1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বিচারপতিকে ‘চাপে রেখে’ কাকে ভয় দেখাতে চাইছেন ওই আইনজীবীরা?

গৌতম হোড়
গৌতম হোড়
১৩ জানুয়ারি ২০২৩

যারা স্কুলপর্যায়ে পলিটিক্যাল সায়েন্স বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়েছেন, তারাও জানেন গণতন্ত্রের তিনটি স্তম্ভ হলো, প্রশাসন, আইনসভা ও বিচারবিভাগ৷

https://p.dw.com/p/4M7cP
কলকাতা হাইকোর্ট
ছবি: Subrata Goswami/DW

ভারতে অনেকগুলি রাজ্যে বিধানসভায় হাতাহাতি হয়েছে৷ উত্তরপ্রদেশে তো একসময় সরকার ও বিরোধীপক্ষ একে অপরের দিকে মাইক ছুঁড়ে মারামারি করেছে৷ লখনউয়ে বিধানসভায় যখন এই কাণ্ড হচ্ছে, তখন আমার সেখানে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছিল৷ বিধানসভার সেই চেহারা অপলক চোখে দেখেছি৷ নিরাপত্তারক্ষী ও সহ সাংবাদিকরা জোর করে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে৷ বঙ্কিমি ভাষায় বলতে গেলে, আহা কী দেখিলাম, জন্মজন্মান্তরেও ভুলিব না৷

দুই দশক ধরে লোকসভা কভার করার অভিজ্ঞতাও বলছে, সেখানেও স্লোগান, প্ল্যাকার্ড, প্রায় হাতাহাতিহওয়ার মতো দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়৷ কিছুদিন আগে দিল্লি পুরসভাতেও প্রধান দুই দলের পার্ষদরা মারামারি করেছেন৷

যারা প্রশাসনের মাথায় আছেন, অর্থাৎ মন্ত্রীরা অতীত থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত হামেশা এমন কথা বলছেন, যা নিয়ে ঘোর বিতর্ক হয়েছে৷ এমনকি আমলা, পুলিশ কর্তারাও মাঝেমধ্য়ে এমন সব কথা বলেন, এমন কাজ করেন, যা দেখে কেউ যদি শিউরে ওঠেন, তাহলে তাকে দোষ দেয়া যায় না৷ এই তো কিছুদিন আগে করোনার সময় সব বন্ধ৷ স্কুল, কলেজ, অফিস, সুইমিং পুল, জিম, সিনেমা হল--সব বন্ধ, কিন্তু খোলা গঙ্গাসাগর, কুম্ভ মেলা!

এর বাইরে রাজনীতির দিকে চোখ রাখুন৷ আন্দোলন মানেই ধ্বংসাত্মক৷ মারামারি, লাঠি, গুলি, বাস পুড়বে, ট্রেন জ্বলবে, রাস্তা অবরোধ হবে৷ পারিবারিক স্তরে বাবা মেয়েকে, স্ত্রীকে মারছে৷ প্রেমিক প্রেমিকাকে মেরে তার দেহ টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে দিচ্ছে দিল্লি জুড়ে৷ রাস্তা ও রেল অবরোধ এখন আন্দোলনের অঙ্গ৷ কিছু মানুষ এক হয়ে তাণ্ডব চালাচ্ছে, এমন উদাহরণ প্রচুর৷

দুই স্তম্ভের অবস্থা যদি এরকম হয়, সমাজের চেহারা যদি এরকম হয়, প্রতি পদে যদি অসহিষ্ণুতা দেখা দেয়, তাহলে বিচারবিভাগও কি আর বাদ থাকতে পারে? পারে না৷ সেই আন্দোলনের ঠেলা গিয়ে আছড়ে পড়বে সেখানেও৷ সেই কিছু মানুষ একজোট হয়ে তাণ্ডব করবেন, অন্যদের বিচারপতির ঘরে যেতে দেবেন না, বিচারপতিকে বয়কট করা হবে, এ সবই আমাদের দেখতে হচ্ছে, হয়ত আরো হবে৷

কিন্তু এই স্বাভাবিক ছবিটা দেখে আমাদের অস্বাভাবিক ভয় হয়৷ ঘরপোড়া গরু তো সবসময় সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাই৷ এই ঘেরাও তো আমরা কতরূপে দেখলাম৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ঘেরাও, কলেজে প্রিন্সিপাল ঘেরাও, নবান্ন ঘেরাও, রাইটার্স ঘেরাও৷ তাই বড় ভয় লাগে৷ এই ঘেরাও, বয়কট, অবরোধ কেন করা হয়? খুব স্বাভাবিক একটা কারণ হলো, নিজেদের জোর দেখানো বা যাকে বলে শক্তি জাহির করা৷ কেন এই শক্তি জাহির করতে হয়? এর জবাব হলো, কথা কিছু কিছু, বুঝে নিতে হয়, সে তো মুখে বলা যায় না৷

যে ঘটনা নিয়ে এত কথা বলতে হচ্ছে, সেটা হলো, সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মান্থার আদালতের বাইরে তার ছবি দিয়ে পোস্টার পড়ে৷ তাতে বিচারপতি মান্থার ছবি-সহ বলা হয়, বিচারব্যবস্থার কলঙ্ক৷ প্রশ্ন তোলা হয়েছে, কোথায় বিচার মিলবে? আদালতের পাশাপাশি তার বাসভবনের সামনেও একইরকম পোস্টার মারা হয়েছে৷ তার আদালতে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে৷ বলা হয়েছে, আইনজীবীদের একাংশ বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷

কারা বিচারপতি মান্থার আদালত বয়কট করলো? আনন্দবাজারের রিপোর্ট তুলে দিচ্ছি, ‘‘বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার এজলাস বয়কটকে ঘিরে আইনজীবীদের মধ্যে যে সংঘাত, তা শেষমেশ গড়াল হাতাহাতিতে৷ কলকাতা হাইকোর্টের ১৩ নম্বর আদালতকক্ষ বন্ধ থাকা নিয়ে প্রতিবাদ জানান আইনজীবীদের একাংশ৷ তাঁরা জোর করে এজলাসে ঢুকতে গেলে বাধা দেন তৃণমূলপন্থী আইনজীবীরা৷ দু'পক্ষের মধ্যে শুরু হয়ে যায় ধস্তাধস্তি, হাতাহাতি৷ তৃণমূলের মহিলা আইনজীবীদের একাংশ এজলাসের গেট বন্ধ করে দেন৷’’ (৯ জানুয়ারি, হাইকোর্টে হাতাহাতি! মান্থার এজলাস বয়কট, বেনামি পোস্টার পড়ল বিচারপতির বিরুদ্ধে, আনন্দবাজার ডিজিটাল)৷ এই রিপোর্ট বলছে, তৃণমূলপন্থি আইনজীবীরা এই বয়কট করেছিলেন৷

কেন করেছিলেন? বেনামি পোস্টারে যা বলা হয়েছে, তা মেনে নিলে, তারা বিচার পাচ্ছেন না৷ এরপরের প্রশ্ন হলো, বিচার মানে কী? বিচার মানে কি রায় সবসময় ক্ষমতাসীন দল বা সরকারের পক্ষে যাবে? তা কি কখনো হয়, নাকি, হতে পারে! রায় আমার পক্ষে গেলে বিচারবিভাগ ভালো, বিচারপতি ভালো, আর বিপক্ষে গেলে খারাপ? তখন বিচার পাওয়া যাচ্ছে না? বিচারের মধ্যে যদি সংখ্য়াগরিষ্ঠ দলের রাজনীতি ঢুকে যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের প্রভাব কাজ করতে থাকে, তাহলে তৃতীয় স্তম্ভের আর কি বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে! এখনো দেশের মানুষের অগাধ বিশ্বাস আছে বিচারবিভাগের উপর৷ দয়া করে তা এভাবে ভেঙে দেবেন না৷

এবার হিন্দুস্তান টাইমস বাংলার রিপোর্টের একটা অংশ তুলে ধরতে চাই৷ ‘‘বিচারপতি রাজশেখর মান্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সোমবার তাঁর এজলাস বয়কটের ডাক দেন কিছু আইনজীবী৷ কেন বারবার বিচারপতি মান্থা শুভেন্দু অধিকারীর পক্ষে ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিপক্ষে রায় দিচ্ছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁরা৷’’ এবার ক্ষোভের কারণ বোঝা গেল৷ এবার বিচারের আরেকটা মৌলিক তথ্য মনে করিয়ে দেয়া দরকার৷ বিচার কীভাবে হয়? অবশ্যই সাক্ষ্য, প্রমাণ ও আইনের ভিত্তিতে৷ সেখানে একজনের রায় পছন্দ না হলে বৃহত্তর বেঞ্চে আবেদনের সুযোগ আছে৷ হাইকোর্টের রায় ঠিক বলে মনে না হলে সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের সুযোগ আছে৷ সেসব না করে শক্তি দেখিয়ে আদালত বয়কট করতে চাইলে কোন বার্তা যায়?

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

কলকাতা হাইকোর্টে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিচারপতির নাম হলো অভিজিৎ গঙ্গেপাধ্যায়, যার একের পর এক রায়ের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর দুর্নীতি সামনে এসেছে৷ আমরা জানতে পেরেছি, সাদা খাতা জমা দিয়েও শিক্ষকের চাকরি পেয়েছেন অনেকে৷ মেধাতালিকায় নাম তলায় থাকলেও চাকরি হয়ে গেছে৷ আর যাদের টপকে চাকরি হয়েছে তারা এই শীতেও রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন৷ সেই বিচারপতি গঙ্গেপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘পৃথিবীশুদ্ধু সবাই দেখতে পাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে বিচারব্যবস্থাকে সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে৷ আইনজীবীদের একটা অংশ বিচারপতি ও জেলা আদালতের বিচারকদের সন্ত্রস্ত করে নিজেদের পথে আনতে চাইছেন৷ তবে গতকাল প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায় একটা যুক্তিপূর্ণ কথা বলেছেন, আমাদের বিচারব্যবস্থা এত ঠুনকো নয় যে কেউ চাইলেই সন্ত্রস্ত করতে পারবে৷ এটা সম্ভব নয়৷ যারা ভাবছেন তারা ভুল ভাবছেন৷’’ (হিন্দুস্তান টাইমস বাংলা)৷ তবে এক প্রশ্নের জাবে তিনি বলেছেন, ‘‘আমি শুনেছি শাসকদল বলেছে আমরা এরকম কিছু করিনি৷ কিন্তু যারা করেছেন তাদের আমরা চিনি, আদের আমরা জানি৷ এরা আগেও করেছেন৷ কী উদ্দেশ্য নিয়ে করেছেন সেটা তদন্তসাপেক্ষ৷'' প্রধান বিচারপতি তো জানিয়ে দিয়েছিলেন, সিসিটিভি ফুটেজ থেকে তিনি আইনজীবীদের চিহ্নিত করবেন৷

বিচারপতির বিরুদ্ধে আইনজীবীদের একাংশের আন্দোলন শুরু হয়েছিল সোমবার৷ বুধবারই তারা সেই আন্দোলনে ইতি টেনে আবার বিচারপতি মান্থার আদালতে যাওয়া শুরু করেছেন৷ আমরা জানি, সব ভালো যার শেষ ভালো৷ কিন্তু বড় ভয় করে৷ সর্বগ্রাসী রাজনীতি যদি এভাবে বিচারবিভাগকেও গ্রাস করে ফেলতে চায়, তাহলে কতদিন তা রোধ করা যাবে৷ আমরা তো এর আগে শুনেছি, 'লালা, তুই বাংলা ছেড়ে পালা'৷ বিচারপতি লালার বিরুদ্ধে এই স্লোগান এসেছিল রাজ্যে সেসময়ের ক্ষমতাসীন বামেদের এক শীর্ষ নেতার মুখ থেকে৷ আমরা তো দেখছি, বিচারপতি বা প্রধান বিচারপতি থাকার পরও কেউ কেউ রাজ্যসভার সদস্য হয়ে যান৷  আমরা তো দেখেছি, কিছুদিন আগে প্রাতঃভ্রমণ করার সময় এক বিচারপতিকে ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায় একটা গাড়ি৷ ইউপিএ আমলে বিজেপি নেতারা অভিযোগ করতেন, ইমপিচমেন্টের জুজু দেখিয়ে কংগ্রেস বিচারপতিদের ভয় দেখাচ্ছে, প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে৷ এখন কংগ্রেস নিয়মিত অভিযোগ করে, কেন্দ্রীয় সরকার বিচারপতিদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে৷ এ কি শুধুই রাজনৈতিক অভিযোগ, বিরোধী হলেই যা করে থাকে রাজনৈতিক দলগুলি? না কি তার বেশি কিছু?

আমাদের ভয় করে, একটা চিন্তা থাকে, থেকেই যায়৷