1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
স্বাস্থ্যভারত

পশ্চিমবঙ্গে বার্ড ফ্লু আতঙ্ক, সতর্ক থাকার পরামর্শ

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৮ জুন ২০২৪

পাঁচ বছর পর ভারতীয়ের দেহে মিলেছে বার্ড ফ্লু ভাইরাস। পশ্চিমবঙ্গের আক্রান্ত সেই শিশু এখন সুস্থ রয়েছে। কিন্তু এতে কি আর এক মহামারির সিঁদুরে মেঘ দেখা যাচ্ছে?

https://p.dw.com/p/4hBrR
পশ্চিমবঙ্গের হাঁসপুকুড়িয়া গ্রামে একটি হাঁসের খামারের ছবি।
হাঁস-মুরগির খামার থেকে বার্ড ফ্লু ছড়াবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ছবি: Soumyabrata Roy/NurPhoto/picture alliance

আর একবার ভারতে মানুষের শরীরে বার্ড ফ্লু ভাইরাস ধরা পড়েছে সম্প্রতি। ২০১৯ সালের পর প্রথমবার। আক্রান্ত পশ্চিমবঙ্গের মালদহের এক শিশু। এতে বার্ড ফ্লুর আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যদিও মালদহের সংশ্লিষ্ট এলাকা বা রাজ্যের অন্য কোথাও এখনও মুরগির শরীরে বার্ড ফ্লুর চিহ্ন মেলেনি। 

ভারতে বার্ড ফ্লু

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে চার বছর বয়সি শিশুর শরীরে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের রিপোর্ট অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে এই শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

সিদ্ধার্থ জোয়ারদার: মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর আশঙ্কা কম

প্রবল শ্বাসকষ্ট, জ্বর এবং পেটে ব্যথার কারণে শিশুকে স্থানীয় হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে রাখা হয়েছিল। মাস তিনেক পর শিশুটি সুস্থ হয়ে ওঠে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। যদিও এখনো তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা রয়েছে।

সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, শিশুর বাড়ি বা তার আশপাশে হাঁস-মুরগির খামার ছিল। এরই সংস্পর্শে এসেই খুব সম্ভবত অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সে। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটাও বলেছে, অসুস্থ শিশুটির পরিবারের সদস্য বা প্রতিবেশী কারো মধ্যে জ্বর ও শ্বাসকষ্টের লক্ষণ দেখা যায়নি।

এই নিয়ে ভারতে দ্বিতীয়বার মানবদেহে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা গেল। এর আগে প্রথমবার ২০১৯ সালে এক ভারতীয়র শরীরে এই সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল।

এর জেরেই ছড়িয়েছে বার্ড ফ্লু আতঙ্ক। ভয় কাটাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয় রাজ্য সরকার। স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণস্বরূপ নিগম জানিয়েছেন, মালদহের শিশুটি সুস্থ রয়েছে। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মালদহের ওই এলাকা বা রাজ্যের অন্য কোথাও এখনও মুরগির শরীরে বার্ড ফ্লুর ভাইরাস মেলেনি। 

শিশুটি কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রাণী সম্পদ উন্নয়ন দপ্তর বিভিন্ন এলাকার মুরগির নমুনা পরীক্ষা করছে ল্যাবরেটরিতে। তাতে বার্ড ফ্লুর ভাইরাস পাওয়া যায়নি।

সরেজমিন অনুসন্ধান

কোনো পাখির শরীর থেকে মালদহের আক্রান্ত শিশুর দেহে এই ভাইরাস এসেছে বলে প্রাথমিকভাবে অনুমান করা হয়েছিল। এমন ইঙ্গিত ছিল সংবাদ সংস্থার রিপোর্ট। তাতেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বিষয়টি সরেজমিনে অনুসন্ধান করতে এলাকায় যায় সরকারি প্রতিনিধি দল।

মালদহের গ্রামের বাড়িতেই রয়েছে শিশুটি। চিকিৎসক দীপঙ্কর মাঝি, দীনেশ বিশ্বাস প্রমুখ তার বাড়ি যান। সঙ্গে ছিলেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধিও।

মোটের উপর বিপদ থেকে মুক্ত হলেও নিয়মিত শ্বাসকষ্টের সমস্যা হচ্ছে শিশুটির। তাকে প্রতিদিন অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। অক্সিজেনের চাহিদা মেটানোর জন্য ব্লক হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন কনসেন্ট্রেটর মেশিন শিশুর পরিবারকে দেয়া হয়েছে।

যদিও সরকারি দলটি গ্রামে গিয়ে দেখে, শিশুর বাড়ির আশেপাশে কোনও হাঁস-মুরগির খামার নেই। তার বাড়িতেও হাঁস-মুরগি পালন করা হয় না। সেক্ষেত্রে কীভাবে শিশুটি বার্ড ফ্লুতে সংক্রমিত হয়েছিল, তার উত্তর খুঁজছেন আধিকারিকরা। 

শিশুটি আক্রান্ত হয়েছিল মাস চারেক আগে। ভবিষ্যতে যাতে অন্য কারো আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা না থাকে, সেজন্য নজরদারি চালাচ্ছে স্বাস্থ্য দপ্তর।

অন্য কোনো শিশু?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সরেজমিন অনুসন্ধানের তথ্য মেলেনি। এর ফলে সংশয় জন্মেছে, মালদহের শিশুর কথাই কি বলেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি!

তাদের সাম্প্রতিক রিপোর্টে দাবি করা হয়ে, কলকাতা থেকে ঘুরে যাওয়া এক শিশু অস্ট্রেলিয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল বার্ড ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়ে। জিন সিকোয়েন্সিং করে জানা যায়, ভাইরাসটি এইচ৫এন১-এর সাবটাইপ।

১ মার্চ কলকাতা থেকে সেই শিশুটি অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গিয়েছিল। ২ মার্চ সে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ২২ মে তাকে সুস্থ অবস্থায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক দাবি এই ঘটনা নিয়ে নাকি মালদহের শিশুটির ব্যাপারে, এই ধন্দ রয়ে গিয়েছে।

এলাকার ফারাক থাকলেও সময় মোটামুটি একই হওয়ায় সংশয় বেড়েছে। যদিও সেজন্য সতর্কতায় ফাঁক রাখতে চাইছে না স্বাস্থ্য দপ্তর।

মার্কিন গবেষকের দাবি

আমেরিকার সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানিয়েছে, একবার এই ভাইরাস যদি পাখি থেকে মানুষের দেহে ঢুকতে শুরু করে, পরবর্তী ক্ষেত্রে মানুষ থেকে মানুষের সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায়, তাহলে তা মহামারির চেহারা নিতে পারে।

গত মাসে মার্কিন মুলুকে তৃতীয় বার্ড ফ্লু আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলে। খামারের একজন কর্মী আক্রান্ত হন। বিশ্বজুড়ে চিকিৎসকরা বার্ড ফ্লু-র ভাইরাসে আক্রান্ত ১৫ জনকে চিহ্নিত করেছেন। 

এর পরিপ্রেক্ষিতে সিডিসির সাবেক ডিরেক্টর রবার্ট রেডফিল্ট দাবি করেছেন, করোনা উত্তর পৃথিবীতে পরের মহামারি হিসেবে আসতে চলেছে বার্ড ফ্লু। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেড়েছে বার্ড ফ্লুর প্রকোপ। 

সাক্ষাৎকারে রবার্ট বলেছেন, কোভিডের তুলনায় বার্ড ফ্লু হবে আরও মারাত্মক। এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করলেই বাড়বে মৃত্যুহার।কোভিডে মৃত্যুর হার ছিল শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ। সেখানে বার্ড ফ্লুতে মৃত্যুহার ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।"

বিশেষজ্ঞের মত

বার্ড ফ্লু নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এই ভাইরাসের মারণ ক্ষমতা কম। মানুষের দেহে সংক্রমনের সম্ভাবনাও সীমিত। 

ভাইরোলজিস্ট, অধ্যাপক সিদ্ধার্থ জোয়ারদার বলেন, "কিছু কিছু সময় আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ ভাইরাস, যা পাখিকে সংক্রমিত করে, তা জিন মিউটেশনের জন্য মানুষের দেহে চলে আসতে পারে। চারিত্রিক ভোল বদল করে প্রজাতিগত বাধা অতিক্রম করে এই ভাইরাস। সুখের কথা এটাই, মানুষ থেকে মানুষের দেহে ছড়ানোর আশঙ্কা কম থাকে।" 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে বার্ড ফ্লু ছড়ানোর প্রবণতা থাকে। এখানে খামার করে হাঁস মুরগির প্রতিপালন বড় জীবিকা। এই ধরনের প্রাণিজ সম্পদের চাহিদা চিনেও যথেষ্ট। এই দেশগুলিতে খামার প্রতিপালকদের মধ্যে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। তবে তখনই এটা হয়, যখন জিন চরিত্র বদলে ফেলে।

অধ্যাপক জোয়ারদার বলেন, "ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়ায় পাখি থেকে মানুষের শরীরে ভাইরাস আসতে পারে। সেখানে প্রচুর মুরগি চাষ হয়। খামারের প্রতিপালকের দেহে ভাইরাস আসে নিবিড় সংযোগের জন্য, তারা খামারে থেকে মুরগি, হাঁসের দেখভাল করেন। সাধারণ মানুষের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা কম। আমাদের দেশেও ভয় তেমন নেই।"

এই ভাইরাস শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে খামার প্রতিপালকের দেহে আসে। হাঁস, মুরগি খেয়ে সংক্রামিত হওয়ার ভয় নেই বললেই চলে। যেহেতু মাংস বা ডিম উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না বা সিদ্ধ করে খাওয়া হয়, সেক্ষেত্রে ভাইরাস মরে যায়। দুই একটি ঘটনা দেখে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে অর্ধ সিদ্ধ ডিম বা মাংস না খাওয়ার কথা বলছেন তারা।