চাকরি শুরুর বয়স : ভারত-পাকিস্তানের চেয়েও ‘পিছিয়ে' বাংলাদেশ
৮ মে ২০২৪বাংলাদেশে এখন কিছু ব্যতিক্রম বাদে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছর আর অবসরের বয়স ৫৯ বছর। ১০ বছর ধরে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর আন্দোলন হচ্ছে। এই আন্দোলন করতে গিয়ে অতীতে আন্দোলনকারীরা জেলেও গিয়েছেন।
সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করার সুপারিশ জানিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে একটি চিঠি দেন। কিন্তু সোমবার সংসদে জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন," সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর চিন্তা আপাতত সরকারের নেই।” তিনি আরো বলেন, "২২-২৩ বছর থেকেই বিসিএস পরীক্ষায় চাকরি প্রার্থীরা এখন অংশ নিতে পারে। তারা ছয়-সাত বছর সময় পান।”
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ভারতে ৩৫ বছর এবং রাজ্য ভেদে ৪৫ বছর পর্যন্ত। শ্রীলঙ্কায় ৪৫ বছর। পকিস্তানেও ৩৫ বছর। সেখানেও প্রদেশভেদে ৪০-৪৫ বছরও আছে।
বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু এখন ৭২ বছর। বেকারত্ব বাড়ছে। বর্তমানে দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার আছেন। ২০২৩ সাল শেষে বেকারের সংখ্যা ছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার। এর মানে গত বছরের তুলনায় এখন দেশে বেকারের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) গত ৬ মে এই তথ্য প্রকাশ করেছে।
উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সেশনজট কমলেও তা এখনো আছে। সবচেয়ে বেশি আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
চাকরিতে আবেদনের বয়স সীমা ৩৫ করার পক্ষে শিক্ষার্থী সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক মো. শরিফুল হাসান শুভ ডয়চে ভেলেকে বলেন,"এখনো অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশন জ্যাম আছে। তাই সবাই সরকারি চাকরিতে আবেদনের সমান সময় পায় না। ফলে এখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নাই। আর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। তখন চাকরির বয়স বাড়িয়ে ২৭ থেকে ৩০ করা হয়। এখন গড় আয়ু ৭২ বছর। সেই বিবেচনায় আমরা ৩৫ বছর চাইছি। ”
তিনি বলেন, "আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর। কোথাও কোথাও ৪৭ বছর। এছাড়া করোনার সময় নিয়োগ বন্ধ থাকার পরও পরে সেটার পুরো সুবিধা দেয়া হয়নি। ফলে যৌক্তিক কারণেই আমরা বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি করছি। আমরা নীতিগতভাবে অবসরের বয়স বাড়ানোরও পক্ষে।”
বাংলাদেশে এখন তরুণ জনগোষ্ঠী সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম নুরুন্নবী বলেন, "এখন আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সময় চলছে। তরুণ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু আমাদের নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে বাড়ছে। তরুণ কমবে এবং বৃদ্ধ বাড়বে। তাই আমাদের বয়স্কদের অভিজ্ঞতা যেমন কাজে লাগাতে হবে তেমনি তরুণ জনগোষ্ঠী কমলে তারও বিকল্প ভাবতে হবে। ২০৪৭ সাল নাগাদ এই পরিস্থিতি প্রকট হবে।”
"তাই আমি মনে করি, চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা যেমন বাড়াতে হবে, অবসরের সময়ও বাড়াতে হবে। প্রবেশে পাঁচ বছর বাড়ানো হলে অবসরেও পাঁচ বছর বাড়ানো যায়,” বলেন তিনি। তার কথা, "বিশ্বের অনেক দেশে এখন আর চাকরিতে প্রবেশের কোনো সময়সীমা নাই। যে-কেনো বয়সে সরকারি চাকরি করা যায়। আমাদের আশপাশের দেশেও এখন ৩৫ বছর।”
তবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর ক্ষেত্রে সেশন-জট নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, "এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ এক বছরের সেশন জট আছে। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও তেমন নাই। করোনার সময় যে সংকট হয়েছিল, তা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, ক্লাস শুরু, ফল প্রকাশ এতে বেশ সময় লেগে যায়। আবার এসএসসি, এইচএসসিতেও কিন্তু বাড়তি সময় যায়। এগুলো যদি একটি অভিন্ন ব্যবস্থার অধীনে আনা যায়, তাহলে এক সময় সেশন জট থাকবে না।”
তবে তিনি মনে করেন, "এখন স্নাতক পাস করার পর সরকারি চাকরির জন্য যথেষ্ট সময় থাকে। আসলে সরকারি চাকরি করার জন্য এই বয়স বাড়ানোর দাবি। এতে যেটা হবে ৩৫ বছর পর্যন্ত শুধু সরকারি চাকরিরই চেষ্টা করবে তরুণরা। পরে তারা হতাশ হয়ে পড়বে। তারা উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করবে না, সৃজনশীল কাজ করবে না। এখনই দেখা যাচ্ছে ক্লাসের পড়া বাদ দিয়ে তরুণদের একটি অংশ বিসিএসের পড়াশুনা করে।”
তবে ৩৫ বছর আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কারী মো. খোকন মিয়া বলেন,"ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় , বুয়েটসহ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেশন জট কমলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আগের মতোই আছে। আর আগে ছিল পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক জট। আর এখন ডিপার্টমেন্টভিত্তিক জট আছে।”
তার কথা, "সেশন-জট মূল বিষয় নয়। সার্কভুক্ত কোনো দেশেই এখন আর ৩০ বছর নেই- ৩৫ বছর। আমাদের এখানে কেন ৩৫ হবে না?”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মনে করেন," সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে। কারুর যদি যোগ্যতা থাকে, তাহলে যে-কোনো বয়সে চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ দেয়া উচিত। এই সময়সীমা বেঁধে দেয়ার মাধ্যমে একটি এলিট শ্রেণি তৈরি করা হচ্ছে। অন্য পেশার মানুষ চাইলেও একটা সময়ে সরকারি প্রশাসনে যেতে পারেন না।” তিনি বলেন,"এরশাদ সরকার বিশেষ বিসিএসের ব্যবস্থা করেছিল। ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত ওই সময়ে বিসিএস পরীক্ষার সুযোগ দেয়া হয়। সেই বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে অনেকে প্রশাসনের শীর্ষ পদে গেছেন। কেবিনেট সেক্রেটারি পর্যন্ত হয়েছেন।”
একই ধরনের কথা বলেন সাবেক সচিব মো. আব্দুল মান্নান। তার কথা," শুধু গড় আয়ু বেড়ে যাওয়া নয়, আরো অনেক কারণে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো উচিত। অবসরের বয়সও বাড়ানো উচিত। এটা করা হলে সিভিল সার্ভিস অভিজ্ঞ লোককে যেমন কাজে লাগাতে পারবে, তেমনি তরুণরা আরো সুযোগ পাবে।” এতে বেকারত্ব বাড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন," বেকারত্ব একটি সার্বিক বিষয়, সরকারি চাকরি দিয়ে তো আর বেকারত্ব কমানো যাবে না।”
তবে জনপ্রশাসন ও শিক্ষামন্ত্রী জাতীয় সংসদে আগেই বলে রেখেছেন," শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে আমরা একটি চিঠি ইতোমধ্যে পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরো আলাপ-আলোচনা করবো। আপাতত চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত আমাদের সিদ্ধান্ত নাই। এটা নিয়ে আরো আলোচনা-পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে দেখবো।”
দেশে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা ১৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯২৭ জন। এর মধ্যে নারী ৪ লাখ ৪ হাজার ৫৯১ জন, যা মোট সরকারি চাকরিজীবীর প্রায় ২৬ শতাংশ। আর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ ও অধিদপ্তরে ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি পদ শূন্য আছে।