1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পুজোয় টাকা দেওয়া মমতার অনৈতিক রাজনীতি

৯ সেপ্টেম্বর ২০২১

একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার কেন পুজোয় টাকা দেবে, ইমামকে ভাতা দেবে? সরকার বাহাদুরের কাছে বিনীত প্রশ্ন।

https://p.dw.com/p/406NS
দুর্গা পুজো
ছবি: Rupak De Chowdhuri/Reuters

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির কাছে দুর্গাপুজো কেবল একটি পুজো নয়। উৎসব। বহু ধর্মের মানুষ এই উৎসবে যোগ দেন। আনন্দ করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দেন। ফলে বৃহৎ অর্থে একে কেবল একটি পুজো বলা যায় না।

শারদোৎসবের সঙ্গে রুজি-রুটিও জুড়ে আছে। কুমোরটুলির প্রতিমা শিল্পী, চন্দননগরের আলোকশিল্পী, দক্ষিণবঙ্গের শোলা শিল্পী, জড়ি শিল্পী, মুর্শিদাবাদের ঢাক-বাদক, উত্তরবঙ্গের প্যান্ডেল শিল্পী, পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত মানুষজন-- সকলেই তাকিয়ে থাকেন শরতের দিকে। পুজোয় তাদের যা রোজগার হয়, তা দিয়ে বছরের অনেকটা সময় সংসার চলে। শারদোৎসব ঘিরে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা বাণিজ্য হয়, এই বিষয়টিও অস্বীকার করা যায় না।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এই বিষয়টিকেই সামনে তুলে ধরেছেন। গত বছর কোভিড এবং লকডাউনের কারণে এই শিল্পীদের রুজি-রুটি যাতে বন্ধ না হয়, তার জন্য বিভিন্ন পুজো কমিটিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন তিনি। এবছরও তার ব্যত্যয় হয়নি। ফের পুজো কমিটিগুলিকে পঞ্চাশ হাজার করে টাকা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। মুখ্যসচিব আরো এক কাঠি এগিয়ে লাইসেন্স ফি বাতিল করে দিয়েছেন এবং বিদ্যুতের খরচ অর্ধেক করে দেওয়ার কথা বলেছেন। প্রশাসনের দাবি, এর ফলে পুজো কমিটিগুলি পুজোর আয়োজন করবে এবং শিল্পীদের রুজি-রুটি হবে।

চমৎকার প্রস্তাব। তবু অর্বাচীনের মতো কিছু প্রশ্ন তুলতে ইচ্ছে করে। এই মুহূর্তে ভারতবর্ষ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। স্বাধীনতার পরে ভারতের সংবিধান যে ধর্মনিরপেক্ষতার অঙ্গীকার করেছিল, গেরুয়া বাহিনীর হাতে তা প্রতিদিন প্রশ্নের মুখে পড়ছে। প্রকাশ্যে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধিতা করে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। এই পরিস্থিতিতে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি যদি দৈনন্দিনের রাজনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা না করে, তাহলে পরিস্থিতি আরো জটিল হবে। হচ্ছেও।

দুর্গাপুজো যতই উৎসব হোক, তার সঙ্গে পুজো জুড়ে আছে। পুজো কমিটিগুলি শৈল্পিক মণ্ডপ বানিয়ে যতই মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করুক, তার ভিতরে পুজো হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সরকার কি কোনো একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এভাবে করের টাকা দান করতে পারে? আদৌ কি এ কাজ সাংবিধানিক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুগামীরা বলবেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার তো ইমামভাতাও দেয়? তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কেন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর কিছু মানুষকে ভাতা দেওয়া হবে? সংবিধানসম্মত নয় বোধ হয় সে কাজও। ইমামরা, পুরোহিতরা গরিব হলে তারা গরিবদের জন্য দেয়া ভাতা পেতে পারেন। বিশেষ করে তাদের চিহ্নিত করে ধর্মীয় ভিত্তিতে কেন ভাতা দেয়া হবে।

আসলে কষ্টের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর অর্থ কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে বা ধর্মীয় শিবিরকে পাইয়ে দেয়া নয়। একেকটি ক্লাবকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়ার জন্য সরকারের মোট যা খরচ হচ্ছে, অনায়াসে সে কাজ কর্মসংস্থানে ব্যবহার করা যেত। যে শিল্পীদের জন্য আজ মন কাঁদছে, সারা বছর ওই অর্থ নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো যেত আরো সাসটেনবল প্রক্রিয়ায়। সরকার টাকা দিলেও পুজো হবে, না দিলেও হবে। সরকার যা-ই ভাবুক, বড় পুজোতে কর্পোরেট বিজ্ঞাপন দেবেই। কর্পোরেট জানে, দুর্গাপুজোর বিজ্ঞাপন তাদের গোটা বছরের ব্যবসা। ফলে সরকার টাকা না দিলেও পুজোর খুব ক্ষতি হতো না। যেটুকু হতো, কোভিডকালে সেটুকু হওয়া প্রয়োজন। কুম্ভ থেকে যেভাবে কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউ গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, দুর্গাপুজো থেকেও সেভাবে তৃতীয় ঢেউ ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই কথাটি মাথায় রাখা দরকার। মনে রাখা দরকার এখনো পশ্চিমবঙ্গে দৈনিক করোনা সংক্রমণ কয়েক হাজার। এখনো মৃত্যু হচ্ছে। পুজোয় সমস্ত মানুষ রাস্তায় নেমে পড়লে, সরকার তা সামলাতে পারবে তো?

সরকার আসলে এত কথা ভাবে না। একটি বিষয়ই তারা বোঝে। কিছু পাইয়ে দেয়ার রাজনীতি। পুজো কমিটিকে পঞ্চাশ হাজার টাকা অনুদান দেওয়া মানে ক্লাবটিকে নিজের হাতে নিয়ে রাখা। ভোটের সময় ওই ক্লাবই শাসকদলের অনুগত সেপাই হয়ে থাকবে। পুজোয় জনসংযোগ হয় বলেই সব কাজ পন্ড করে মন্ত্রীরা পুজো নিয়ে মেতে থাকেন। বিরোধীরা অনুদান দিয়ে পুজো কেনার চেষ্টা করে। গোটাটাই রাজনীতি। ডোলের রাজনীতি। পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি।

বাম আমলে পশ্চিমবঙ্গে ডোলের রাজনীতি হয়নি, এমন নয়। তবে বাম দর্শন অন্তত পুজো থেকে সরকারকে বিযুক্ত করে রেখেছিল। রক্ষা পেয়েছিল সংবিধান। বর্তমান সময়ে, কেন্দ্রের সরকার মন্দির গড়ার এজেন্ডা নিয়ে বসে আছে। কোনো কোনো রাজ্যের সরকার সরাসরি মুসলিমবিরোধী অবস্থান প্রকাশ্যে ঘোষণা করছে। ধর্মনিরপেক্ষতা কোনোমতে কাগজে-কলমে টিকে আছে মাত্র। গেরুয়া শিবির এ কাজ করবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এ তো তাদের ঘোষিত নীতি। কিন্তু বাকিরাও যদি সেই ফাঁদে পা দেন, তাহলে মুশকিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ইমাম ভাতা, পুরোহিত ভাতা, পুজোয় টাকা ঢেলে প্রতিদিন সেই সমস্যা বাড়িয়ে চলেছেন। প্রতিদিন আরো আরো বেশি বেশি করে ফাঁদে পা দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর পারিষদরা সে কথা কি বলছেন মাননীয়াকে?

পুনশ্চ: একজন ধর্মনিরপেক্ষা ব্যক্তি হিসেবে অথবা ভিনধর্মের ব্যক্তি হিসেবে কেউ যদি বলেন, তার দেওয়া করের টাকা কেন পুজোয় ব্যয় হচ্ছে, অথবা ইমামের পিছনে যাচ্ছে, সরকার কি কোনো উত্তর দিতে পারবে? নিতান্তই অর্বাচীনের প্রশ্ন। মাপ করবেন।