1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

তিস্তা মহাপরিকল্পনায় চীন-ভারতের ভারসাম্য কীভাবে?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৪ জুন ২০২৪

তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারতের অংশগ্রহণের আগ্রহে বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে৷ চীনের প্রাথমিক সমীক্ষার পর এই আগ্রহকে ভারতের ভূরাজনৈতিক খেলা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ৷

https://p.dw.com/p/4hRPn
তিস্তা নদী (ফাইল ফটো)
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় ভারতের অংশগ্রহণের আগ্রহে বাংলাদেশের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জছবি: Prabhakar Mani Tewari

ভারত সফরের পর জুলাইতে চীন যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা৷ তারপরই বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে৷ প্রকল্পের ব্যাপারে চীন কী অবস্থান নেয় তার ওপরেই নির্ভর করবে এই প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশ দুই দেশের মধ্যে কীভাবে ভারসাম্য রক্ষা করবে৷

বিশ্লেষকেরা বলছেন, তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি না করে প্রকল্পের ব্যাপারে ভারতের এই আগ্রহের মধ্যে ভূরাজনীতি আছে৷

চীনের কাছে ঋণ

২১ ও ২২ জুন ভারত সফরের আগে ১২ জুন জাতীয় সংসদে কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য মো. হামিদুল হক খন্দকারের এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা মহাপরিকল্পনার সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরেন৷ তিনি জানান এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চীনের কাছে ঋণ চাওয়া হয়েছে৷

তিনি জানান, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) বৈদেশিক সাহায্য অনুসন্ধান কমিটির ৫১তম সভায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের স্বার্থে সহজ শর্তের ঋণ পেতে চীন সরকারকে অনুরোধ জানানোর সিদ্ধান্ত হয়৷ তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চীন সরকারের আর্থিক সহায়তায় সমীক্ষা সম্পন্ন করে প্রায় আট হাজার ২১০ কোটি টাকার পিডিপিপি (প্রিলিমিনারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল) ২০২০ সালের আগস্টে ইআরডিতে জমা দেয়৷

‘ভারত এই অঞ্চলে অন্য কারো সম্পৃক্ততা ভালো চোখে দেখে না’

শেখ হাসিনা বলেন, প্রকল্পটি পর্যায়ভিত্তিক বাস্তবায়নের জন্য চীন সরকার আরো বিশদ সমীক্ষার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছে৷ পাওয়ার চায়না কর্তৃপক্ষ চীন সরকারের নির্দেশনায় গত বছরের ২৭ আগস্ট ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট সংশোধনের প্রস্তাব বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে পাঠিয়েছে৷ এরই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে৷

মহাপকিল্পনা সম্পর্কে যা জানা যায়

বাংলাদেশ ২০১১ সাল থেকে ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদী তিস্তার পানিবন্টণ চুক্তি করতে চাইছে৷ কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের বার বার প্রতিশ্রুতির পরও ওই পানি চুক্তি হয়নি৷ ফলে শুষ্ক মৌসুমে পানি পায় না বাংলাদেশ৷ আর বর্ষাকালে বন্যায় ভেসে যায়৷ দেশের উত্তরাঞ্চলে এর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে৷ তারই সমাধান হিসেবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা সামনে আনে সরকার৷

চীনকে সঙ্গে নিয়ে এর কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে৷ গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রী রংপুর অঞ্চলের জনসাধারণের সামনে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন৷ পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে জানা গেছে, মহাপরিকল্পনায় উত্তরাঞ্চলের মানুষের জন্য তিস্তা নদী ঘিরে আট হাজার ২১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হচ্ছে৷ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীর দুই পাড়ে ২২০ কিলোমিটার গাইড বাঁধ নির্মাণ করা হবে৷ তিস্তার দুই পাড়ে পরিকল্পিত স্যাটেলাইট শহর, নদী খনন ও শাসন, ভাঙন প্রতিরোধ ব্যবস্থা, আধুনিক কৃষি সেচ ব্যবস্থা, মাছ চাষ প্রকল্প, পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন করা হবে৷ এতে সাত থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে৷

‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন' নামে এই প্রকল্পের নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রাথমিক কাজ শেষ করেছে চায়না পাওয়ার কোম্পানি৷ তিস্তা নদী পাড়ের নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুর ও গাইবান্ধায় তারা কাজ করেছেন৷

তিস্তার দুই পাড়ে গাইড বাঁধের দুই পাশে থাকবে সমুদ্র সৈকতের মতো মেরিন ড্রাইভ৷ যাতে পর্যটকরা লং ড্রাইভে যেতে পারেন৷ এছাড়া এই রাস্তা দিয়ে পণ্য পরিবহণ করা হবে৷ নদীপাড়ের দুইধারে গড়ে তোলা হবে হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পর্যটন নগরী৷ তবে পানি ও নদী বিশেষজ্ঞ এবং নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘‘তিস্তা মহাপরিকল্পনা কতটুকু কাজে আসবে বা বাস্তবায়ন হবে তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে৷ কারণ ভারত তিস্তার পানি না দিলে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে কী হবে৷ আগে দরকার তিস্তার পানি৷ আর যে অবকাঠামো নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে তা বর্ষা মৌসুমে টিকে থাকবে কিনা সন্দেহ৷ কারণ তখন নদী গভীর হলেও প্রশস্ততা কমে যাবে৷ তিন কিলোমিটার প্রস্থ নদী অনেক ছোট করা হবে বলে শুনেছি৷''

এই প্রকল্পে এখন ভারতের আগ্রহ নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি৷ বলেন, ‘‘তিস্তার পানি না দিয়ে ভারতের এই প্রকল্পে আগ্রহ কোনো ভালো উদ্দেশ্যে বলে আমার মনে হয় না৷ এখন ভারত বাংলাদেশকে নিয়ে চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে৷ আর সরকার আসলে এই প্রকল্পটি নিয়ে জনগণকে কিছু একটা দেখাতে চাচ্ছে৷ তারা তাদের স্বার্থেই কখনো চীন আবার কখনো ভারত করছে৷''

তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে চীন-ভারত বিতর্ক

তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে ভারত ও চীনের কুটনীতিকরা কথা বলছেন অনেক দিন ধরেই৷ চীনের সহায়তায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নে শুরুতে ভারতের আপত্তি ছিলো৷ কিন্তু ভারত এখন আপত্তি থেকে সরে গিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নে সহযোগী হতে চায়৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে তা আনুষ্ঠাকিভাবে জানানো হলো৷ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন ছাড়াও তিস্তা মহাপ্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷

দিল্লিতে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানান, বাংলাদেশে তিস্তা নদীর সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোচনার জন্য একটি কারিগরি দল শিগগিরই বাংলাদেশ সফর করবে৷ তিনি বলেন, ‘‘ভারত ও বাংলাদেশকে সংযুক্ত করেছে ৫৪টি নদী৷ বন্যা ব্যবস্থাপনা, আগাম সতর্কতা, পানীয় জলের প্রকল্পের ক্ষেত্রে আমরা সহযোগিতা করছি৷ ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানি চুক্তি নবায়নের বিষয়ে কারিগরি পর্যায়ের আলোচনা শুরুর সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি৷''

এদিকে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে গত ২১ ডিসেম্বর ঢাকায় এক সেমিনারে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, তার দেশ তিস্তা নদীর উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী৷ ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি৷

২৮ জানুয়ারি এই বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন বলেন, ‘‘চীন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র৷ তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের উন্নয়ন প্রকল্পে চীনের সঙ্গে কাজ নিয়ে প্রতিবেশী ভারত কোনো আপত্তি তুললে ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় পদক্ষেপ নেয়া হবে৷''

ভারসাম্য রক্ষায় কী করবে সরকার?

জুলাইয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে তিস্তা মহাপরিকল্পনা গুরুত্ব পাবে বলে জানা গেছে৷ কিন্তু এক্ষেত্রে দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য কীভাবে হবে? সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের সাবেক প্রধান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘‘ভারত তো আমাদের তিস্তার পানিই দিচ্ছে না৷ তারপরও যদি তিস্তা মহাপ্রকল্পে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে সরকার সেটা বিবেচনা করতে পারে৷ ...তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারতের আগ্রহ স্বাভাবিক এই কারণে যে তারা এই অঞ্চলে অন্য কারো সম্পৃক্ততা ভালো চোখে দেখে না৷ এজন্য তারা এখানে যুক্ত থাকতে চায়৷ আর তারা চাইলেই তো হবে না৷ আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলেছেন এটা দেশের মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী করা হবে৷ ভারত বা চীন বিষয় নয়, যারা এটা করতে পারে তাদের দিয়ে করানো হবে৷ আর এক দেশ থাকলে আরেক দেশ থাকতে পারবে না বিষয়টি সেরকমও নয়,'' বলেন তিনি৷

তিনি মনে করেন শেষ পর্যন্ত সরকার এ বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করবে৷ তবে সেটি কীভাবে হবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা যাবে না৷

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা মে মাসে যখন প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে ঢাকায় আসেন তখনো তিনি তিস্তা প্রকল্পে ভারতের অর্থায়নের আগ্রহের কথা জানান৷ এটা একটা বড় প্রকল্প পুরো তিস্তা নদীকে ম্যানেজ করা হবে এর মাধ্যমে৷ আমরা মনে হয় এখন যদি ভারত মাঝখানে আসে তাহলে বিষয়টি ঝুলে যাবে৷ চীনারা বিষয়টিকে কীভাবে নেবে আমি জানি না৷ প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের পর বোঝা যাবে৷''

তিনি বলেন, ‘‘সমস্যাটা তো হচ্ছে ভারত তিস্তার পানি না দেয়ায়৷ পানি দিলে তো আর এই প্রকল্পের হয়তো প্রয়োজন ছিল না৷ আর পানি না দেয়ায় আমরাও তো ভারতকে চাপ দিতে পারছি না৷ আমরা কি চাপ দিতে পারছি? তারা পানি না দিলেও তাদের তো কোনো স্বার্থ এখানে বিঘ্নিত হচ্ছে না৷ তারা যা চাইছে তার সবই তো পাচ্ছে৷''

তিস্তা প্রকল্প নিয়ে ভারত ও চীন দুই দেশকেই বাংলাদেশ কীভাবে সামলাবে? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘সম্ভব এভাবে যে যদি ভারত এখন তিস্তার ৪০ শতাংশ পানি দেয়, যদিও আমরা ৫০ শতাংশ চাই. তখন বাংলাদেশ চীনকে বলতে পারবে আপাতত আমাদের সমস্যা সমাধান হয়েছে৷ প্রকল্পটি আমরা পরে দেখব৷ এটা একটা তাত্ত্বিক আলোচনা আমার৷ যদিও বাস্তবে এটা কখনো সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি না৷''