দুই নেতাকে বহিষ্কারে কী বার্তা তৃণমূলের?
১১ জানুয়ারি ২০২৫অনেকদিন ধরেই দুই নেতা শান্তনু সেন ও আরাবুল ইসলামকে নিয়ে জল্পনা চলছিল৷ শেষমেশ তাদেরকে দল থেকে বহিস্কার করল তৃণমূল৷ শুক্রবার সন্ধ্যায় এই সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্য সহ-সভাপতি জয়প্রকাশ মজুমদার৷ কত দিনের জন্য তাদের সাসপেন্ড করা হয়েছে, তা বলা হয়নি৷
চিকিৎসক নেতা শান্তনু সেন শাসক দলের সাবেক সাংসদ৷ বেশ কিছুদিন ধরে দলীয় নেতৃত্বের টানাপোড়েন চলছিল৷ রাজ্যসভার সাংসদের মেয়াদ শেষের পরে শান্তনুকে আর টিকিট দেওয়া হয়নি৷ পরবর্তীতে লোকসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে তার নাম শোনা যাচ্ছিল৷ কিন্তু গত বছর শিকে ছেঁড়েনি৷ বরাহনগর বিধানসভা উপনির্বাচনেও টিকিট পেতে পারেন বলে হাওয়ায় ভাসছিল শান্তনুর নাম৷ উত্তর কলকাতার এই নেতার ভোটে লড়া হয়নি৷
তার উপর আরজি কর আন্দোলনের সময়ে সেখানে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মুখ খোলেন তিনি৷ পাশে দাঁড়ান শান্তনুর স্ত্রী, কলকাতা পুরসভার কাউন্সিলর কাকলি সেন৷ আরজি করের ঘটনাকে সামনে রেখে পথেও নামেন তারা৷ এতে অস্বস্তিতে পড়ে দল৷ আরো নড়বড়ে হয়ে যায় শান্তনুর অবস্থান৷
সম্প্রতি ডায়মন্ডহারবারে স্থানীয় সংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে চিকিৎসক সম্মেলনে উদ্যোক্তা ছিলেন শান্তনু সেন৷ গত ডিসেম্বর মাসে টানা সপ্তম বারের জন্য ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন শান্তনু৷ কিন্তু দলে নিজের পুরনো জায়গা ফিরে পাননি তিনি৷ টেলিভিশন চ্যানেলে প্রায় রোজ তাকে দেখা যেত দলের মুখপাত্র হিসেবে৷ সেই তালিকা থেকেও বাদ পড়েছেন চিকিৎসক নেতা৷ এবার একেবারে সাসপেনশনের মুখে পডলেন৷
এদিকে বাম আমলে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙর ও আরাবুল ইসলাম প্রায় সমার্থক হয়ে উঠেছিল৷ ভাঙরের বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি৷ ধীরে ধীরে পায়ের তলার মাটি হারাতে থাকেন নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়া আরাবুল৷ এর পাশাপাশি একই এলাকায় উঠে আসতে থাকেন অন্যান্য নেতারা৷
সাম্প্রতিক অতীতে আরাবুলের অবস্থান দলে একেবারেই নড়বড়ে হয়ে উঠেছিল৷ পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে বিরোধী দলের এক কর্মীর খুনের মামলায় আরাবুলের গ্রেপ্তারি দেখে বোঝা গিয়েছিল, তৃণমূলে তার দিন শেষ হয়ে আসছে৷ সূত্রের খবর, নির্বাচনে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা দূর করতে আরাবুলকে জেলে ভরা হয়েছিল৷ ভোট মিটতে আরাবুল জামিন পেয়ে যান৷
আরাবুলের বিপরীতে এক সময়ে শোনা যেত কাইজার আহমেদের নাম৷ পরে উঠে আসেন শওকত মোল্লা৷ এখন বিধায়ক শওকতের সঙ্গে আরাবুলের সর্ম্পক একেবারেই সাপে নেউলে৷ স্থানীয় রাজনীতির রাশ অনেকদিনই হল আরাবুলের হাতের বাইরে চলে গিয়েছে৷ সাসপেনশনের সিদ্ধান্তে এতে সিলমোহর পড়ে গেল৷ এর আগেও আরাবুলকে ছয় বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়৷ পরে অবশ্য সেই নির্দেশ প্রত্যাহার করা হয়েছিল৷ দলের কাজে আবার যোগ দিয়েছিলেন তিনি৷
দলের সিদ্ধান্ত জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শান্তনু৷ তিনি বলেন, ‘‘অনেকে বলছেন, আরজি কর নিয়ে আমি দলবিরোধী কাজ করেছি৷ আমাকে কেউ প্রমাণ করে দিক, আমি কোন দলবিরোধী কাজ করেছি৷ তা হলে আমার ক্ষমা চাইতে কোনও সমস্যা নেই৷’’
তৃণমূলের অন্দরে টানাপোড়েনের জেরে শান্তনু বিপাকে পড়লেন বলে অনেকে মনে করছেন৷ যদিও চিকিৎসক নেতা মানতে চাননি যে, তিনি অভিষেক শিবিরের অনুগত৷ বলেছেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার নেত্রী৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সংগঠন বড় করেছেন৷ দুজনের নির্দেশ মেনেই আমরা কাজ করি৷ বিরোধের প্রশ্ন নেই৷’’
তৃণমূল নিয়ে যে জল্পনাই থাকে না কেন, মমতার নেতৃত্ব প্রশ্নাতীত বলেই অনেকের মত৷ সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘তৃণমূলে ব্যক্তি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ৷ দলটা তৈরি হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সামনে রেখে৷ তিনিই সমস্ত ভোটব্যাংক৷ তিনি সমস্ত সিদ্ধান্ত নেন৷ লোকসভা নির্বাচনের পরে দলের পরিষদীয় বৈঠকে বা দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তিনি সেটা স্পষ্ট করেছেন৷ তিনি নিশ্চয়ই মনে করেছেন আরাবুল ইসলাম বা শান্তনু সেন দলের শৃঙ্খলাভঙ্গ করেছেন৷ আজকের পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে মমতা যদি মনে করেন, এ আমার দলের শৃঙ্খলাভঙ্গ করছে বা এই নেতা আরজিকর আন্দোলনের সময় বিরোধীদের মদত দিয়েছে, তা হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে৷ তৃণমূল দলটা এতটাই মমতা কেন্দ্রিক, তিনি যেহেতু সর্বময় নেত্রী, তিনি যা মনে করবেন সেটাই হবে৷’’
তিনি বলেন, ‘‘কেউ যদি ২৫ বছরের তৃণমূলের ইতিহাস দেখেন, তাহলে লক্ষ্য করবেন, সভাপতি থাকাকালীন পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায় মমতার বিরুদ্ধে মুখ খুলে হারিয়ে গিয়েছিলেন৷ তার থেকে অনেক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ছিলেন মুকুল রায়, তাকে বলা হতো তৃণমূলের চাণক্য৷ তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে৷’’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘একটা সময় আরাবুল বা শান্তনু সেন দলের সৎপাত্র হয়ে কাজ করেছে৷ এখন অনেক নতুন নেতার উৎপত্তি হয়েছে, ফলে অতীতের সৎপাত্র নেতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে৷ এরা থাকলে সেই সমস্ত নেতাদের কাজকর্মের অসুবিধা হচ্ছে৷ আমরা ভাঙরে দেখেছি, শওকত মোল্লার দাম আরাবুল ইসলামের থেকে অনেক বেশি৷ এই কারণে আরাবুলকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আরজি করের ঘটনায়শান্তনু সেনের তুলনায় সন্দীপ ঘোষ বেশি গুরুত্বপূর্ণ৷ এরা কোন কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে দলের কাছাকাছি এসে গেলেন, কতদিনের জন্য এবং কেন সাসপেন্ড করা হয়েছে, তা বলা হয়নি৷ এদের শুধু বার্তা দেয়া হয়েছে, এই মুহূর্তে তোমরা দলের কাছে অতটা প্রয়োজনীয় নও৷’’