1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘আগেভাগেই’ স্মার্ট হওয়ার লক্ষ্যে যাত্রা বাংলাদেশের

আজাদ মজুমদার
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণের আগেই বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণের নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ খাতের সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন৷

https://p.dw.com/p/4NvCf
সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে কয়েকজন শিশু মোবাইলে টিভি দেখছে৷
ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণের আগেই বাংলাদেশ স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণের নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা বলছেন৷ ছবি: Md Rafayat Haque Khan/ZUMA Wire/IMAGO

তারা বলছেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে তাদের নির্বাচনি ইশতেহারে ডিজিটাল বাংলাদেশ-২০২১ রূপকল্প ঘোষণা করলেও এর সুফল পুরোপুরি এখনো জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারেনি৷ 

তবে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এক্ষেত্রে অন্তত ৮০ ভাগ লক্ষ্য তাদের অর্জিত হয়েছে এবং সম্পদের সীমাবদ্ধতার জন্য যেটুকু এখনো অর্জন করা সম্ভব হয়নি, সরকারের নতুন পদক্ষেপ স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করা গেলে সেটুকুও অর্জন করা যাবে৷

‘‘পুরোটা হয়নি৷ কিছুতো চ্যালেঞ্জ আছে৷ আমরা কিন্তু বলছি না শত ভাগ করেছি,’’ বলেছেন হুমায়ূন কবির, প্রকল্প পরিচালক, এটুআই, প্রজেক্ট৷ অর্জনের এই অল্পবিস্তর ব্যর্থতার কারণ হিসেবে তিনি প্রযুক্তির ব্যয় এবং পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাবের কথা বলেছেন৷ পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, তাদের এমন কিছু অর্জন আছে যা এক সময় ভাবা যায়নি৷

পুরোটা হয়নি, কিছুতো চ্যালেঞ্জ আছে: হুমায়ূন কবির, প্রকল্প পরিচালক, এটুআই

রূপকল্প শুরুর পর গত দেড় দশকের অর্জনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, যেকোনো ডিজিটালাইজেশনে চারটা জিনিস লাগবে৷ প্রথমত কানেক্টিভিটি, অর্থাৎ ইন্টারনেট সংযোগ, দ্বিতীয়ত অ্যানালগ সার্ভিস গুলোকে ডিজিটালে রূপান্তর করা, অর্থাৎ ই গভর্ন্যান্স, তৃতীয়ত সার্ভিস নেওয়ার জন্য ডিভাইস এবং ফাইনালি যিনি সার্ভিস নেবেন এবং যিনি সার্ভিস দেবেন দুই পক্ষেরই সক্ষমতা৷ ‘‘রিয়েলিটি ছিল তখন ইন্টারনেট, যেটা বেসিক, এক পার্সেন্ট লোক ইন্টারনেটের সুবিধা পেতেন৷ সেটি এখন পৌঁছেছে ১৩ কোটিতে৷’’

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ এই এটুআই বা এসপায়ার টু ইনোভেশন প্রকল্পটিই নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের কাজে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে৷ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের এই প্রায় দেড় যুগের অভিযাত্রায় তথ্য প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণ ঘটেছে৷ প্রযুক্তিবান্ধব নানা ধরনের উদ্ভাবনের ফলে ১৩ বছরে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের সময় বেঁচেছে ১৩শ কোটি দিন, খরচ বেঁচেছে ১৬.৬২ বিলিয়ন ইউএস ডলার বা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা এবং ৬শ কোটি যাতায়াত ঘণ্টা হ্রাস পেয়েছে৷

জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দিতে বর্তমানে সারা দেশে প্রায় ৮ হাজার ৮০০টি ডিজিটাল সেন্টারে ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা কাজ করছেন, যার ৫০ শতাংশ হচ্ছেন নারী উদ্যোক্তা৷ এর ফলে বৈষম্য কমেছে৷ বর্তমানে ডিজিটাল সেন্টার থেকে প্রতি মাসে গড়ে ৭০ লাখের অধিক সরকারি-বেসরকারি সেবা প্রদান করা হচ্ছে বলে নিশ্চিত করেছেন প্রকল্প পরিচালক  হুমায়ূন কবির৷

তার বক্তব্য অনুসারে, পৃথিবীর সবচাইতে বড় ওয়েব পোর্টাল হচ্ছে ডাব্লিউ ডাব্লিউ ডট জিওভি ডট বিডি৷ প্রায় ৫২ হাজার সরকারি অফিসের তথ্য আছে এতে৷ এর মধ্যে পূর্ণাঙ্গ ওয়েবসাইটের সংখ্যা ৩৭ হাজার৷ বাকি ওয়েব সাইটগুলোর হাল নাগাদের কাজ ও প্রক্রিয়াধীন৷ এসব ওয়েবসাইট জনগণের সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়াকে সহজ করেছে বলে তিনি মনে করেন৷

তার দাবি, নানাবিধ সরকারি কার্যক্রমের পাশাপাশি এই ডিজিটাইজেশনের ফলে দেশের আর্থিক খাত গতিশীল হয়েছে৷ প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয় মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে৷ এটুআইয়ের সহযোগিতায় ৪,৫৩০টি ডিজিটাল সেন্টারে চালু করা হয় এজেন্ট ব্যাংকিং এবং বিগত কয়েক বছরে এই এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে৷

এসব অর্জনের পাশাপাশি নিজেদের যে সমস্ত ব্যর্থতা বাংলাদেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন এই কর্মকর্তা মেনে নিয়েছেন, তার মধ্যে রয়েছে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে এখনো সহজ না করতে পারা, প্রবাসীদের কিছু আইনগত জটিলতা সমাধান না করতে পারা, দুর্গম কিছু অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দিতে না পারা ইত্যাদি৷ ‘‘প্রচারে আমরা আরেকটু ভালো করলে পারতাম৷ আমরা অনেক কাজ করেছি যেসবের কথা নাগরিকরা হয়ত জানেন না৷’’

যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা অবশ্য আরো অনেক ব্যর্থতা তুলে ধরেছেন, যা সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ শ্লোগানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়৷ সরকার একাধিক হাইটেক পার্ক নির্মাণ করলেও সম্প্রতি স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় এসেছে এসব হাইটেক পার্কের কোনো কোনোটি এখন কমিউনিটি সেন্টার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে৷ রেলওয়ে টিকিট বিক্রির মতো সাধারণ একটি সেবাকেও এখনো ডিজিটালাইজড করা যায়নি৷ পাসপোর্ট অফিসের ভিড় নৈমিত্তিক ঘটনা৷ সরকারি নির্বাচিত কিছু হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোনো হাসপাতালের স্বাস্থ্য ডাটাও কর্তৃপক্ষের কাছে নেই৷ 

সরকারি অফিসে জনগণ যতদিন যেতে থাকবে ততদিন বুঝতে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি: আবু সাঈদ খান

কলম্বোভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক লার্ন এশিয়ার সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটর্স বাংলাদেশ-এর সাবেক মহা পরিচালক আবু সাঈদ খান বলেন, ‘‘ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে হচ্ছে সরকার জনগণের দরজায় যাবে৷ জনগণ সরকারের কাছে আসবে না সার্ভিস নেওয়ার জন্য৷ ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা এটাই বুঝি...এখনো সরকারি অফিসে দর্শনার্থী প্রবেশ নিষেধ কথাটা লেখা থাকে৷ সরকারি অফিসে কোনো দর্শনার্থী যায় না, সেখানে কোনো ফিল্ম স্টার থাকে না৷ মানুষ সরকারি অফিসে যায় তার নিজের যে কাজ আটকে আছে সেটা করানোর জন্য৷ সরকারি অফিসে জনগণ যতদিন যেতে থাকবে তার বিভিন্ন সেবার জন্য, ততদিন বুঝতে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ তার ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে৷’’

যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং এশিয়া প্যাসিফিক নেটওয়ার্ক ইনফর্মেশন সেন্টারের  নির্বাহী পরিষদের সদস্য সুমন আহমেদ সাবির বলেন, ‘‘এটা এখনো পরিষ্কার না সবার কাছে যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে আমরা আসলে কী চেয়েছিলাম, কী পেলাম৷ তবে আমি যদি ডেভেলপমেন্টর জায়গটা দেখি, আমাদের ইন্ফ্রাস্ট্রাকচারে একটা ভালো ডেভেলপমেন্ট হয়েছে আইসিটি সেক্টরে, অর্থাৎ কমিউনিকেশনের জায়গা থেকে...৷ কিন্তু এই ডিজিটালাইজেশনের উদ্দেশ্য কী আসলে? এটা করার আল্টিমেট উদ্দেশ্য হলো মানুষের জীবনযাত্রা সহজ হবে, একটা স্বচ্ছতা আসবে, যে কোনো কাজকর্ম করতে গেলে সব কিছু আগের চেয়ে অনেক সহজভাবে আমরা করতে পারবো, বা বাসায় বসে করতে পারবো৷ আমাদের অনলাইন ব্যাংকিং চালু হয়েছে, আমরা বাসায় বসে তা করতে পারছি সেটা একটা বড় ডেভেলপমেন্ট৷ কিন্তু এখনো যদি আপনি একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করতে যান, অন্য একজনকে আপনার পরিচয় শনাক্ত করতে হবে৷ আপনার কাছে দুনিয়ার কাগজ-পত্র চাইবে৷ বিদ্যুৎ বিলের কপি চাইবে৷ আগে যা ছিল, সেই সিস্টেমটা কিন্তু রয়েই গেছে৷ এই পরিবর্তনটা কিন্তু আমাদের হয়নি৷’’

পদ্মা ব্রিজের মতো বিশাল ব্রিজ বানিয়ে ফেললাম, কিন্তু টোল এখনো অটোমেটেড করতে পারলাম না: সুমন আহমেদ সাবির

জন্ম নিবন্ধন সনদের উদাহরণ দিয়ে তিনি আরো বলেছেন, শিশুর জন্মের পর হাসপাতাল থেকেই এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ থাকা উচিত যাতে এজন্য কাউকে স্থানীয় সরকার অফিসে ধর্ণা দিতে না হয়৷ ‘‘আমরা পদ্মা ব্রিজের মতো বিশাল একটা ব্রিজ বানিয়ে ফেললাম৷ কিন্তু পদ্মা ব্রিজের টোল এখনো অটোমেটেড করতে পারলাম না৷’’- বাংলাদেশের ডিজিটালাইজেশনের ব্যর্থতার স্মারক হিসেবে তিনি এ বিষয়টি উল্লেখ করেন৷

ডিজিটালাইজেশনের এই ঘাটতি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণাকে সামনে এনেছেন৷ গত ৭ এপ্রিল, ২০২২ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবতায় গঠিত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্স’-এর তৃতীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী সর্বপ্রথম ঘোষণা করেন ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় বাস্তবায়ন করা হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ৷

ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভার সিদ্ধান্তের প্রায় আট মাস পর গত ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবস-২০২২ পালনকালে শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন, ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ নির্মাণের৷ 

স্লোগান দিয়ে আমাদের উজ্জীবিত করতে হয়... অতিরিক্ত শ্লোগান আবার ভালো না: মোহাম্মদ কায়কোবাদ

‘‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের ঘোষণার পাশাপাশি চারটা পিলারের ওপর জোর দিয়েছেন৷ এই চারটা পিলারে আছে, সিটিজেনকে স্মার্ট হতে হবে, সরকারকে স্মার্ট হতে হবে, এর পাশাপাশি অর্থনীতি ও সমাজকে স্মার্ট হতে হবে, এখানে ব্যাসিক প্যারাডাইম শিফট হবে৷’’ - বলেছেন এটুআই প্রকল্প পরিচালক হুমায়ুন কবির৷ এ ধারণার আওতায় প্রত্যেক নাগরিককে একটি মৌলিক বা ইউনিক আইডি দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি৷ ‘‘এখন কারো আছে জন্মনিবন্ধন সনদ, কারো পাসপোর্ট, কারো ড্রাইভিং লাইসন্স৷ আমার সবাইকে একটা ইউনিক আইডি দেবো, এ বছরের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে যাবে৷ বিভিন্ন লেয়ারে একটা করে ডিজিট হয়ত যুক্ত হবে, কিন্তু আপনাকে এক নাম্বার দিয়ে সারা জীবন খুঁজে পাওয়া যাবে৷’’

স্মার্ট বাংলাদেশের এই স্লোগানকে স্বাগত জানালেও এর অতি ব্যবহার জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা একটি সীমিত সম্পদের দেশ৷ নানা রকম স্লোগান দিয়ে আমাদের উজ্জীবিত করা, উৎসাহিত করা, এগুলো করতে হয়...অতিরিক্ত শ্লোগান আবার ভালো না৷ এটা হলো অ্যান্টিবায়োটিকের মতো৷ যখন তখন অ্যান্টিবায়োটিক খেলে এটার কার্যকারিতা থাকবে না৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য