দুর্যোগের সময় কোরবানি: ইসলাম যা বলে
১৭ জুলাই ২০২০ইসলামের বিধান বলছে, কোরবানি না দিলে মুসলমানদের গুনাহ হবে৷ তবে কেউ যদি মনে করেন তার পক্ষে এই সময়ে কোরবানি দিলে শারীরিক সমস্যা বা অন্য কোনো ক্ষতি হতে পারে, তাহলে তিনি না-ও দিতে পারেন৷ কিন্তু পরে তাকে স্বাভাবিক সময়ে কাফফারা দিতে হবে৷ বাংলাদেশের ইসলামি চিন্তাবিদ ও মুফতিরা এমন মত জানিয়েছন৷
কিন্তু তারা মনে করেন, করোনাকালে দেশের সব মুসলমানের কোরবানি বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷ কারণ মানুষ এই করোনার মধ্যে অফিসে যাচ্ছেন, বাজারে যাচ্ছেন৷ তবে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে যেহেতু মহামারি চলছে তাই কোরবানি দেওয়াসহ সব ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে বলে মনে করেন তারা৷
কোরবানি কারা দেবেন
আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানরাকোরবানি দেবেন৷ এই সামর্থ্য বলতে কী বোঝায় তা নিয়ে কিছুটা দ্বিমত আছে ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে৷ শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘কোরাবানির তিন দিনে কোনো মুসলামানের কাছে যদি জাকাত দেওয়ার ‘নিসাব' পরিমাণ অর্থ অতিরিক্ত থাকে, তাহলে তাকে কোরবানি দিতে হবে৷ জাকাত ফরজ হতে সারাবছর ধরে ওই পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ সম্পদ থাকতে হয়৷ এটাই হলো কোরবানির সাথে জাকাতের পার্থক্য৷ আর হজ এবং কোরবানি একই সময়ে হলেও হজের সাথে কোরবানির সরাসরি সম্পর্ক নেই৷ যারা হজে যাবেন, তারা কোরবানি দেবেন৷ কিন্তু হজ তার জন্যই যার হজে যাওয়া-আসার মতো টাকা আছে৷ কিন্তু কোরবানি ওয়াজিব হতে হজে যাওয়ার সক্ষমতার প্রয়োজন নেই৷''
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফুর রহমান বলেন, ‘‘যার কাছে কোরবানির সময় কোরবানির পশু কেনার মতো টাকা থাকবে, তাকেই কোরবানি দিতে হবে৷ জাকাতের নিসাব পরিমাণ অতিরিক্ত টাকা ওই সময় থাকতে হবে তা নয়৷''
ইসলামের বিধান মতে, সারা বছর ধরে যে মুসলমানের কাছে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে সাত তোলা রূপা থাকবে, তাকেই জাকাত দিতে হবে৷ ‘‘আর নিয়ম হলো, যেটার আর্থিক মূল্য কম সেটা ধরেই সামর্থ্য বিবেচনা করতে হবে৷ তাই সাড়ে ৫২ তোলা রুপার সমপরিমাণ অর্থ সম্পদ থাকলেই জাকাত দিতে হবে,'' জানালেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের পরিচালক মুফতি মাওলা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ৷
কোরবানি কি বন্ধ রাখা যায়?
মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের মতে, সামর্থ্যবানরা এই করোনার সময়েও কোরবানি বাদ দিতে পারবেন না৷ এই ওয়াজিব বাদ দিলে গুনাহ হবে৷ যদি কোনো মুসলামান কোরবানি না করে সেই টাকা দান করে দেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘না তা-ও করা যাবে না৷ নামাজ বাদ দিয়ে শুধু রোজা রাখলে তাতে নামাজের ফরজ আদায় হয় না৷ নামাজও পড়তে হবে৷''
তার মতে, অফিস, হাট-বাজার সবই চলছে৷ তাহলে কোরবানি কেন হবে না৷ ইসলামের ইতিহাসে কোরবানি বাদ দেয়ার কোনো নজির নাই৷
তবে তিনটি পরিস্থিতিতে ব্যাক্তিগতভাবে কোনো মুসলমান কোরবানির সময় কোরবানি না-ও দিতে পারেন৷ কিন্তু পরে তাকে কাফফারা আদায় করতে হবে৷ সুবিধামতো সময়ে কোরবানির টাকা দিয়ে একটি পশু কিনে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দিতে হবে বলে জানান মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ৷ ওই তিনটি পরিস্থিতি হলো: সাধারণ শঙ্কা, প্রবল আশঙ্কা এবং নিশ্চিত ক্ষতি৷ করোনার সময় কোরবানি দিলে শারীরিক ক্ষতি অথবা ক্ষতি হবে এমন তথ্যগত প্রমাণ পেলে কিংবা নিশ্চিতভাবে জীবনহানির আশঙ্কা হতে পারে এমন ক্ষেত্রে কোরবানির সময় কোরবানি না-ও দিতে পারেন৷
অধ্যাপক ড. সাইফুর রহমান বলেন, ‘‘আরো অনেক কারণে কেউ ব্যক্তিগতভাবে কোরবানির সময় কোরবানি করতে না-ও পারেন৷ যেমন, কোরবানির কোনো পশু পাওয়া না গেলে বা দুর্যোগের শিকার হলে৷ এরকম হলে পরে কোরবানির পশু কেনার টাকা দান করে দিলেই হবে৷'' তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সব মুসলমান মিলে কোরবানি বাদ দেয়ার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে হয়নি বলে তিনি মনে করেন৷
তারা তিনজনই বলেন, মসজিদ তালা মেরে রাখা যাবে না৷ কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে মসজিদেই নামাজ পড়তে হবে, এমন নয়৷ আর ঘরে নামাজ পড়লে ফরজ আদায় হয়৷ এবারের হজ ও মসজিদে সীমিত নামাজের সাথে কোরবানির তুলনা করা তারা সঠিক মনে করেন না৷
ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘‘তবে এবার কোরবানিতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে৷ কোরবানির পশুর হাট থেকে শুরু করে পশু জবাই সবক্ষেত্রে৷এটার ব্যাবস্থা যেমন সরকার করবে৷ তেমনি নাগরিক হিসেবেও আমাদের দায়িত্ব আছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার৷''
কোরবানির অর্থনীতি
ধর্মীয় গুরুত্ব ছাড়াও বাংলাদেশে কোরবানির একটি বড় অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে৷ বিশেষ করে ভারত থেকে গরু আমদানি বন্ধের পর এটার গুরুত্ব আরো বেড়েছে৷ দেশে কোরবানিকে সামনে রেখে গরু পালন এবং তা বিক্রির বিশাল একটি গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে উঠেছে৷ এর সঙ্গে আছে চামড়া শিল্প৷ কোরবানির সময়ই দেশের ৮০ ভাগ পশুর চামড়া পাওয়া যায়৷ তাই অনলাইনে হোক বা কঠোর স্বাস্থ্য নিরপত্তা নিশ্চিত করে হোক, কোরবানির পশুর হাট এবং কোরবানি সচল রাখতে হবে বলে মনে অর্থনীতিবিদরা৷ সিপিডির অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘‘এর বাইরে কোরবানির সময়ই দেশে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে৷ ইদুল ফিতরের চেয়েও বেশি৷'' তারপরও কোভিডের কারণে এবার এবার বরাবরের চেয়ে পশু কম কোরবানি হতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
এখন চামড়া রপ্তানি বন্ধ আছে৷ চামড়াজাত পণ্যের চাহিদাও কমে গেছে৷ তাই এবার কোরবানির চামড়া নিয়ে সংকট হতে পারে৷ গতবার সংগ্রহ করা চামড়ার মধ্যে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার চামড়া অব্যহৃত রয়ে গেছে এখনো৷ সঠিক সিদ্ধান্ত না নিলে চামড়ার স্টক জমে যেতে পারে৷ তাই এবার ‘ওয়েট ব্লু' চামড়া রপ্তানির অনুমতি ও বাজার খোঁজা দরকার বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷
এবার চামড়া সংগ্রহ করাও বড় চ্যালেঞ্জ হবে৷ কারণ, চামড়ার বড় একটি অংশ সংগ্রহ করেন মৌসুমী ব্যাবসায়ীরা৷ কিন্তু করোনার কারণে তারা মাঠে খুব একটা নামবেন বলে মনে করেন না বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ৷ তিনি বলেন, ‘‘এবার পশু কোরবানিও ৩০-৩৫ ভাগ কম হবে করোনার কারণে৷''