বিবেককে নাড়া দিলেন বিএসএফ জওয়ান
১২ জানুয়ারি ২০১৭ভারতের সীমান্তে নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ান তেজ বাহাদুর যাদবের অভিযোগ, ভারত-পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ রেখায় প্রতিকূল আবহাওয়াতে ১১ ঘণ্টা পাহারা দিতে হয়, কিন্তু তার জন্য প্রাপ্য খাবারটুকু ঠিকমত জোটে না৷ বাজে খাবার খেয়ে ডিউটি দিতে হয় – এই অভিযোগ করে তিন-তিনটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করার পর তা ভাইরাল হয়ে যায়৷ ইতিমধ্যেই ৬০-৭০ লাখ মানুষ ফেসবুকে সেই ভিডিওগুলো দেখেছেন৷ তাতে তিনি অভিযোগ করেছেন, এমন দিনও গেছে যখন এত বাজে খাবার মুখে তুলতে না পেরে খালি পেটে রাত কাটাতে হয়েছে৷ সকালে পরোটা দেওয়া হয়, অনেক সময় বিনা সবজিতে৷ দুপুরে রুটি প্রায়ই পোড়া, সঙ্গে ডাল, যাতে হলুদ-নুন ছাড়া আর কিছুই থাকে না৷ রাতেও তাই৷ কঠিন ডিউটির জন্য যে শারীরিক শক্তি দরকার, যে খাবার জোটে তাতে বেশি দিন টেকা যায় না৷
এই বিস্ফোরক অভিযোগের পরদিনই নড়েচড়ে বসেন কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিএসএফ কর্তৃপক্ষ৷ অভিযোগ খতিয়ে দেখতে তদন্তের আদেশ দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং৷ তদন্ত শুরু করেন বিএসএফ-এরই ডিআইজি পদমর্যাদার এক অফিসার৷ কিন্তু তার আগেই তড়িঘড়ি তেজ বাহাদুরকে সরিয়ে দেওয়া হয় পু্ঞ্চের হেড কোয়াটার্সে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কথিত অপরাধে৷ বিএসএফ কর্তৃপক্ষের তরফে বলা হয়, এই বদলি রুটিন মাফিক এবং তদন্তের স্বার্থে৷ সাংবাদিকদের কাছে বিএসএফ-এর আইজি পাল্টা অভিযোগ করেন, তেজ বাহাদুর মদ্যপ এবং এর আগেও অনেকবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধে শাস্তি পেয়েছে৷ একবার চাকরি যেতে যেতে নাকি বেঁচেও গেছে তাঁর৷ খারাপ মানের খাবার-দাবার সম্পর্কে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘দেখুন, নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এলাকাটি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন কমান্ডের অধীনে৷ খাবার-দাবার যা আসে, তা জোগায় সাধারণত সেনাবাহিনী৷ সেটা নিম্নমানের হয় না৷ তবে শীতকালে কখনও কখনও টিনের খাবার খেতে হয়, সেটা অস্বাভাবিক নয়৷ এ বিষয়ে যাদবের অভিযোগ থাকলে কেন তিনি সরাসরি তাঁর ঊর্ধতন অফিসারের কাছে লিখিত অভিযোগ করেননি? আসলে যাদবের উদ্ধেশ্য অন্য৷''
কিন্তু ভিডিওতে দেখানো তেজ বাহাদুর যাদবের অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে বিএসএফ-এর বক্তব্য ধোপে টেকে না৷ যাদবের দাবি, সে অনেকবার ঊর্ধতন অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি৷ নিম্নমানের খাবারের জন্য সরকারের দোষ দেখছেন না তেজ বাহাদুর৷ সরকার বিএসএফ-এর মতো আধা-সামরিক বাহিনীর জন্য যথেষ্ট অত্যাবশ্য খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করে সন্দেহ নেই, কিন্তু সেইসব খাদ্যসামগ্রী বিএসএফ-এর ঊর্ধতন কিছু অফিসার পাচার করে থাকে বাইরে৷ কয়েকবার শৃঙ্খলা ভঙ্গের ভুলের কথা স্বীকার করে যাদব বলেন, ‘‘মানুষমাত্রই ভুল করে থাকে৷ আমিও করেছিলাম৷''
আর তাই যদি হয়, তাহলে প্রশংসনীয় কাজের জন্যও তো তাঁকে অনেকবার পুরস্কৃত করা হয়েছে৷ ‘‘এমনকি সোনার মেডেল পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে আমাকে৷ সেটা তাহলে কেন দেওয়া হলো?'' পাল্টা প্রশ্ন যাদবের৷ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি বলেছেন, তাঁর ওপর চাপ আসছে, কিন্তু আধা-সামরিক বাহিনীর দুর্নীতি প্রকাশ্যে আনতে তিনি তাঁর অভিযোগ থেকে এক ইঞ্চিও পিছিয়ে আসবেন না৷ শুধু বিএসএফ নয়, ইন্দো-টিবেটান বাহিনী, কেন্দ্রীয় শিল্প নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষেত্রেও তাঁর অভিযোগ বাস্তব সত্য৷ পাশাপাশি ভারতের মিডিয়াকে এক হাত নিতেও তিনি ছাড়েননি৷ বলেছেন, মিডিয়া কেবল ভিআইপি সর্বস্ব৷ জওয়ানদের আসল অবস্থা ভারতের মিডিয়া জানে শুধু মন্ত্রী ও আমলাদের মুখ থেকে৷ আর কোনো জওয়ান দেশ রক্ষায় শহিদ হলে তাঁর বা তাঁদের অন্তিম যাত্রা কভার করে৷ মিডিয়া কেন জওয়ানদের মুখ থেকে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সেকথা জানার চেষ্টা করে না?
প্রথম কথা, সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর জওয়ানের অভিযোগের তদন্ত যদি ঐ বাহিনীর কোনো অফিসারকে দিয়ে করানো হয়, তাহলে তার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে ঘোরতর সংশয় থেকেই যায়৷ বলা বাহুল্য, তদন্তে দোষী সাব্যস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে জওয়ানেরই৷ তাই সরকারের উচিত নিরপেক্ষ কমিশনকে দিয়ে তদন্ত করানো৷ আবার এটাও ঠিক, সামরিক বাহিনী কিংবা আধা-সামরিক বাহিনীর আচরণবিধি অনুসারে কোনো জওয়ানের কর্তৃপক্ষের বিরুধে ভিডিও তুলে বা সেলফি তুলে একাধিকবার পোস্ট করা কতটা সঙ্গত হয়েছে, সে বিষয়ে জনমত যাচাই করা৷ যদিও এর একটা মানবিক দিকটা অবশ্যই বিবেচ্য৷ এ কথা অনস্বীকার্য যে, শীতকালে যেখানে তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রির ১০ থেকে ১২ ডিগ্রি নীচে থাকে, সেখানে বল র্ধক বিশেষ খাবার-দাবার থাকা একান্ত জরুরি৷ নাগরিক সমাজো তেমনটাই মনে করে৷ শুধু বরফে নয়, গরমকালে রাজস্থানের মরু অঞ্চলে ৫০-৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রাতেও তাঁদের সীমান্ত পাহারা দিতে হয় জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য করে, এক নাগাড়ে৷ আরাম-আয়েশে অভ্যস্ত মন্ত্রীরা বা রাজনৈতিক রথী-মহারথীদের সেই মানবিকবোধটা থাকা উচিত, এমনটাই সুশীল সমাজের অভিমত৷ বিএসএফ-এর জওয়ান তেজ বাহাদুর যাদবের অভিযোগ যে সেদিক থেকে দেশের বিবেকের সামনে এক প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে, তা বলাই বাহুল্য৷
বিষয়টি নিয়ে আপনার কিছু বলার থাকলে লিখুন নীচের ঘরে৷