জার্মানিতে গড়ে তোলা হচ্ছে ‘ডিজিটাল তথ্যভাণ্ডার'
৭ মার্চ ২০১১‘কপি-পেস্ট' প্রতিরোধের হাতিয়ার
ক'দিন আগে পর্যন্ত এক রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি নিয়ে গোটা জার্মানি উত্তাল হয়ে উঠেছিল৷ ডক্টরেট থিসিসের অংশবিশেষ অবৈধভাবে নকল করার অভিযোগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে হয় তারকা-রাজনীতিক বলে পরিচিত কার্ল টেওডোর সু গুটেনব্যার্গ'কে৷ ছাপা অক্ষর নকল করা আজকাল কোনো সমস্যাই নয়৷ ওয়েবসাইট অথবা যে কোনো টেস্ট ফাইলের পছন্দমতো অংশ ‘কপি' করে তা অন্য কোথাও ‘পেস্ট' করলেই হলো৷ প্রয়োজনে ফরম্যাটে শুধু কিছু রদবদল করে নিতে হয়৷ কিন্তু কখন কে অবৈধভাবে নকল করে ফেলবে – এমন আশঙ্কায় ইন্টারনেট থেকে সব লেখা সরিয়ে দেওয়া নিশ্চয় বাস্তবসম্মত সমাধান হতে পারে না৷ তাহলে উপায় কী?
এমনই এক সমাধানসূত্র নিয়ে এসেছে জার্মানির বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রাউনহোফার ইন্সটিটিউট৷ এমন প্রতিষ্ঠান বোধহয় দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই, যা মৌলিক গবেষণা দ্রুত পৌঁছে দিয়ে চলেছে বাজারের উপযুক্ত পণ্য ও পরিষেবার আকারে৷ ফ্রাউনহোফার ছাড়া এমপিথ্রি সাউন্ড ফাইলের অস্তিত্ব থাকতো কি না সন্দেহ৷ যাই হোক, ডিজিটাল গ্রন্থাগার গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অভিনব এক প্রযুক্তি সৃষ্টি করেছে এই প্রতিষ্ঠান৷ সংবাদপত্র, পত্রিকা বা ইন্টারনেটে প্রকাশিত অন্যান্য লেখার নকল করলে তেমন কোনো বড় ক্ষতির আশঙ্কা থাকে না৷ কিন্তু বিভিন্ন গ্রন্থাগার বা অন্যান্য শিক্ষা গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রক্ষিত দুষ্প্রাপ্য বই ও পান্ডুলিপির ক্ষেত্রে বাড়তি সাবধানতার প্রয়োজন হয়ে পড়ে বৈকি৷ এতকাল নকলের ভয়ে এমন সব বইপত্র ডিজিটাল রূপে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ দেখা যায় নি৷
বইপত্রের ‘ডিজিট্যালিকরণ'
ফ্রাউনহোফার ‘কন্টেনটাস' নামের প্রকল্পের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানসূত্র তুলে ধরেছে৷ এই প্রকল্পের একাধিক দিক রয়েছে৷ বিশেষ স্ক্যানার ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে অত্যন্ত দ্রুত একটা গোটা বইয়ের ডিজিট্যাল সংস্করণ তৈরি হচ্ছে৷ এমনকি পুরানো বইয়ের কোনো পাতার পিছনের অংশ অস্পষ্ট দেখা গেলেও তা ফিল্টার করার ব্যবস্থাও রয়েছে৷ অস্পষ্ট অক্ষরও সংশোধন করে ‘পড়ে ফেলার' ক্ষমতা রাখে এই সফটওয়্যার৷ প্রক্রিয়া শেষ হলে গোটা বইয়ের টেক্সট যে কোনো ডিজিট্যাল টেক্সট'এর মতো পড়ে ফেলা সম্ভব৷ তবে সেই টেক্সট যাতে কেউ নকল করতে না পারে, তার ব্যবস্থাও রয়েছে৷ এমনকি এই রক্ষাকবচ চালু থাকলে মনিটরের পর্দার ছবি বা ‘স্ক্রিনশট' তৈরি করাও সম্ভব নয়৷ এভাবে গ্রন্থাগারের পুরানো বই যেভাবে হাতে নিয়ে শুধু পড়া যায়, ঠিক তেমনটাই সম্ভব হচ্ছে ভারচুয়াল ডিজিটাল জগতে৷ বই ছাড়াও ছবি, অডিও, ভিডিও নিরাপদে সংরক্ষণ করা সম্ভব এই প্রযুক্তির মাধ্যমে৷
জাতীয় তথ্যভাণ্ডার
পুরানো বইপত্র ও অন্যান্য সামগ্রীর সংরক্ষণের এই পদ্ধতি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্খী এক প্রকল্পের জন্ম দিয়েছে৷ ফ্রাউনহোফার'এর এই প্রযুক্তির কল্যাণে শুরু হয়েছে এক প্রকল্প, যার নাম ‘জার্মান ডিজিট্যাল লাইব্রেরি'৷ এর আওতায় গোটা জার্মানিতে ছড়িয়ে থাকা দুষ্প্রাপ্য বইপত্র, ছবি, মানচিত্র ইত্যাদি এক একে ডিজিট্যাল রূপে রূপান্তরিত করে একটি ইন্টারনেট পোর্টাল ওয়েবসাইটে রাখা হচ্ছে৷ চলতি বছরের শেষেই এই বিশাল তথ্যভাণ্ডারের একটা প্রাথমিক সংকলন প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার কথা৷ শুধু পাশাপাশি তথ্য জমা করা নয়, বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে সংযোগেরও ব্যবস্থা থাকবে এই কাঠামোর মধ্যে৷ যেমন মিউজিয়ামে রাখা কোনো বিখ্যাত ছবি দেখতে চাইলে পর্দায় সেই ছবির পাশাপাশি ফুটে উঠবে ছবি সম্পর্কে অন্যান্য তথ্য, শিল্পীর আঁকা বাকি ছবির সন্ধান ইত্যাদি তথ্য৷ এই ‘ভারচুয়াল' জগতের কল্যাণে জার্মানির প্রায় সব গ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালাই চলে আসবে সাধারণ মানুষের নাগালে৷ সশরীরে না গিয়েও স্বাদ পাওয়া যাবে বই, ছবি সহ নানা রকমের সম্পদের৷
এতো গেল পুরানো দিনের বইপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী ডিজিটাল পদ্ধতিতে রূপান্তরের কথা৷ ইন্টারনেটে যে বিপুল তথ্যভাণ্ডার রয়েছে এবং প্রতিনিয়ত যোগ হয়ে চলেছে, কীভাবে সেই বিচ্ছিন্ন তথ্যের মধ্যে সংযোগ তৈরি করা সম্ভব? ফ্রাউনহোফার'এর ‘কন্টেনটাস' প্রকল্পের আওতায় এক পদ্ধতি ঠিক এমনটাই করতে পারছে৷ ইন্টারনেটের ব্রাউজারে বিশেষ একটি বাড়তি গুণ যোগ করলেই হবে৷ তারপর যেকোনো ওয়েবসাইট চালু করে একটি বোতামে ক্লিক করলেই হলো৷ কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওয়েবসাইটের পাতায় রাখা সব তথ্য বিশ্লেষণ করে এই ‘টুল' এমন সব শব্দ বা বাক্যের অংশ চিহ্নিত করবে, যা সম্পর্কে বাড়তি তথ্য দেওয়া সম্ভব৷ শুধু বিচ্ছিন্ন শব্দ নয়, লেখার প্রেক্ষাপটও বুঝতে সক্ষম এই ‘টুল'৷ যেমন একই নামের দুই বিখ্যাত ব্যক্তি থাকলে ওয়েবসাইটের পাতায় ঠিক কার উল্লেখ করা হয়েছে, তা বুঝে নেওয়া সম্ভব৷ শব্দের পেছনে বিভিন্ন রঙের সাহায্যে আলাদা আলাদা ধরণের তথ্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করা হয়৷
প্রতিবেদন: সঞ্জীব বর্মন
সম্পাদনা: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী