নিরাপদ সড়কের দাবিতে আবারো আন্দোলন
২০ মার্চ ২০১৯এবার বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ প্রফেশনালসের (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথমবর্ষের ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী নিহত হওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন৷ ঢাকার নদ্দার বসুন্ধরা গেট এলাকায় মঙ্গলবার একটি বাস আবরারকে চাপা দিলে তিনি ঘটস্থলেই নিহত হন৷ তিনি সকালে রাস্তা পার হয়ে তাদেরই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরতে চেয়েছিলেন৷
এই ঘটনায় মঙ্গলবারই শিক্ষার্থীরা বসুন্ধরা এলাকায় প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে সড়ক অবরোধ করেন৷ বুধবারও বসুন্ধরা এলাকা ছাড়াও ঢাকার ধানমন্ডি ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, বাড্ডা, প্রগতি সরণী ও পুরনো ঢাকায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করেন৷ তারা একই সঙ্গে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজও করেন গতবারের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মতো৷ যানবাহনের লেন ঠিক করা ছাড়াও তারা কয়েকটি স্থানে গাড়ির কাগজপত্র চেক করেন৷
পুলিশ জানায়, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণভাবেই তাদের আন্দোলন করছেন৷ তারা পুলিশের সহায়তায় সড়কের একপাশ খালি করে দিয়ে যানবাহন চলাচলের সুযোগ করে দিচ্ছেন৷ তারপরও বুধবার ঢাকায় ব্যাপক ভোগান্তি ও যানচটের সৃষ্টি হয়৷
আন্দোলনরত বিইউপি-র শিক্ষার্থী দেওয়ান রাহাত ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা ১১ দফা দাবিকে আন্দোলন করছি৷ এরমধ্যে তিনটি দাবিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি৷ তার মধ্যে প্রথম হলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঘাতক বাসের ড্রাইভার এবং দায়ীদের দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় বিচারের আওয়তায় এনে শাস্তি দেয়া৷ বিচার হতে হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে৷ সুপ্রভাত এবং জাবেলে নুরের সকল বাসের রুট পারমিট বাতিল হয়েছে৷ আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক এলকায় প্রয়োজনীয় ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডার পাস, ফুটপাথ নির্মাণ ও জেব্রা ক্রসিং দেয়ার পরিকল্পনা ঘোষণা করতে হবে এবং তা সরকারি গেজেট আকারে প্রকাশ করতে হবে৷''
তিনি জানান, ‘‘আবরার জেব্রা ক্রসিং দিয়েই পার হচ্ছিলেন৷ কিন্তু সেসময় সুপ্রভাত এবং জাবেলে নুরের দু'টি বাস প্রতিযোগিতা করছিল৷ সুপ্রভাতের বাসটি আবরারকে চাপা দেয়৷''
এরইমধ্যে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মেয়রের সঙ্গে বিকেলে বৈঠকে বসেন৷
আরেকজন শিক্ষার্থী সালমান তারেক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এর আগেও আমরা নিরাপদ সড়কের জন্য আন্দোলন করেছি৷ তখনো আমাদের নিরপদ সড়কের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু সেই সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি৷ নিরপাদ সড়ক নিশ্চিত হয়নি৷ তাই এবার আমরা আমাদের দাবির বাস্তবায়ন দেখতে চাই৷ আমরা যখন দেখবো সত্যিই আমাদের দাবি বাস্তবায়ন হয়েছে, তখন আমরা ঘরে ফিরে যাবো৷ তার আগে নয়৷''
মেয়রের ফ্লাইওভার
এদিকে আবরার নিহত হওয়ার দিনই ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে গিয়ে দুর্ঘটনাস্থলের সড়কে আবরারের নামে একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের ঘোষণা দেন৷ তিনি বলেন, দু'বছরের মধ্যে এটি নির্মাণ হবে৷ বুধবার তিনি সেখানে ভিত্তিপ্রন্তরও স্থাপন করেন৷ এরপর তিনি এবং ডিএমপির কমিশনার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তোপের মুখে পড়েন৷ শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে তারা ওই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন৷ শিক্ষার্থী দেওয়ান রাহাত বলেন, ‘‘আমরা মেয়রের প্রস্তাবকে প্রত্যাক্ষান করেছি৷ এভাবে একজন মারা গেলেই একটি ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে, তা তো হয় না৷ তিনি কত ফ্লাইওভার নির্মাণ করবেন? আমরা চাই আমাদের জীবনের নিরপত্তা৷''
চালক রিমান্ডে
পুলিশ এরইমধ্যে আবরারকে চাপা দেওয়ার ঘটনায় সুপ্রভাত বাসের চালক সিরাজুল ইসলামকে গ্রেপ্তার এবং সাত দিনের রিমান্ডে নিয়েছে৷ বাসটি আটক এবং তার লাইসেন্স ও রুট পারমিটও বাতিল করা হয়েছে৷ কিন্তু মালিকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি৷
১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ
বুধবার হাইকোর্ট শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীর পরিবারকে সাত দিনের মধ্যে ১০ লাখ টাকা খরচ দিতে সুপ্রভাত পরিবহণ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছে৷ একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কে এম হাফিজুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশ দেন৷
একই সঙ্গে আবরারের পরিবারকে কেন ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না, তা নিয়ে রুল জারি করা হয়েছে৷
নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও সরকারের প্রতিশ্রতি
এর আগে গত বছরের ২৯ জুলাই ঢাকার শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজিব কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়ক বাস চাপায় নিহত হন৷ তখন সারাদেশের শিক্ষার্থীরা নিারপদ সড়ক আন্দোলন গড়ে তোলেন৷ ঐ আন্দোলনে এক সপ্তাহের জন্য উত্তাল ছিল বাংলাদেশ৷ তখন সরকার নতুন সড়ক আইন পাশ করে এবং সড়ক দুর্ঘটনা রোধে নানা প্রতিশ্রুতি দেয়৷ কিন্তু তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি৷ আর আইনে দাবি অনুয়ায়ী মৃত্যুদণ্ডের ৩০২ ধারার বিধানও সরাসরি রাখা হয়নি৷
দুই শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর তখনকার নৌ-মন্ত্রী এবং সড়ক পরিবহণ নেতা শাজাহান খান সেটাকে স্বাভাবিত ঘটনা বলে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবে হেসে ফেলেন৷ তাতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়৷ সেই শাজাহান খানকে প্রধান করেই গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৫ সদস্যের সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটি করা হলে তা সমালোচনার মুখে পড়ে৷
বাসের কারণে দুর্ঘটনা
বুয়েটের এক্সিডেন্ট রিচার্স ইন্সটিটিউ-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালের মার্চ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৬৬টি দুর্ঘটনায় ৬৯৯ জন নিহত এবং ১ হাজার ২২৭ জন আহত হয়েছে৷ এর মধ্যে ৩৫৪টি দুর্ঘটনাই বাসের কারণে ঘটেছে৷ এছাড়া ১৩০টি মোটরসাইকেল, ১১৩টি ট্রাক, ৭৩টি পিকআপ এবং ৫৬টি ব্যক্তিগত গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে৷
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিক মোজাম্মেল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার কারণ মালিকদের অতিরিক্ত মুনাফার লোভ৷ তারা চালকদের দৈনিক ভাড়া ভিত্তিতে বাস দেয়৷ আর চালকরা তাদের দিনের লাভসহ মালিকের লাভ তুলতে রেস শুরু করে৷ যার শিকার হন যাত্রী ও পথচারী৷ তারা সরকারের ক্ষমতা ব্যবহার করে এই অনিয়ম করছে৷ আবার কখনো কখনো সরকারকে তারা ব্ল্যাকমেইল করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘গতবছর নিরপাদ সড়ক আন্দোলনের পর মালিকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তাঁরা আর চুক্তিতে নয়, চালক ও হেল্পারদের মাসিক বেতন দেবেন৷ কিন্তু তাঁরা এটা নিয়েও প্রতারণা করেছেন৷ তাঁরা আসলে মাসিক ইজরায় গেছেন৷ এতে প্রতিদিন বাস প্রতি মালিকের লাভ আরো বেড়ে গেছে৷ আর চালকরা আরো মরিয়া হয়ে রেসে নেমেছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘পরিবহণ খাতে নৈরাজ্য চলছে৷ আবরারের আগেও জেব্রা ক্রসিং-এ আরো অনেককে চাপা দেয়া হয়েছে৷ এ দেশে আইন নেই৷ থাকলেও তা কাজে আসে না৷ দায়ীরা শাস্তি পায় না৷ ফলে সড়কে মৃত্যুর মিছিল কমছে না৷ আমরা একটি ভালো পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই কাজে দক্ষ এবং অভিজ্ঞদের নিয়ে একটি জাতীয় কামিটি গঠনের কথা বলেছিলাম৷ কিন্তু তা-ও সরকার আমলে নিচ্ছে না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সরকার তার বিবেচনায় শাহজাহান খানকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ কমিটির প্রধান বানায়৷ কিন্তু যাদের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন তাদের পরামর্শ নেয় না৷''