1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

নতুন দল: কার টাকায় সংগঠন, ত্রাণের কম্বল, সংবর্ধনার তোরণ?

২৪ জানুয়ারি ২০২৫

জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন রাজনৈতিক দল আসছে৷ এক নেতার দাবি, বিলাসবহুল এলাকায় দুটি অফিসের ভাড়া দেয়া হয় ‘নিজেদের অর্থে’৷ ত্রাণের কম্বল দেন ব্যবসায়ী, সংবর্ধনার তোরণ ভালোবেসে বানায় মানুষ৷

https://p.dw.com/p/4pb7x
বিজয় দিবসে জাতীয় নাগরিক কমিটির বিজয় র্যালি
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তারা ৩২৮টি থানা কমিটি করেছেনছবি: DW

ফেব্রুরিতেই জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করবে৷ এরই মধ্যে তাদের কেউ কেউ নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ এলাকায় শীতবস্ত্রও বিতরণ করছেন, নিচ্ছেন নাগরিক সংবর্ধনা৷এসবের আগে ঢাকায় ব্যয়বহুল এলাকা বাংলামোটরে দুইটি অফিসও নিয়েছেন তারা৷

তাদের এই দল গঠনের প্রক্রিয়া, ফান্ডিং, এবং সরকারি ছত্রছায়ায় দলগঠন ইত্যাদি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা৷

জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তারা ৩২৮টি থানা কমিটি করেছেন৷ এরপর ওয়ার্ড কমিটির কাজও শুরু হয়েছে৷ সব থানা কমিটি করার পর জেলা কমিটি করা হবে৷ তারপর জাতীয় কমিটি৷ ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করা হবে৷ দলের নাম এখনো চূড়ান্ত হয়নি৷ তিনি বলেন, ‘‘জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন অরাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম হিসাবেই থাকবে৷ যারা রাজনীতি করবেন, তারা এখান থেকে গিয়েই নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন৷” অরাজনৈতিক সংগঠন রাজনৈতিক দল গঠন করলে তারা অরাজনৈতিক থাকে কীভাবে- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘এখানে যারা থাকবেন, তারা সরাসরি রাজনীতি করবেন না, তার প্রেসার গ্রুপের কাজ করবেন৷”

তিনি আরো জানান, তাদের নতুন রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় নেতুত্বে তরুণরাই থাকবেন৷

এখন নিজেদের অর্থে সংগঠন চালাচ্ছি: নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি

ছাত্রদের দল নিয়ে যত প্রশ্ন

ছাত্রদের মধ্যে যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তারা কোথাও কোথাও ছাত্রদের দল গঠনের সঙ্গে জড়িত-এই ধরনের আলোচনা আছে৷ বিশেষ করে মাহফুজ আলমের, তার তো কোনো কেবিনেট নেই৷তার ক্ষেত্রে এই কথাটি বেশি শোনা যাচ্ছে৷ এই পারসেপশন যখন আছে, তখন বিএনপি যদি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন করে, তখন সেটা অমূলক নয়,” এই বিশ্লেষণ রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমানের৷

তিনি বলেন, ‘‘আবার ধরুন, গতকাল(বৃহস্পতিবার) মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ রি-অ্যাক্ট করেন৷ তারা যে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন, তা আবার জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যারা আছেন, সবাই শেয়ার করেছেন৷ শেয়ার করতে গিয়ে তারা আরো কঠোর ভাষায় কথা বলেছেন৷ তাহলে আমরা দেখছি, যারা উপদেষ্টা পরিষদে আছেন এবং যে ছাত্ররা দল করছেন, তাদের কথার মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে৷ ফলে এটা সন্দেহ বাড়িয়ে দেয়৷ আর গতকালকের ঘটনার পর মির্জা ফখরুলের হাইপোথিসিসকে আরো প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ এর আগেও বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগসূত্র দেখা গেছে৷ উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, বাইরে থাকা ছাত্ররা যখন জুলাই প্রোক্লেইমেশন নিয়ে কথা বলছেন, তখন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ‘নাও অর নেভার'৷”

‘‘তাহলে আমরা দেখছি যে, এই সরকারের কেউ কেউ ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনে যে সহায়তা করছে তার যোগসূত্র বিভিন্ন ঘটনায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যেটা আগামী নির্বাচন নিয়ে সংকট তৈরি করতে পারে,’’ বলেন তিনি৷

তার কথা, ‘‘তাদের দুইটি সংগঠন-জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন৷ তারা বলছে, নতুন যে রাজনৈতিক দল হবে তারা এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে দল করবে৷ কিন্তু দল তৈরির কাজ তারাই করছে৷ ফলে তারা যে সরকারি প্রটোকল নিচ্ছে, এগুলো নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবে৷ তারা অল্প সময়ের মধ্যেই ঢাকার প্রাণকেন্দ্র এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল এলাকায় দুইটি অফিস নিয়েছে৷ তার খরচ নিয়েও তো প্রশ্ন আছে৷”

‘‘আমার কথা, অন্য রাজনৈতিক দল কী করছে সেটা তাদের চিন্তায় নিলে হবে না৷ তাদের প্রতি মানুষের যে প্রত্যাশা সেই জায়গা থেকে সরকারের সহায়তা না নিয়ে স্বাধীনভাবে ও স্বচ্ছতার সঙ্গে রাজনৈতিক দল গঠন করা উচিত,'' বলেন তিনি৷

অধ্যাপক ড. জাহেদ উর রহমানের বক্তব্যের জবাবে নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি দাবি করেন, ‘‘যে তিনজন উপদেষ্টা ছাত্রদের মধ্য থেকে আছেন, তারা সরকারে আছেন৷ তারা এখন আর আমাদের সঙ্গে নাই৷ তারা রাজনীতি করছেন না৷ একমাত্র মাহফুজ আলম আমাদের পলিটিক্যাল দর্শন নিয়ে কাজ করেন৷ তাই তিনি মুজিববাদী এবং জামায়াতের দর্শনের জায়গা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন৷’’

তিনি আরো  দাবি করেন, ‘‘আমরা যারা সদস্য আছি, কমিটিতে আছি, তারাই এখন নিজেদের অর্থে সংগঠন চালাচ্ছি, অফিস ভাড়া দিচ্ছি৷ আর বিভিন্ন জায়গায় সমাবেশ করা বা ত্রাণ দেয়া বা কোনো সামাজিক কাজের জন্য আমরা স্থানীয়ভাবে অর্থ সংগ্রহ করছি৷ তবে রাজনৈতিক দল হলে কীভাবে ফান্ড সংগ্রহ হবে তার নীতিমালা করা হবে৷ নীতিমালা না করে কোনো ফান্ড নেয়া হবে না৷’’

নির্বাচনের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘আমরা দল গঠন করে আগে জনগণের কাছে যাবো৷ তারা কী চায়, আমরা কী চাই সেটা নিয়ে কথা হবে, তারপর নির্বাচনের প্রশ্ন আসবে৷’’

‘এক হাজার কম্বল দিয়েছেন ব্যবসায়ী, এলাকায় তোরণ ভালোবেসে বানিয়েছে মানুষ'

তবে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘‘আমরা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করবো৷ আমি আমার এলাকায় এক হাজার কম্বল দিয়েছি৷ ওটা আমাকে এক ব্যবসায়ী দিয়েছেন৷ আর এলাকার মানুষ তোরণ বানিয়ে আমাক সংবর্ধনা দিয়েছে তাদের ভালোবাসার কারণে৷”

সারজিস আলমসহ আরো অনেকে এরইমধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘এটা দল গঠনের পর আমরা চিন্তা করবো৷ কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবে চিন্তা করেন, সেটা তাদের ব্যাপার৷’’

সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন অমূলক নয়: ড. জাহেদ উর রহমান

কিংস পার্টি, না স্বাভাবিক রাজনৈতিক দল?

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘‘সমাজের নানা জায়গা এবং সামাজিক গণমাধ্যমে ছাত্রদের এই রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন উঠেছে কিংস পার্টি গঠন হচ্ছে কিনা৷ তরুণদের রাজনীতির আকাঙ্খার আমরা পক্ষে৷ আমরা সমর্থন করি৷ কিন্তু আমার কথা, তারা যদি সরকারের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ সহায়তা ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করতে চান, তাহলে এটা জনগণ ভালোভাবে নিচ্ছে না৷ এবং জণগণের সঙ্গে তাদের এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে৷ এবং সমাজের বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গেও বিচ্ছিন্নতা তৈরি হচ্ছে৷”

"শুধু তাই নয়, তাদের কথায়, বচনে আরো সংযত হওয়া প্রয়োজন৷ তাদের আরো বিনয়ী হওয়া দরকার৷ তারা সমাজের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে কথা বলবেন, পুশ করবেন- এটা স্বাভাবিক৷ কিন্তু তারা সবাইকে বাদ দিয়ে সেটা করতে কি পারবেন? অন্যান্য রজনৈতিক দলের সঙ্গেও তাদের এনগেজমেন্ট দরকার,” বলেন তিনি৷

তার কথা, ‘‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তো অ-দলীয় সরকার৷ কিন্তু তারা যদি বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করেন, তাহলে তাদের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তো প্রশ্ন উঠবেই৷ফলে সরকার যদি ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠনে সহায়তা করে, তারা বিতর্কিত হবে৷ আর ছাত্ররা যদি সহযোগিতা নিয়ে দল করে, তাহলে তাদের যে সম্ভাবনা আছে, তা হোঁচট খাবে৷”

বিএনপির সংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, ‘‘অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে বিএনপি মহাাসচিব যে কথা বলেছেন, জামায়াতের আমীরও কয়েকদিন আগে একই কথা বলেছেন৷ তখন কিন্তু এই উপদেষ্টারা বা বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা কোনো কথা বলেনি৷ চুপ ছিল৷ এখন কেন তারা তীব্র আক্রমণ করছে এটা ভেবে দেখার দরকার আছে৷”

এমরার সালেহ প্রিন্স মনে করেন, "সরকারের মধ্যে থেকে, বিশেষ করে উপদেষ্টারা যদি রাজনৈতিক দল গঠন করে, তাহলে তো প্রশ্ন উঠবেই৷ আমরা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেখতে পাচ্ছি ছাত্ররা যে রাজনৈতিক দল গঠন করছে, তার সঙ্গে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা আছেন৷ সরকারের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থাও তাদের জন্য কাজ করছে৷ ফলে সরকার যেমন নিরপেক্ষতা হারাবে, তেমনি ছাত্রদের এই দলও প্রশ্নবিদ্ধ হবে৷''

তার কথা, "তারা যে সরকারি সহায়তা নিচ্ছে, বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে, ত্রাণ বিতরণ করছে, এসবের ফান্ডিং নিয়ে প্রশ্ন ঊঠবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে৷”

তাদের মুখে বিএনপিই সমালোচনা

আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, ‘‘বিএনপিই ক্ষমতায় থেকে দল তৈরি করেছে আমরা সেটা করছি না৷ বিএনপি মনে হয় তাদের অতীত ভুলে গেছে৷ এই সরকারে বিএনপির প্রস্তাবের মধ্য থেকেও কয়েকজনকে উপদেষ্টা করা হয়েছে৷ আমার তো মনে হয় সরকার বিএনপির কথাই বেশি শুনছে৷ আমরা দাবি করার পরও রাষ্ট্রপতিকে সরানো হয়নি৷”

আর নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি বলেন, ‘‘এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের সরকার৷ বিএনপির সঙ্গে এই সরকারের কথা হয়, যোগাযোগ হয়৷ কেথাও সমস্যা থাকলে তারা সরকারের সঙ্গে কথা বলতে পারে৷ সেটা না করে বাইরে তারা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে৷ তারা তদবির  নিয়ে বলতে পারে, বসতে পারে, সুবিধা নিয়ে বসতে পারে৷ ন্যাশনাল ইস্যু নিয়ে বসতে পারেন না কেন?”

তার কথা, ‘‘এই সরকারে যারা আছেন তাদের একটি অংশ প্রো-বিএনপি৷ অনেকেই মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাহেবের ফ্রেন্ড সার্কেলের৷ তাহলে এই সরকার আমাদের হয় কীভাবে?”