‘নিপীড়িত আরব মেয়েদের’ নিয়ে পশ্চিমাদের বদ্ধমূল ধারণা
২৫ মার্চ ২০২০দক্ষিণ জর্ডানের এক নারীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম৷ তিনি খুবই রক্ষণশীল পোশাক পরেছিলেন- হেডস্কার্ফ, লম্বা জামা৷ কোনো মেক-আপ ছিল না৷ তবে মাদাবা প্রদেশের এই কাউন্সিলর যখন কথা বলছিলেন তখন বোঝা যাচ্ছিলো তিনি তাঁর কাজের ব্যাপারে কতটা পরিষ্কার ও অনড়৷
‘‘নারীদের আর পেছনে পড়ে থাকতে চান না’’ দাবি করেন তিনি৷ এ কথা বলার আগে তিনি অবশ্য পুরো ফিরিস্তি দিলেন যে, পুরুষকেন্দ্রিক জর্ডানের গ্রাম্য সমাজব্যবস্থায় জায়গা করে নেয়াটা তাঁর জন্য কতটা কঠিন ছিল এবং প্রাদেশিক কাউন্সিলে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাকে কতটা যুদ্ধ করতে হচ্ছে৷ নারীর ক্ষমতায়ন ও তাদের জন্য প্রকল্প গ্রহণের জন্য তিনি তার ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহারটুকু করেন৷ তবে সেখানেই থেমে থাকতে চাইছেন না বলে জানান এই নারী৷
৫০ বছর বয়সি আসমা রাশাহনেহ আরবের অসংখ্য উদ্যোগী নারীর একজন মাত্র৷ লেবানন থেকে ইয়েমেন, জর্ডান থেকে মরক্কো, কিংবা আমিরাত থেকে সুদান- সর্বত্রই সামাজিক পরিবর্তনের এক বিরাট হাওয়া বইছে৷ পরিবার ও বিয়ে নিয়ে ধারণাও বদলাচ্ছে৷ তরুণ আরব নারীরা তাদের মায়েদের কাছ থেকে আরো বেশি প্রত্যাশা করছেন এবং সহজেই আর সন্তুষ্ট হচ্ছেন না৷
এক প্রজন্ম আগেও যেটা ব্যতিক্রম ছিল, তা এখন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে৷ নারীরা এখন উদ্যোক্তা হচ্ছেন, একা পরিবার সামলাচ্ছেন, পেশা হিসেবে ক্রীড়া, শিল্প, আইন বা রাজনীতি বেছে নিচ্ছেন৷ অবসর সময়ে ভাই বা পিতার রক্তচক্ষু এড়িয়ে নতুন নতুন স্বাধীনতা উপভোগ করছেন৷ তারা নিজেদের অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে কিংবা কোরআনের নতুন, নারীবাদী ব্যাখ্যার জন্য লড়াই করছেন৷
একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি
তবে এত পরিবর্তন সত্ত্বেও পশ্চিমাদের চোখে তা পড়ে না৷ তারা বরং ইসলামী দুনিয়ার নারীদের জীবনকে জোরপূর্বক বিয়ে, সম্মান রক্ষার্থে হত্যা (অনার কিলিং) এবং পুরুষের নির্যাতন- এর চৌহদ্দিতেই দেখতে পান৷ প্রকাশনা সংস্থাগুলো বইয়ের পর বই ছাপিয়ে যাচ্ছেন যেগুলোর শিরোনাম হয় এমন- ‘আমি স্বাধীনতা বেছে নিয়েছি: কেমন করে আমি জোরপূর্বক বিয়ে ও নিপীড়ন থেকে বেঁচেছি এবং ফিরে পেয়েছি আশা’ (জার্মান ভাষায় প্রকাশ করেছে আডেও গ্রুপ)৷
বেশিরভাগ আরবের নারী নিজেদের ঘর ভাড়া, বাচ্চাদের পড়াশোনা এবং ব্যক্তিগত উন্নতির পেছনে খরচ মেটাতে হিমশিম খান৷ তারপরও ‘আলোকিত পশ্চিমা সাহিত্য’ অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যের নারীরা তখনই কেবল মুক্তি পাবেন যখন তারা তাদের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় শেকড় ছিন্ন করতে পারবেন৷
আসলে ভয়ঙ্কর কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে ঘিরে আমাদের ভাবনার সীমাবদ্ধতা আরব নারীজীবনের সংগ্রাম, উচ্ছ্বাস ও সংঘাতের জায়গাগুলো বুঝতে বাধা দেয়৷ মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া কিছু উদাহরণ কিন্তু এসব নারীর সাধারণ বাস্তবতা নয়৷ হেডস্কার্ফ বা হিজাব নিয়ে মিডিয়ার মাতামাতি তাদের সম্পর্কে এসব সাধারণ ধারণাকেই কেবল উস্কে দেয়৷
তাই ‘নিপীড়িত আরবের নারী’ বললে তাদের চোখে হিজাব পরা জনবিচ্ছিন্ন নারীর ছবি ভেসে ওঠে৷ আজ এটা সমাজের বিরাট মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি সাধারণ ধারণা৷ হিজাব পরা নারী মানে দূর্বল, অসহায় মধ্যপ্রাচ্যীয় নারীর কতগুলো ছবি৷ এতে করে এ অঞ্চলের নারীদের বদলে যাওয়ার চিত্রটি ঠিক ফুটে ওঠে না৷
‘আমরা’ মুক্ত, তোমরা ‘নিপীড়িত’
এটা সত্য, আরবের নারীরা তাদের সামাজিক অধিকার থেকে অনেক বেশি বঞ্চিত৷ সেখানে লিঙ্গবৈষম্য বড় সমস্যা৷ নানা কারণে তাদের দোষারোপ করা হয়৷ খ্রিস্টান, ইহুদি ধর্ম কিংবা তুলনামূলক সহনশীল বলে পরিচিত বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মতো, ইসলামেও শতকের পর শতক ধরে পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোকে জোরদার করা ও বৈধতা দেয়া হয়েছে৷
তারপরও ‘আরবের নারীরা নিপীড়িত’ ঠিক সত্যটা ধারণ করে না৷ যেমন, এটি পুরো অঞ্চলের নারী-পুরুষের সম্পর্ককে ধারণ করে না৷ আরব বিশ্বে এমন অনেক পরিবার আছে যেখানে পরিবারের মেয়েকে (ও ছেলেকে) তাদের জীবনের লক্ষ্য অনুসরণ করতে অনু্প্রাণিত করা হয়৷ অনেক বাবা ও স্বামী আছেন, যারা ত্যাগ স্বীকার করতে এবং লিঙ্গসমতা মেনে সম্পর্ক চালিয়ে যেতে চান৷ সবচেয়ে বড় কথা হলো, যারা নারী অধিকার নিয়ে লড়েন, তাদেরও সমাজের মধ্য থেকে সমর্থন দরকার৷
পশ্চিমে মুক্ত নারীর বিপরীতে আরবের কঠিন শৃঙ্খলে আবদ্ধ নারীর ছবি দাঁড় করিয়ে দেয়া খুব সোজা৷ মুসলিম সমাজ অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক আর পশ্চিমা সমাজ অনেক বেশি প্রগতিশীল ও আধুনিক, এমন দাবিও তোলা হয়৷ সুইস সামাজিক নৃতত্ত্ববিদ অ্যানমারি জানকার মনে করেন, কোনো ধারণাই পুরোপুরি সত্য নয়৷
পশ্চিমের নারীরাও বৈষম্যের শিকার হন৷ ‘মি টু’ বিতর্ক, বেতন বৈষম্য, নির্যাতন (জার্মান পুলিশের তথ্যমতে, প্রতি তিন দিনে একজন পুরুষ তার নারী সঙ্গীকে বা প্রাক্তন সঙ্গীকে হত্যা করেন)- এগুলো কয়েকটি উদাহরণমাত্র৷ লিঙ্গসমতা তৈরিতে আমাদের এখনো অনেক দূর যেতে হবে৷
যারা নিজ সংস্কৃতিতে নারী অধিকারের সমস্যা দেখতে পান না, তারা ভিন্ন সংস্কৃতির এ সংক্রান্ত জটিল বিষয়গুলোও ধরতে পারবেন না৷ প্রয়াত মনোবিজ্ঞানী ও লিঙ্গ গবেষক ব্রিগিট রোমেলস্পাখার ২০১৩ সালে নারীবাদ, অসাম্প্রদায়িকতা ও ইসলাম নামে একটি জার্মান ভাষায় একটি আর্টিকেল লিখেছিলেন৷ পশ্চিমের আধিপত্যবাদী আচরণ নিয়ে গবেষণা করতেন তিনি৷ তার মতে, ভিন্ন নারীদের একমুখীভাবে ‘পশ্চাৎপদ’ ভেবে, এই নারীরা নিজেদের ‘প্রগতিশীলতার’ সুখ পান৷
এই বদ্ধমূল ধারণা শুধু ইউরোপের লিঙ্গ সমতার বিষয়টি, আসল রূপটি আড়ালে ঠেলে দিচ্ছে না, বরং নিকটপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার নারী-পুরুষ উভয়ই যে দারিদ্র, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে চলেছে, সেই সত্যও গোপন করছে৷ তাই ব্যক্তিগত পর্যায়ে এদের নিয়ে কাজ করার সুযোগ খুব সীমিত৷ রাজনৈতিক নিপীড়নের থেকে লিঙ্গসমতাকে এবং তাতে পশ্চিমাদের ভূমিকা আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই, এমনটি মনে করেন মিশরের সামাজিক নৃবিজ্ঞানী দিনা মাকরাম-এবাইদ৷
পশ্চিমারা যেমন এসব দেশের একনায়কদের রাজনৈতিক সহযোগিতা দেবার দায়িত্ব এড়াতে পারে না, তেমনি শিল্পোন্নত দেশগুলো বেশি সম্পদ ‘ব্যবহার করে বাকি বিশ্বের উন্নয়নের সুযোগ সীমিত করে দিয়েছে৷ ফলে জলবায়ু পরিবর্তন ইউরোপের চেয়েও উত্তর আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যে বেশি প্রভাব ফেলছে৷
‘‘আমরা দক্ষিণাঞ্চলের মানুষরা জলবায়ু পরিবর্তনের দাম সবচেয়ে বেশি দিচ্ছি,’’ মাকরাম-এবাইদ বলেন৷ ‘‘আজকে বৈশ্বিক উত্তরাঞ্চল পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সম্পদ ব্যবহার করায় মিশর কি দিন দিন উত্তপ্ত ও অবাসযোগ্য হয়ে পড়ছে না?’’
সাংস্কৃতিক প্রভাব
আধিপত্যবাদকে বৈধতা দেবার জন্য ‘আরবের নারীদের নিপীড়ন’কে বারবার ইউরোপ সামনে এনেছে৷ কিন্তু যখন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় সমাজে নারীদের অবস্থান বদলাচ্ছে তখনও কেন?
পশ্চিম যতই বিশ্বে তাদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য হারাচ্ছে, ততই তারা ‘মধ্যপ্রাচ্যীয় বর্বরতা’কে খুঁজে বেড়াচ্ছে৷ ইউরোপের আসল ক্ষমতা যখন কম্পমান, তখন অভিবাসন সংকট উন্মোচিত করছে তাদের সভ্যতার মুখোশ৷ বৈশ্বিকীকরণ, শরণার্থী সমস্যা ও অর্থনৈতিক সংকটের ভয় নিয়ে এক গভীর নিরাপত্তাহীনতা পশ্চিমা সমাজে সাংস্কৃতিক আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজনীয়তা তৈরি করেছে৷
জর্ডানের স্থানীয় এক কাউন্সিলর আসমা রাশাহনেহ হয়ত ইউরোপের এসব তর্কবিতর্ক নিয়ে অবগত নন৷ তিনি বরং আরো বেশি বাস্তবিক সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবেন৷ যেমন, কেমন করে সম্মান নিয়ে বাঁচা যায়, যেখানে সহিংসতা বা যৌন নিপীড়নের শিকার হবেন না নারীরা৷ তিনি ভাবেন নারীর স্বনির্ভরতা, উন্নততর শিক্ষা এবং জনঘনিষ্ঠ বিষয়ের আলোচনার টেবিলে একটি জায়গার কথা৷ একটা উন্নততর বিশ্বের জন্য তাঁর মতো সংগ্রাম করা নারীদের আরো বেশি স্বীকৃতি দিতে হবে৷
ক্লাউডিয়া মেন্ডে/জেডএ