শেষ হাসি কে হাসবে?
১৫ এপ্রিল ২০১৪এক বছর আগে হলেও দৃশ্যটা কল্পনা করা যেত না! দার্জিলিংয়ের ম্যালের জনসভায় দাঁড়িয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, পাহাড়ের মানুষের স্বার্থকে পয়সা নিয়ে বিক্রি করে দিয়েছেন বিমল গুরুং৷ আর সেই শুনে উপস্থিত জনতা হই হই করে তাতে সায় জানাচ্ছে! শিলিগুড়ির নিরাপদ দূরত্বে নয়, বিমল গুরুংয়ের খাসতালুক দার্জিলিংয়ে দাঁড়িয়ে মমতা বলছেন, বিমল গুরুং নিজের ছেলে-মেয়েকে বাইরে পড়তে পাঠিয়েছেন৷ আর পাহাড়ে দিনের পর দিন বনধ ডেকে স্কুল-কলেজ বন্ধ রেখে পাহাড়ের ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করছেন৷ শুনে ফের সোচ্চারে সমর্থন জানাচ্ছেন মানুষ৷
দার্জিলিংয়ে মমতা জনসভায় ভালো ভিড় হয়েছিল৷ একইদিনে কার্শিয়াংয়ে ভিড় উপচে পড়ল দার্জিলিংয়ের তৃণমূল প্রার্থী, প্রাক্তন ফুটবলার ও জাতীয় দলের অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়ার সমর্থনে জিএনএলএফ-এর ডাকা জনসভায়৷ অথচ এর আগে দার্জিলিংয়ে বাইচুংয়ের প্রচারসভা পণ্ড করতে যখন তখন বনধ ডেকে দিত বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা৷ আর তারও আগে, খোদ জিএনএলএফ প্রধান এবং বিমল গুরুংয়ের রাজনৈতিক শিক্ষাগুরু সুবাস ঘিসিংয়ের সমতল থেকে পাহাড়ে ওঠা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল মোর্চা৷ সুবাস ঘিসিংয়ের স্ত্রী যখন মারা গিয়েছিলেন, তখন মানবিক কারণেও ঘিসিংকে পাহাড়ে উঠতে দেওয়া হয়নি৷
সেই সর্বশক্তিমান এবং পাহাড়ে যথেচ্ছাচার করার স্বত্বাধিকারী বিমল গুরুংকে মমতা এবং জিএনএলএফ-এর সভার পর রীতিমত কোণঠাসা লেগেছে৷ একাধিপত্য চলে যাচ্ছে, এই দুশ্চিন্তার ছাপ এখন গুরুংয়ের চোখেমুখে৷ কারণ যে অভিযোগগুলো এত দিন পাহাড়ের মানুষের মধ্যে কানাঘুষোয় শোনা যেত, সেই অভিযোগগুলো জোরেশোরে বলে যাচ্ছেন এক বহিরাগত নেত্রী এবং লোকে তাতে হাততালি দিচ্ছে৷ মোর্চার যাবতীয় হুমকি অগ্রাহ্য করে ভিড় বাড়ছে জিএনএলএফ-এর সভায়৷ ভোটের আগে নতুন করে জোট বাঁধছে পাহাড়ে বিমল গুরুংয়ের বিরোধী শক্তিরা৷ মোর্চা সুপ্রিমোর দুশ্চিন্তাই স্বাভাবিক!
পাহাড়ে তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে বাইচুং ভুটিয়াকে দাঁড় করানোটা ছিল বিমল গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার বিরুদ্ধে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম ডাইরেক্ট ফ্রি কিকে গোল৷ সফল ফুটবলার হিসেবে, দার্জিলিং-সিকিমের পাহাড়কে জাতীয় স্তরে গর্বিত করা একজন সফল ভূমিপুত্র হিসেবে বাইচুংয়ের এক ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে৷ সেটা নবীন প্রজন্মের মধ্যে তো অবশ্যই, প্রবীণরাও অনেকে গর্বিত হন ঘরের ছেলে বাইচুংয়ের সাফল্যে৷ কিন্তু এর বাইরেও একটা অঙ্ক আছে৷ ভুটিয়া পদবীধারী কাউকে দাঁড় করানো মানে পাহাড়ের ভোট ভাগ হওয়া৷
বিমল গুরুং যদি বুঝতেন, তা হলে অনেক আগেই সাবধান হতেন, যখন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, বিমল গুরুংরা কেন গোর্খাল্যান্ড চাইছেন! খাসিয়া, ভুটিয়া, লেপচা, ইত্যাদি পাহাড়ের অন্য জনগোষ্ঠী তা হলে কী দোষ করল! মুখ্যমন্ত্রীর সেই বার্তা ছড়িয়ে পড়ার পরই পাহাড়ে তড়িঘড়ি লেপচা উন্নয়ন পর্ষদ তৈরি হল, কিন্তু গুরুং সম্ভবত গুরুত্ব দেননি৷ তার পরেও কিন্তু তৃণমূল নেত্রী চেয়েছিলেন মোর্চার সমর্থন নিয়ে পাহাড়ে তাঁদের প্রার্থী দাঁড় করাতে, কিন্তু তাতেও রাজি হননি বিমল গুরুং৷ এর পর আজ মমতা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সরাসরি বলে এলেন, গুরুং টাকা নিয়ে দার্জিলিং লোকসভা আসনটি বিক্রি করেছেন৷ লোকে খুব অবিশ্বাস সম্ভবত করছে না৷
বিমল গুরুংয়ের বিরুদ্ধে তৃণমূল নেত্রীর পরের গোলটি কর্নার কিক থেকে৷ সুবাস ঘিসিং এবং তাঁর জিএনএলএফ-এর সমর্থন আদায়৷ বিমল গুরুং যতই আধিপত্য কায়েম করে থাকুন না কেন, পাহাড়ে জিএনএলএফ একসময় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক শক্তি ছিল এবং এখনও তাদের বেশ কিছু কর্মী-সমর্থক নিশ্চিত আছেন, যাঁরা এতদিন গুরুং-বাহিনীর চাপে মাথা তুলতে পারছিলেন না৷ এবং নিঃসন্দেহে এমনও অনেকে আছেন, যাঁরা পরিস্থিতি বেগতিক দেখলে শিবির বদলাতে দেরি করবেন না৷ কার্শিয়াংয়ে জিএনএলএফ সভার ব্যাপক জনসমাগম তারই প্রমাণ৷
এছাড়া যেটুকু বাকি ছিল, সেটাও করে এলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী৷ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে বলে এলেন, এতদিন ভোটের নামে পাহাড়ে রিগিং হয়েছে৷ কিন্তু ভয় পাবেন না৷ নির্ভয়ে ভোট দিন, সরকার, প্রশাসন আপনাদের পাশে আছে৷ অর্থাৎ পেনাল্টি কিকের জন্য বলটা বক্সের মাথায় বসিয়ে এসেছেন মমতা৷ ১৭শে এপ্রিল তাতে শট নেবেন ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া!