1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ডাচদের হারিয়ে সুপার এইটের পথে এক ধাপ

রাহেনুর ইসলাম
১৩ জুন ২০২৪

নেদারল্যান্ডসকে ২৫ রানে হারিয়ে সুপার এইটের পথে একধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। আগে ব্যাট করে বাংলাদেশ পায় ৫ উইকেটে ১৫৯ রানের পুঁজি। জবাবে নেদারল্যান্ডস থামে ৮ উইকেটে ১৩৪ রানে।

https://p.dw.com/p/4h0u2
সাকিব আল হাসান (ফাইল ফটো)
হার না মানা ৬৪ রানের ইনিংসে ম্যাচ সেরা সাকিব আল হাসানছবি: Adam Hunger/AP Photo/picture alliance

হার না মানা ৬৪ রানের ইনিংসে ম্যাচ সেরা সাকিব আল হাসান।

সেন্ট ভিনসেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক আবেগ জড়িয়ে। ২০০৪ সালে এই আর্নস ভেল স্টেডিয়ামেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে প্রথম ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। পাঁচ বছর পর দেশের বাইরে প্রথম টেস্টও জিতেছিল অগ্ন্যুৎপাত থেকে জন্ম নেওয়া এই শহরে। সুপার এইটে যেতে এই মাঠে দুই ম্যাচে নেদারল্যান্ডস ও নেপালকে হারানোর চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের। আজ প্রথম চ্যালেঞ্জে জিতল নাজমুল হোসেন শান্তর দল। ডাচদের তারা হারাল ২৫ রানে।

বিশ্বকাপে এর আগে ১৬০ রানের বেশি তাড়া করে দুবার জিতেছিল নেদারল্যান্ডস। এর একটি ২০১৪ বিশ্বকাপে। সেবার সুপার টেনে যেতে আয়ারল্যান্ডের ১৯০ রানের চ্যালেঞ্জ ১৪.২ ওভারে করতে হত ডাচদের, সেটা তারা করে ১৩.৫ ওভারে।

এবার বাংলাদেশের ১৫৯ রানের জবাবে ১০ ওভারে ৩ উইকেটে ৭৪ করে জয়ের ভিত পেয়ে ছিল তারা। পাল্লা দিয়ে রান তাড়া করা ডাচদের শেষ ৬ ওভারে দরকার ছিল ৫৬ রান, হাতে ৭ উইকেট। ১৫তম ওভারে জোড়া উইকেট নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেন রিশাদ হোসেন। এরপর রিশাদ ফেরান লোগান ফন বিককেও। দ্রুত উইকেট হারিয়ে চাপে পড়া ডাচদের জয়ের জন্য শেষ ২ ওভারে দরকার ছিল ৩৬ রান। স্কট এডওয়ার্ডসের দল করতে পারেনি সেটা।

এই জয়ে গ্রুপ ‘ডি' থেকে সুপার এইটের পথে একধাপ এগিয়ে গেল বাংলাদেশ। ৩ ম্যাচে ৬ পয়েন্ট নিয়ে এরই মধ্যে পরের রাউন্ড নিশ্চিত করেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। ৩ ম্যাচে ৪ পয়েন্ট নিয়ে বাংলাদেশ আছে দুইয়ে। বাংলাদেশ শেষ ম্যাচে খেলবে নেপালের বিপক্ষে আর আয়ারল্যান্ড মুখোমুখি হবে বিদায় নিশ্চিত হওয়া শ্রীলঙ্কার। শেষ ম্যাচে অভাবনীয় কিছু না ঘটলে সুপার এইটে খেলবে বাংলাদেশই।

আর্নস ভেল স্টেডিয়াম বিশ্বকাপের জন্য সেজেছে নতুন সাজে। এখানে ছেলেদের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়েছিল ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের ম্যাচ দিয়েই আর্নস ভেলে ফিরল ক্রিকেট। জয় দিয়ে সেটা স্মরণীয়ও করল বাংলাদেশ।

১৮ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়ামে গত ১০ বছরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো বটেই, হয়নি, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (সিপিএল) ম্যাচও নয়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ফ্লাডলাইটবিহীন একমাত্র আন্তর্জাতিক স্টেডিয়াম ছিল এটি। ৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার ব্যয়ে সংস্কার করা স্টেডিয়ামে বসানো হয়েছে ফ্লাডলাইট।

নতুন স্টেডিয়ামের পিচ নিয়ে ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজের (সিডাব্লিউআই) প্রধান পিচ কিউরেটর কেন ক্রাফটন ম্যাচের আগে জানিয়েছিলেন,‘‘ ধারাবাহিক বাউন্স ও পেস থাকায় বল ব্যাটে আসার কথা ভালোভাবে।'' সেটা হয়নি, পিচে বাউন্স ছিল অসমান।

এমন পিচে টস হেরে ব্যাট করা বাংলাদেশের ওপেনিং জুটি টিকেছে কেবল ৮ বল। অফ স্পিনার আরিয়ান দত্তকে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে স্লিপে বিক্রমজিৎ সিংকে ক্যাচ দেন বাংলাদেশ অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। প্রথম দুই ম্যাচে ৭ ও ১৪ রানের পর আজ ফিরলেন ১ রানে। তেয়া নিদামাউনরুর বদলে বোলিং শক্তি বাড়াতে ডাচরা খেলায় আরিয়ান দত্তকে।

নিজের প্রথম ওভারেই শান্তকে ফিরিয়ে আস্থার প্রতিদান দেন তিনি। নিজের দ্বিতীয় ওভারে আরিয়ান ফেরান ছন্দ হারানো লিটন দাসকেও (১ রান)। তাকে স্লগ সুইপ করতে গিয়েছিলেন লিটন। স্কয়ার লেগ থেকে মিডউইকেটের দিকে ছুটে ডাইভ দিয়ে দারুণ ক্যাচ নেন সিব্রান্ড এঙ্গেলব্রেখট। ২০০৮ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে খেলা এঙ্গেলব্রেখট স্মরণীয় হয়েছিলেন পাপুয়া নিউগিনির বিপক্ষে অসাধারণ এক ক্যাচ নিয়ে। জাতীয়তা বদলে তিনি এখন ডাচ ক্রিকেটার।

লিটন ফেরার আগের ওভারেই তানজিদ হাসান তামিম দুই বাউন্ডারি এক ছক্কায় ১৮ রান নিয়েছিলেন ভিভ কিংমার ওভারে। পঞ্চম বলটা টপ-এজড হয়ে হেলমেটের গ্রিলে আটকে যাওয়ায় কনকাশন পরীক্ষার পর ক্রিজে গিয়েই মারেন বাউন্ডারি।

রিশাদ (ফাইল ফটো)
সতীর্থদের সঙ্গে এ ম্যাচে ৩৩ রানে ৩ উইকেট নেয়া রিশাদ (ফাইল ফটো)ছবি: Adam Hunger/AP Photo/picture alliance

মাঠের পাশে থাকা সমুদ্রের জন্য এখানে ঘণ্টায় বাতাসের গতিবেগ ছিল প্রায় ২০ কিলোমিটার। সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহ ছাড়া বাংলাদেশের এই দলে কারও অভিজ্ঞতা ছিল না এমন কন্ডিশনে ব্যাটিংয়ের। সেই অভিজ্ঞতাতেই সাকিব যেমন রানে ফিরেছেন তেমনি টিপস দিয়ে সাহসী ব্যাটিং করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন ‘ছোট তামিম' তানজিদকে। দুজন তৃতীয় উইকেটে গড়েন ৪৮ রানের জুটি।

পাওয়ার প্লেতে বাংলাদেশ ২ উইকেটে করেছিল ৫৪ রান। ষষ্ঠ ওভারে লোগান ফন বিক দেন ১৯ রান। চারটে চারসহ এর ১৮ রান নেন সাকিব আর ১টি ছিল ওয়াইড। তবে ভাগ্য সঙ্গে ছিল তার। সেই ওভারে টপ এজ আর আউট সাইডএজ হয়েও পেয়েছেন টানা দুটি বাউন্ডারি।

তানজিদ নবম ওভারে ফিরেন পল ফন মিকেরনের শর্ট বলে পুল করতে গিয়ে মিডউইকেটে বাস ডি লিডিকে ক্যাচ দিয়ে। মাঠে যে দিকে বাতাস প্রবাহ তার উল্টো দিকে মারায় বল এগোয়নি বেশি দূর। ২৬ বলে ৫ বাউন্ডারি ১ ছক্কায় ৩৫ করেন তিনি। ১০ ওভার শেষে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ৭৬।

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি সবশেষ ১৯ ইনিংস আগে ফিফটি করা সাকিবের ফর্ম নিয়ে সমালোচনা হয়েছে অনেক। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ ওভার আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বল করেছিলেন কেবল ১ ওভার। ব্যাটে রান খরা চলায় তাতে সমালোচনা বাড়ে আরও। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সবসময় দুহাত ভরে দিয়েছে সাকিবকে।

দেশের বাইরে আজকের আগে যৌথ সর্বোচ্চ ২১৩ রান ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জেই করেছিলেন তিনি (নিউজিল্যান্ডের মাটিতেও ২১৩ রান)। আজকের হার না মানা ৬৪ রানের ইনিংসে দেশের বাইরে সাকিবের সবচেয়ে বেশি ২৭৭ টি-টোয়েন্টি রান এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ৪৬ বলে ৯ বাউন্ডারিতে শেষ পর্যন্ত অপরাজিত ছিলেন তিনি।

সাকিব ছন্দে ফিরলেও প্রথম দুই ম্যাচে দাপটে ব্যাট করা তাওহিদ হৃদয় ছিলেন বিবর্ণ। ১৫ বলে ৯ করে বোল্ড হন তিনি। বাঁহাতি স্পিনার টিম প্রিঙ্গলের বলে কাট করতে গিয়ে হৃদয়ের ব্যাটে লেগে বল আঘাত করে স্টাম্পে।

মাহমুদউল্লাহ ২১ বলে ২ বাউন্ডারি ২ ছক্কায় করেন ২৫। আগের ম্যাচ এক মিটারের জন্য ছক্কা মারতে না পারার আক্ষেপে পুড়ে বাংলাদেশকে জেতাতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ। আজও পল ফন মিকেরনের বলে এক মিটারের আক্ষেপে ছক্কা না পেয়ে ফিরেন সিব্রান্ড এঙ্গেলব্রেখটকে ক্যাচ দিয়ে।

জাকের আলী অপরাজিত ছিলেন ৭ বলে ১৪ রানে। ৪ ওভারে ১৭ রানে ২ উইকেট আরিয়ান দত্তের। আর ৪ ওভারে ১৫ রানে ২ উইকেট নেন পল ফন মিকরেন।

নেদারল্যান্ডসের কোচিং স্টাফে আছেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান কোচ রাসেল ডোমিঙ্গো আর ফিল্ডিং কোচ রায়ান কুক। তারা দুজন পেন্ডোরার বাক্স খুলে দলের ভেতরের সব রহস্য জানিয়েছেন ডাচদের। তাতেই হয়ত কঠিন পিচে পাওয়ার প্লেতে ২ উইকেটে ৩৬ করেছিল ডাচরা।

ইনিংসের প্রথম বলে মাইকেল লেভিটের বিপক্ষে এলবিডাব্লিউর আবেদন করেছিলেন তাসকিন আহমেদ। আম্পায়ার সাড়া দেননি। পঞ্চম ওভারে সেই তাসকিনই ফেরান এই ওপেনারকে। কাভারের ওপর দিয়ে মারতে গিয়ে তাওহিদ হৃদয়কে ক্যাচ দেন ১৬ বলে ১৮ করা লেভিট। অপর ওপেনার ম্যাক্স ও'ডাউড (১২ রান) রিটার্ন ক্যাচ দিয়ে ফিরেন তানজিম হাসান সাকিবকে।

পাওয়ার প্লেতে ২ উইকেট হারানোর পর পাল্টা আক্রমণে রানের গতি বাড়িয়ে নেন বিক্রমজিৎ সিং। সপ্তম ওভারে সাকিব আল হাসানকে টানা দুটি ছক্কা মেরেছিলেন তিনি। অপর স্পিনার রিশাদ হোসেন নিজের প্রথম ওভারে দেন ১৪ রান। ডাচ দুই স্পিনার ছড়ি ঘোরালেও বাংলাদেশের দুই স্পিনারকে সহজেই খেলেছে তারা।

শেষ পর্যন্ত অপর স্পিনার মাহমুদউল্লাহ ভাঙেন বিক্রমজিৎ সিং ও সিব্রান্ড এঙ্গেলব্রেখটের ২৩ বলে ৩৭ রানের জুটি। ডাউন দ্য উইকেটে ছক্কা মারতে গিয়ে স্টাম্পিং হন ১৬ বলে ৩ ছক্কায় ২৬ করা বিক্রমজিৎ।

এঙ্গেলব্রেখট ও অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস চতুর্থ উইকেটে ৪২ রানের জুটি গড়ে ম্যাচে ভালোভাবে রেখেছিলেন ডাচদের। ২২ বলে ৩৩ করা এঙ্গেলব্রেখটকে তানজিমের ক্যাচ বানিয়ে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা জুটিটা ভাঙেন রিশাদ হোসেন। শেষ দিকে চোখ বন্ধ করে ফেললেও বলটি হাতছাড়া হয়নি তার। একই ওভারে বাস ডি লিডিও ফিরেন স্টাম্পিং হয়ে। রিশাদের টার্নে তিনি (০) পরাস্ত হলে দ্রুতগতিতে স্টাম্প ভাঙতে ভুল করেননি লিটন।

ভরসা হয়ে থাকা অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডসকে (২৫ রান) ফেরান মোস্তাফিজুর রহমান। এরপরই ম্যাচ থেকে ছিটকে যায় ডাচরা। শেষ দিকে আরিয়ান দত্ত ১২ বলে ১৫ করে হারের ব্যবধানই কমিয়েছেন শুধু।

নেদারল্যান্ডস গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে হারিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা আর জিম্বাবুয়েকে। ২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে হারিয়েছে বাংলাদেশকেও। তবে এবার তাদের চমক থামাল বাংলাদেশ। রিশাদ ৩৩ রানে ৩টি ও তাসকিন আহমেদ নেন ৩০ রানে ২ উইকেট। ১টি করে উইকেট মোস্তাফিজুর রহমান, তানজিম হাসান ও মাহমুদউল্লার।

বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচে ৪ ওভার করে বল করেননি সাকিব আল হাসান। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩ ওভার আর দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে করেন ১ ওভার। ব্যাট হাতেও ব্যর্থ। তাই বীরেন্দর শেবাগ বলেছিলেন নিজ থেকে অবসর নিতে। আজ ব্যাট হাতে পারফর্ম করা সাকিব বোলিংয়ে উইকেট না পেলেও ৪ ওভারে দেন ২৯ রান। অভিজ্ঞতার সবটুকু উজার করে বাংলাদেশের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেন টানা নবম বিশ্বকাপ খেলা এই অলরাউন্ডার।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৫৯/৫ (তানজিদ ৩৫, সাকিব ৬৪*, মাহমুদউল্লাহ ২৫, জাকের ১৪*; আরিয়ান ৪-০-১৭-২, মেকেরেন ৪-০-১৫-২,প্রিঙ্গেল ৩-০-২৬-১)

নেদারল্যান্ডস: ২০ ওভারে ১৩৪/৮ (ভিক্রাম ২৬, এঙ্গেলব্রেশট ৩৩, এডওয়ার্ডস ২৫, আরিয়ান ১৫*; মুস্তাফিজ ৪-০-১২-১, তানজিম ৩-০-২৩-১, তাসকিন ৪-০-৩০-২, সাকিব ৪-০-২৯-০, রিশাদ ৪-০-৩৩-৩, মাহমুদউল্লাহ ১-০-৬-১)

ফল: বাংলাদেশ ২৫ রানে জয়ী

ম্যান অব দা ম্যাচ: সাকিব আল হাসান

রাহেনুর ইসলাম সাংবাদিক