পশ্চিমবঙ্গে একশ দিনের কাজে দুর্নীতি নিয়ে ইডি তল্লাশি
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বকেয়া টাকার দাবিতে কলকাতায় তৃণমূলের বিক্ষোভ চলছে। এরই মধ্যে তল্লাশি শুরু করলো এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট।
দিকে দিকে অভিযান
আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে চারটি জেলার ছয়টি জায়গায় হানা দেয় কেন্দ্রীয় সংস্থা। কলকাতা, হুগলি, মুর্শিদাবাদ ও ঝাড়গ্রামে আলাদা আলাদা দলে হানা দেন আধিকারিকরা। সঙ্গে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী।
মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে এক পঞ্চায়েত কর্মীর বাড়িতে সকালে পৌঁছে যায় ইডি। অভিযুক্ত রথীন দে নওদার পঞ্চায়েতে কাজ করেন। অভিযোগ, একশ দিনের কাজের দুর্নীতিতে তিনি যুক্ত।
নওদা ও বেলডাঙার বিডিও রথীনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন। তার বিরুদ্ধে একাধিক এফআইআর হয়। এজন্য রথীনকে জেল খাটতে হয়। এখন তিনি সাসপেন্ড রয়েছেন।
অভিযোগ, যারা একশ দিনের কাজ করেননি, তাদের নামে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট খুলে প্রকল্পের টাকা দেয়া হয়েছে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি নথি খতিয়ে দেখে ইডি।
এই দুর্নীতিতে সরকারি আধিকারিকদের একাংশ যুক্ত রয়েছেন বলে দাবি কেন্দ্রীয় সংস্থার। হুগলির ধনিয়াখালির বিডিও সঞ্চয়ন পানের দুটো ফ্ল্যাটেও অভিযান চালায় তারা।
সল্টলেক সেক্টর ওয়ানের ইবি ব্লকের একটি আবাসনের ফ্ল্যাটে পৌঁছে যান আধিকারিকরা। এখানেই থাকেন সঞ্চয়ন। আর কোন আধিকারিক রয়েছেন সন্দেহের বৃত্তে, তা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা।
ঝাড়গ্রামে রাজ্যের এক উচ্চপদস্থ আধিকারিকের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে ইডি। এই ডব্লুবিসিএস অফিসারের নাম শুভ্রাংশু মণ্ডল। তিনি জেলার সংখ্যালঘু দপ্তরে কাজ করেন।
ঝাড়গ্রাম শহরের বাছুরডোবা এলাকায় সরকারি আবাসনে থাকেন শুভ্রাংশু। একশ দিনের কাজে জাতিগত শংসাপত্র নিয়েও কারচুপির অভিযোগ রয়েছে, সেই সূত্রে এই হানা।
হুগলির চন্দননগরে সন্দীপ সাধুখাঁর বাড়িতে অভিযান চালায় ইডি। সন্দীপ খানাকুলের পঞ্চায়েতে নির্মাণ সহায়কের পদে রয়েছেন। এর আগে ধনিয়াখালির নির্মাণ সহায়কের পদে ছিলেন।
তার বাড়ি খুঁজতে গিয়ে নাম বিভ্রাটে এক ব্যবসায়ী বাড়িতে পৌঁছে যান আধিকারিকরা। ভুল বুঝতে পেরে তারা সঠিক গন্তব্যে রওনা দেন।
রাজনৈতিক চাপানউতোর
একশ দিনের কাজে দুর্নীতির অভিযোগে এই প্রথম কোমর বেধে তদন্তে নামল ইডি। রাজ্য পুলিশ-প্রশাসনের দায়ের করা অভিযোগের সূত্রে এই তদন্ত।
এর আগে নিয়োগ থেকে রেশন দুর্নীতি, গরু কিংবা কয়লা পাচার মামলার তদন্তে কেন্দ্রীয় সংস্থা দিকে দিকে তল্লাশি চালিয়েছে। কিন্তু হঠাৎই গ্রামীণ কর্ম নিশ্চয়তা প্রকল্প ঘিরে এদিনের অভিযান, যাকে 'চক্রান্ত' বলছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস।
সোমবার দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কী বিষয়ে কথা হয়েছে, সে কথা গোপন রেখে তিনি ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করেন। দ্রুত পদক্ষেপের হুঁশিয়ারি দেন।
এই সূত্র ধরে রাজ্যের মন্ত্রী শশী পাঁজা আজ অভিযোগ করেন, ''উনি দিল্লিতে গিয়ে কথা বলে এলেন, তারপরে এখানে ইডি নেমে গেল। এভাবে বিরোধীদের হেনস্থা করা হচ্ছে। পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত।''
কংগ্রেস মুখপাত্র সৌম্য আইচ রায়ের বক্তব্য, ''দুর্নীতি হয়েছে সেটা সবাই জানে। ইডি, সিবিআই কবে থেকেই তো অভিযান চালাচ্ছে! কিন্তু কেন মাথাদের ধরছে না?''
তথ্যের লড়াই
কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ কীভাবে রাজ্য খরচ করছে, তার হিসেবনিকাশ নিয়মিত দিল্লিতে পাঠাতে হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি সিএজি রিপোর্ট নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের মধ্যে বাগযুদ্ধ শুরু হয়েছে।
তৃণমূলের ধরনা মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন চলতি মাসেই ২১ লক্ষ শ্রমিককে একশ দিনের কাজের টাকা মেটাবে রাজ্য সরকারই। আবার গতকাল সংসদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধীদের দুর্নীতির প্রশ্নে আক্রমণ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গে টাকা উদ্ধারের প্রসঙ্গ টেনে আনেন তিনি।
বিজেপির অভিযোগ, বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের টাকা নয়ছয় করা হয়েছে। দুর্নীতির অঙ্ক প্রায় দুই লক্ষ কোটি টাকা। বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের অভিযোগ, ''এই টাকা গরিব মানুষ পাননি। টাকা আত্মসাৎ করেছেন তৃণমূলের নেতারা।'' বিরোধী দলনেতা কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সঙ্গে দেখা করে তদন্ত দাবি করেছেন।
রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলেন, ''২০০৩ সাল থেকে কেন্দ্রীয় অর্থের ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট-এর কথা বলা হচ্ছে। ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে। তারপর থেকে সব খরচের হিসেব কেন্দ্রকে দেয়া হয়েছে। তাও গরিব মানুষের টাকা ওরা আটকে রাখছে।''
বিরোধী দলনেতা জানিয়েছেন, ৯ ফেব্রুয়ারি তারা রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সিএজি রিপোর্ট নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন। তার দাবি, রাজ্য মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা যেতে পারে রাজ্যপালের সুপারিশের ভিত্তিতে।
সিএজি রিপোর্ট নিয়ে আজ কলকাতা হাইকোর্টে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি চলবে আইনি যুদ্ধও।
একশ দিনের কাজ দেশের মানুষের আইনি অধিকার। প্রশ্ন উঠছে, এত বিতর্ক থাকলে রাজ্য কেন আইনি পথে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে না? একইসঙ্গে দুই সরকারের টানাপোড়েনে কেন সাধারণ মানুষ কাজ ও উপার্জন থেকে বঞ্চিত হবেন, সেই প্রশ্নও উঠছে।
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, ''দুই পক্ষই বিষয়টিকে রাজনৈতিকভাবে হাতিয়ার করতে চাইছে। এক পক্ষ বলছে এটা গরিব মানুষের বঞ্চনা। অন্য পক্ষের দাবি, বঞ্চনা নয়, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে বিজেপি বোঝাতে চাইছে, ভারতে বিরোধীরা শুধু দুর্নীতিতে যুক্ত, তারা নয়।''