পরিসংখ্যানের ভুলেও লুকিয়ে বিপদ
৮ মে ২০২০করোনা সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করার সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গে প্রকৃত তথ্য, পরিসংখ্যান গোপন করার অভিযোগ উঠেছিল রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং নাগরিক সমাজের এক বড় অংশের সমালোচনায় কার্যত কোণঠাসা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তখন এসওএস পাঠান নির্বাচন কৌশলী প্রশান্ত কিশোর–কে। কারণ, তখন শোনা যাচ্ছে, রাজ্য প্রশাসনেরও এক অংশ ক্রমশ বেঁকে বসছেন, দিনের পর দিন খবর চেপে যাওয়ার এই সরকারি নীতির বিরুদ্ধে। দেশজুড়ে লক ডাউনের মধ্যে প্রশান্ত কিশোর মালবাহী বিমানে চড়ে দিল্লি থেকে কলকাতায় আসেন এবং তার পর থেকেই পশ্চিমবঙ্গের করোনা পরিসংখ্যান নড়েচড়ে বসে। আক্রান্তের হার এবং মৃতের সংখ্যা, দুইই বাড়তে শুরু করে। যদিও সেখানেও মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া কো–মর্বিডিটির তত্ত্বের বিস্তর বিরোধিতা হচ্ছে।
কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট–এর অধ্যাপক এবং ফলিত সংখ্যাতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ দেবাশিস সেনগুপ্ত যদিও যে ব্যাখ্যা দিলেন, তাতে বোঝা গেল, সমস্যাটার অতি সরলীকরণ হচ্ছে। পরিসংখ্যান চেপে যাওয়া মানে এক্ষেত্রে কম পরীক্ষা করানো। প্রত্যেকের পরীক্ষা হবে, নাকি যারা তথাকথিত ‘হাই রিস্ক', কেবল তাদেরই, এটা পরিস্থিতি এবং সুবিধা অনুযায়ী বদলাতে পারে।
অধ্যাপক সেনগুপ্ত বোঝালেন, ‘‘সাপ্রেস করার কথা যেটা বলছেন, ধরুন ওয়েস্ট বেঙ্গলের সম্বন্ধে এরকম একটা অ্যালিগেশন আছে যে, অনেকটা সাপ্রেস করা হয়েছে। সেই ব্যাপারটাও পাবলিক প্রেশারে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু এক্সপ্যান্ড করা হয়েছে। এতে যেটা হচ্ছে, যদি হয়ত ১০০ জনের টেস্ট করার দরকার ছিল, সেখানে ১০০ জনকে না করে আপনি যাদের সবথেকে বেশি হাই রিস্ক মনে করেন, এরকম ৫০ জনকে করলেন। তা হলে, তাদের মধ্যে থেকে যে রেটে পজিটিভ আসবে, যাদের নিলেন না, তাদেরও যদি নিতেন, তা হলে একটু কম রেট আসত। সব মিলিয়ে টোটাল সংখ্যাটা বাড়তো, কিন্তু যতজনকে স্যাম্পল করেছেন, তার হিসেবে ততটা বাড়তো না। একটু কম বাড়তো। এই একটা এফেক্ট আছে। যার জন্য হয় কী, ডাবলিং রেটের ওপর তার একটা এফেক্ট হয়। মানে আপনি দুদিক থেকে লুজ করছেন। একদিকে টোটাল কাউন্টের হিসেবটার আপনি আন্ডার এস্টিমেট পেলেন। যা হওয়া উচিত, তার থেকে কম পেলেন। কিন্তু সেই নাম্বারটা তো সবাই জানে, যে এই কাউন্টটা, মানে যাদেরকে টেস্ট করা হয়েছে, তাদের বাইরেও অনেকে রয়েছে। সেটা নিয়ে ততটা অসুবিধে নেই। কিন্তু যেটা হচ্ছে, এই ডাবলিং রেট, অর্থাৎ কতদিনে কাউন্ট ডবল হবে, সেটার ওপরে এফেক্টটা দেখতে হবে। সেটা, যদি হাই রিস্ক গ্রুপের ওপর কন্সেন্ট্রেট করেন, তা হলেও যদি একই ডেফিনিশন ব্যবহার করে যান, একই ক্রাইটেরিয়া অনুযায়ী আপনি করে গেলেন, তা হলে ডাবলিং রেটে তত তফাৎ হবে না। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি এক্সপ্যান্ড করেন, আজকে ঠিক করলেন যে শুধু যাদের সিম্পটম আছে, তাদের (টেস্ট) করবেন, দুদিন পর ঠিক করলেন, শুধু সিম্পটম নয়, যারা এক্সপোজড হয়েছে, তাদেরও টেস্ট করবেন— এইটা যদি আপনার ক্রাইটেরিয়া এক্সপ্যান্ড করে থাকে, তখন ডাবলিং রেট কিন্তু বাড়বে। ধরুন, আগে দেখা যাচ্ছিলো সাড়ে চার দিনে ডবল হচ্ছে, আপনি যখন ক্রাইটেরিয়াটা একটু ঢিলে করে দিলেন, তখন সেটা সাড়ে সাত, বা আট দিনে ডবল, বা ১০ দিনে ডবল হতে পারে। এই যে ফারাকটা হলো, এটাতে জিনিসটা কতটা ভিরুলেন্ট, কীভাবে প্রোগ্রেস করছে, সেটা বুঝতে একটা অসুবিধে হতেই পারে।''
সমস্যা এখানেই। কখনো পরিস্থিতির চাপে, কখনো জনমত, কখনো রাজনৈতিক বিরোধিতায় পরিসংখ্যান বদলাচ্ছে। সে ছাড়াও, পরীক্ষার সুযোগ–সুবিধে বাড়লে, রীতি এবং পদ্ধতিও বদলে যাচ্ছে। সময় সময় আইসিএমআর-ও তার নির্দেশিকা বদলাচ্ছে। সেক্ষেত্রে আমেরিকা বা ইউরোপ যে নীতি নিয়ে চলছে, সেটাই কি সঠিক পথ। মানতে নারাজ অধ্যাপক সেনগুপ্ত। একটা চমৎকার উদাহরণ দিলেন, যে একই শহরে কোনো বহুতল আবাসনে বাসিন্দারা ঘরবন্দি থাকলে সামাজিক দূরত্ব তৈরি হয়। কিন্তু ঘনবসতি মহল্লায় ঘরবন্দি থাকার অর্থ বেশি গায়ে গায়ে থাকা, ফলে সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া!