব্যবস্থা নেন৷ এটা যে কোনো পেশায় হয়ে থাকে৷

অনেক সময় নামকরা বা খ্যাতিমান আইনজীবী কারো পক্ষে দাঁড়ালে জামিন হয়ে যায়, একই ঘটনায় হয়ত জুনিয়র কোনো আইনজীবী দাঁড়ালে জামিন হয় না৷ কেন? 

নামকরা আইনজীবী দাঁড়ালে বিচারককে কনভিন্স করতে পারেন সহজেই৷ সে যুক্তি দিয়ে তার পক্ষে বলতে পারে, আরো ১০টা মামলার উদাহরণ টানতে পারে৷ জ্ঞানের ব্যাপারটাই বড়৷ বড় আইনজীবী কখন হয়, যখন সে আজেবাজে মামলা নিয়ে দাঁড়ায় না৷ আজেবাজে মানে, যার পক্ষে সে দাঁড়িয়েছে হয়ত তার পক্ষে কোনো যুক্তিই নেই৷ ফলে বড় আইনজীবীরা যখন দাঁড়ান, তখন জজসাহেবরাও বোঝেন এখানে নিশ্চয় আইনগত যুক্তি আছে৷ এই আস্থাটা অর্জন করতে সময় লাগে৷ বড় আইনজীবীরা আগেই মক্কেলকে বলে দেন, এই মামলা করে কোনো লাভ নেই, ফলাফল হবে না৷

জামিনের ক্ষেত্রে আইনজীবী এবং বিচারকের মধ্যে সম্পর্ক কোনো প্রভাব ফেলে?

ফেলার কথা না৷ কখনোই কথা না৷ কখনোই হওয়া উচিত না৷ কাম্যও না৷ প্রভাব যে কখনোই পড়ে না, এটা হয়ত বলা যাবে না৷ আমি এখনও বিশ্বাস করি, এটা খুব কম ক্ষেত্রে হয়৷ ধরেন, আমার চাচাতো ভাই বিচারক, সেখানে গিয়ে যদি আমি জামিন পাই, তাহলে আমার বদনাম হবে৷ তখন সবাই বলবে, উনার আইনে কোনো যুক্তি নেই, কিন্তু চাচাতো ভাই জামিন দিয়ে দিয়েছেন৷ এটা তখন আমাদের পেশাগত জীবনে একটা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ দু'চারটা মামলায় হয়ত জেতা যায়, কিন্তু সুনাম বাড়ে না৷ যে কোনো পেশায় সুনাম তো একটা বিরাট ব্যাপার৷ এটাতে বদনাম হয় বলেই এমন ঘটনা কম হয় বলে আমার বিশ্বাস

আমরা দেখেছি, হত্যা চেষ্টার মামলায় আদালতে না গিয়েও জামিন পেয়েছেন সিকদার গ্রুপের একজন উর্ধ্বতন৷ আবার অনেক ছোট অপরাধেও দীর্ঘদিন ধরে জেল খাটছেন অনেকে৷ এই বৈষম্য কেন?

এটা বৈষম্য না৷ এজাহার যেটা লেখা হয়েছে, সেখানে পুলিশ দুই-চারটা কথা লিখে যদি বলে যে, উনি এই এই কাজ করেছেন সুনির্দিষ্টভাবে, তাহলে একটা বিষয়৷ কিন্তু আমরা দেখি, এগুলো হয় এজাহারের দুর্বলতার কারণে৷ আমি যদি আদালতে দাঁড়িয়ে বলি, আমার মক্কেল কী করেছে, কখন করেছে তার নির্দিষ্ট কোনো বর্ণণা নেই, উনি চুরি করেছেন বললে তো হবে না, উনি কোথায় চুরি করেছেন, কোনদিন, কখন এবং কী- এই চারটা জিনিস থাকতে হবে৷ এখন পুলিশ যদি বলে যে, উনি আনুমানিক ২০ তারিখে চুরি করেছেন, তাহলে তো এজাহারের দুর্বলতা থেকে গেল৷

অ্যাডভোকেট শাহদীন মালিক

প্রভাবশালী বা অর্থশালী হলে কি জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়?

হ্যাঁ, জামিনের একটা শর্ত হলো, সে পলাতক হবে না৷ ধরেন, তার একটা বাড়িঘর আছে, এক জায়গায় ২০/৩০ বছর ধরে আছে, ছেলে-মেয়ে আছে, পেশা আছে, তাহলে ধরে নেওয়া হয় সে পালিয়ে যাবে না৷ আর যার কোনো ঠিকানা নেই, তার পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে৷ প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি হলে ধরে নেওয়া হয় তার পালিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম৷ এই পার্থক্যটা জামিনের ব্যাপারে কাজে দেয়৷ 

নিম্ন আদালতে জামিনের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব কাজ করে কি?

আমাদের নিম্ন আদালতের নিয়ন্ত্রণ এখনো অনেকাংশে আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত৷ নিয়ন্ত্রণ মানে বদলি, পদোন্নতি- এইসব৷ যদিও শেষ পর্যন্ত সুপ্রিমকোর্টের মতামত নিতে হয়, বদলি বা পদোন্নতিতে আইন মন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোলিং অথরিটি আছে৷ এটা সুপ্রিমকোর্টের ক্ষেত্রে নেই৷ কারণ, সুপ্রিমকোর্টের বিচারককে তো কেউ কখনো বদলি করতে পারবে না৷ আমার ধারণা, ওই কারণে হয়ত কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপের কাছে তাদের নতি শিকার করতে হতে পারে

অর্থের বিনিময়ে জামিনের কথাও শোনা যায়৷ এগুলো কি আসলে ঠিক? 

ঠিক-বেঠিক তো বলা যাবে না৷ আমাদের কোন সেক্টরে দুর্নীতি হয় না, এটা তো কেউ হলফ করে বলতে পারবে না৷ হ্যাঁ, বিচারালয়ে নিশ্চয়ই কিছু দুর্নীতি হয়৷ দুর্নীতির অভিযোগে বর্তমানে উচ্চ আদালতে তিনজন বিচারপতি দুই বছর ধরে বিচারকাজ করছেন না৷ হয় না- এটা বলা যাবে না, তবে কতদূর হয় সেটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছে৷

সরকারবিরোধী মতাদর্শের লোকজনের জামিন পেতে কোনো বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হয়?

ধরেন, ধর্মীয় উগ্রবাদ৷ তাদের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বেই নেগেটিভ ইমেজ আছে৷ একটি ডাকাতির মামলা, আরেকটি জঙ্গিবাদের মামলা৷ এই জঙ্গিবাদের তো একটা রাজনৈতিক মতাদর্শ আছে৷ এদের বিরুদ্ধে সারা দুনিয়ায় বিচারের ক্ষেত্রে কঠোর আচরণ করা হয়৷ আমাদের দেশে অনেক রাজনৈতিক কর্মী-নেতার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হয়৷ ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে দেখা যাবে, এইসব মিথ্যা মামলায় হয়ত কিছুদিন জেলেও থাকে৷ কিন্তু দীর্ঘস্থায়ীভাবে জেলে আছে, জামিন পাচ্ছে না, এমনটা খুব কম হবে৷

নারী ও সংখ্যালঘুদের কি জামিন পেতে কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়?

আইনে নারী ও বয়স্কদের বিষয়ে বলা আছে, তাদের সহজেই জামিন দেওয়ার কথা৷ আর সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে ওরকম হয়ত বলা যাবে না৷ আমার ধারণা, আমাদের দেশে সংখ্যালঘুরা অপরাধে অনেক কম জড়ান তুলনামূলকভাবে৷ তাদের সঙ্গে বৈষম্য করা হয়- বলা উচিত হবে না৷ দু-চারটা ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই হয়েছে৷ কিন্তু এর থেকে কোনো উপসংহার টানা যাবে না৷

জামিনের ক্ষেত্রে বৈষম্যগুলো কিভাবে দূর করা যায়?

বলা হয়, আমাদের দেশে মামলা করা অনেক সহজ৷ রাজনৈতিক কারণে হোক বা অন্য কারণে হোক, মামলা করা সহজ৷ আমাদের যে ফৌজদারি মামলা হয়, তার মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই নির্দোষ প্রমানিত হয়৷ এই যে ৮০ ভাগ লোক জামিন পেলো না, কিছুদিন জেল খাটলো, এদের বিরুদ্ধে পুলিশ সাক্ষ্য-প্রমাণ ছাড়াই মামলা করে দিয়েছে৷ ধরেন, আমি কিছুই করিনি, অথচ পুলিশ বললো, ওই খুনে শাহদীন মালিকও জড়িত ছিল, তখন দেখা যাচ্ছে, আমি দুই বছর জেলে থাকলাম, ৫ বছর পর বিচার শেষ হলো, আমি নির্দোষ প্রমাণিত হলাম৷ যে মামলা হচ্ছে, তার মধ্যে কতভাগের দোষ প্রমাণ করা যাচ্ছে সেটা কিন্তু দুনিয়ার বিচারে আমাদের সংখ্যাটা খুবই কম৷ ধর্ষণের মামলায় আমরা জানি, শতকরা ২ শতাংশের বেশি দোষী প্রমাণিত হয় না৷ পুলিশের অদক্ষতা বা পক্ষপাতিত্বই হচ্ছে বিনা বিচারে মানুষের জেল খাটার প্রধান কারণ৷ 

জামিনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা কীভাবে বাড়ানো যায়?

উচ্চ আদালতে যখন আমরা জামিনের শুনানি করি, তখন অন্য আইনজীবীরাও থাকেন, বাদি-বিবাদি পক্ষও থাকেন৷ তার মধ্যে দুই পক্ষের শুনানি হয়৷ তখন বিচারক হ্যাঁ, না কিছু একটা বলে দেন৷ লিখিত অর্ডার হয়ত পরে পাওয়া যায়৷ কিন্তু সবাই শুনানিটা দেখলো৷ আর নিম্ন আদালতে যেটা হয়, শুনানি করার পর আদালত বলেন, আমি কাল সিদ্ধান্ত দেবো৷ শুনানিতে কী হয়েছে সেটা তখন সবাই ভুলে যায়৷ এখন শুনানির সময় সবাই তো শুনছে, তখনই শতভাগ সিদ্ধান্ত দেওয়া হলে অনেকটাই স্বচ্ছতা আসতো৷