‘ঘৃণা' ছড়ালে লাভ হয় ক্ষমতাবান বা বিশেষ গোষ্ঠীর
২৭ মার্চ ২০১৮ঘটনা এক
ক'দিন আগেই ড. জাফর ইকবালের ওপর হামলা হলো৷ ধরা পড়লেন হামলাকারী৷ প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে হামলাকারী দাবি করলেন যে, অধ্যাপক ইকবাল ইসলামবিদ্বেষী৷ তাই তাঁর ওপর হামলা করা হলো৷
এই ঘটনায় সামাজিক গণমাধ্যমজুড়ে ব্যাপক ক্ষোভ দেখা গেল৷ বেশিরভাগ মানুষই ঘটনায় নিন্দা প্রকাশ করেছেন৷ কিন্তু এর বাইরেও অনেকে এই ঘটনা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থনও করেছেন৷ অনেকেই ড. জাফর ইকবালকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্যও করেছেন৷
ঘটনা দুই
২০১৭ সালের নভেম্বরে ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তির ঘটনাকে কেন্দ্র করে রংপুরে পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে৷
টিটু রায় নামে জনৈক ব্যক্তি যিনি ফেসবুকে ধর্মীয় কটূক্তি করেছেন বলে ছড়ানো হয়, দেখা যায়, তিনি রংপুরেই থাকেন না পাঁচ বছর ধরে৷ থাকেন ঢাকায়৷ আর পড়াশুনা জানেন না৷ ফেসবুকে এমন কটূক্তি তাঁর পক্ষে করা সম্ভব নয়৷
অথচ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷ এ সময় পুলিশ ও সংঘবদ্ধ দুর্বৃত্তদের ধাওয়া-পালটা ধাওয়া ও সংঘর্ষে এক যুবক নিহতও হন৷ আহত হন অর্ধশতাধিক৷
দেশে এমন ঘটনা নতুন নয়৷ ২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগরে প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে৷ ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধমন্দির পোড়ানো হয়৷ সবগুলো ঘটনাতেই ফেসবুকে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর পোড়ানো, মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া হয়৷
ঘটনা তিন
২০১৬ সালের আগষ্টে কলকাতার নজরুল মঞ্চে ছিল ‘স্বাধীনতা কনসার্ট'৷ সেখানে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিল বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড মাইলস৷ কলকাতার ব্যান্ড ফসিলসেরও সেখানে গান গাওয়ার কথা ছিল৷
কিন্তু হঠাৎ করেই বেঁকে বসলেন ফসিলসের ভোকাল রূপম ইসলাম৷ মাইলসের শাফিন ও হামিন আহমেদের ‘ভারতবিরোধী' বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে এক মঞ্চে না গাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি৷ এ নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিলেন৷
এরপর মাইলসের সদস্যরাও রূপমের ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা' নিয়ে প্রশ্ন তোলেন৷ দুই পক্ষের বিদ্বেষ দুই বাংলার অনেকের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে৷ এই অবস্থা চলতে থাকে বেশ কিছুদিন৷
ঘটনা চার
চলচ্চিত্র নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব' চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ৷ এই চলচ্চিত্রটি হুমায়ুন আহমেদের জীবনের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ ছিল হুমায়ূনপত্নী মেহের আফরোজ শাওনের৷ সেই বিতর্কের জেরে শাওনের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে টানাটানি শুরু করেন অনেকেই৷
তেমনই একজন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বান্টি মীর৷ তিনি সামাজিক গণমাধ্যমে বেশ কয়েকটি ভিডিও প্রকাশ করে সেখানে আক্রমণাত্মক ও অশালীনভাবে শাওন ও তাঁর পরিবারকে আক্রমণ করেন৷
ঘটনা পাঁচ
২০১৭ সালের ঘটনা৷ ফেসবুকের ‘আনসেন্সরড বিডি' পেজে ছবি পোস্ট করা হয় বিশ্বখ্যাত অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান, তাঁর স্ত্রী শিশির, কন্যা অব্রি ও তাদের কাজের মেয়ের৷
সেই ছবিটিতে দেখা যায় যে, সাকিব ও শিশির খাচ্ছেন, এবং তাঁদের পেছনে দাঁড়িয়ে কাজের মেয়ে৷
ছবিটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়৷ অনেকেই কটূ কথা বলতে শুরু করেন সাকিব ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে৷ কেউ কেউ সাকিবের অতীত টেনে নানা রকম অশালীন মন্তব্য করেন৷
কিন্তু পরে জানা যায়, যে ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে, তা মূল গল্পের একাংশ৷ সেখান থেকে বেরিয়ে আসা অন্য ছবিগুলোতে দেখা যায়, মেয়েটি তাদের সঙ্গে একই খাবার টেবিলে বসে আছে৷
ওপরের ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন৷ প্রত্যেকটির ব্যাপকতাতেও আছে ভিন্নতা৷ কিন্তু একটি বিষয় সবগুলোতেই রয়েছে, তা হলো, প্রতিটি ঘটনাই বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বা হেট স্পিচের এক একটি উদাহরণ৷
বিদ্বেষ ছড়ানোর ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়৷ বিদ্বেষ ছড়িয়ে নাশকতা তৈরির নজিরও আছে ভুড়ি ভুড়ি৷ কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে এই বিদ্বেষ ছড়ানো যেন মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে৷
এখনকার সময়ে সবচেয়ে বেশি যেটি দেখা যায়, সেটি হলো, সাম্প্রদায়িক বক্তব্য৷ অর্থাৎ ভিন্ন ধর্মের বা মতের মানুষের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো৷ এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক আফসান চৌধুরী৷ তিনি মনে করেন, হেট স্পিচ দেয়া বা সমাজে ঘৃণা ছড়ানো মানুষের একটি টিকে থাকার কৌশল৷ ঘৃণা ছড়ালে কারো কারো লাভ হয়৷ তাই লাভবান হতেই হেট স্পিচ ছড়ানো হয়৷
‘‘একাত্তরে কিছু মানুষ সুবিধা নেবার জন্য বা লুটতরাজ করার জন্য বিদ্বেষ ছড়িয়েছে৷ কিন্তু গোষ্ঠীগতভাবে মুসলিমরা হিন্দুদের প্রতি বা হিন্দুরা মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষী কখনোই ছিল না৷''
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের টিটু রায় কিংবা ফেনীতে দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায়ের পর যেসব ঘটনা ঘটেছে সবই স্থানীয় সুবিধা আদায়ের জন্য হয়েছে বলে মনে করেন আফসান চৌধুরী৷
‘‘দেখবেন, বেশিরভাগ এমন ঘটনার পর জমি দখলের ঘটনা ঘটেছে৷ স্থানীয় প্রভাবশালীরাই তা করছে৷''
তিনি নিজের গবেষণায় দেখেছেন যে, এসব ঘটনায় স্থানীয় মুসলিমরাই হিন্দুদের আশ্রয় দিয়েছেন৷ তাই তিনি মনে করেন, ধর্মীয় উস্কানি থাকলেও এগুলোতে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষয় নেই৷
অধ্যাপক চৌধুরী মনে করেন যে, প্রভাবশালীরাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখেছে৷ কারণ, সাধারণ মানুষের বিদ্বেষ করা ছাড়াও রুটিরুজির কাজ করতে হয়৷ তাই বিদ্বেষ টিকিয়ে রেখে লাভ হয় ক্ষমতাবানদেরই৷ কোনো কোনো গোষ্ঠী এই সুযোগ নিয়ে তাদের স্বার্থ হাসিল করে৷
তিনি মনে করেন, সারাবিশ্বে সবাই সহিংস বিদ্বেষকেই বড় করে দেখে৷ কিন্তু এই সমাজে অহিংস বিদ্বেষ ছড়িয়ে অর্থনীতি ধ্বংস করে নিজেরা লাভবান হচ্ছে, সেটি কেউ দেখে না৷
‘‘আজকে যদি একজন ১ হাজার কোটি টাকা মেরে দিতে চায়, সে যদি ১০ কোটি টাকা বিএনপির বিরুদ্ধে খরচ করে, তাহলে সে দুর্নীতি করে পার পেয়ে গেল৷ কারণ, তখন আওয়ামী লীগের লোকেরা তাকে কিছু বলবে না৷ একই কথা বিএনপি সরকারে এলে তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷'' টেলিফোনে ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তিনি৷
শুধু রাজনৈতিক বা সাম্প্রদায়িক নয়, ফেসবুক বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমে নারীর প্রতিও বিদ্বেষ দেখা যায় ব্যাপক৷ সেই বিদ্বেষ বিকৃতির পর্যায়েও চলে যায়৷ প্রায়ই লাঞ্ছনার শিকার হওয়া নারীরা ফেসবুকে বা সামাজিক মাধ্যমে সোচ্চার হলে অনেকে পক্ষ নিলেও অনেককেই দেখা যায় বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিতে৷
সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী৷ ডয়চে ভেলেকে টেলিফোনে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, পরিবারেই এই বিষয়গুলোর শিকার হয় নারীরা৷
‘‘নারী আসলে ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়৷ পরিবারেই ঠিকমতো এগুলো শেখানো হয় না৷ স্কুলগুলোতেও একই অবস্থা৷'' বলছিলেন তিনি৷
নারীদের প্রতি যে কোনো অত্যাচার হলেই কিছু মানুষকে তাঁদের চরিত্র নিয়ে খুব কথা বলতে দেখা যায়৷ ‘‘এটাতো একেবারে কমন৷'' বলছিলেন সালমা আলী৷ ‘‘শুধু পুরুষরা নয়, এমনকি নারীরাও এ প্রশ্ন তোলেন৷ যেমন, এই বনানীর ঘটনাটার কথা ধরেন, মেয়েগুলো কেন গেল, এটাই প্রশ্ন করছেন তারা৷ আমরা তো জঙ্গলে বাস করছি না যে কোথাও যেতে পারব না৷''
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সর্বশেষ জরিপ বলছে, প্রতি পাঁচ জনে একজনের বেশি নারী অনলাইনে হয়রানির শিকার হন৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর বিষয়গুলোও বেড়েছে বলে মনে করেন এই মানবাধিকার কর্মী৷
‘‘আইন আছে৷ প্রচলিত আইনেই এসবের বিচার চাওয়া যায়৷ সেই সঙ্গে এখন তো পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট আছে৷'' ঠিকমতো কাজে লাগালে এসব প্রতিহিংসামূলক বক্তব্য ঠেকানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি৷
গবেষক আফসান চৌধুরী ও আইনজীবী সালমা আলী মনে করেন ‘ঘৃণা' বিষয়টি সমাজের মধ্যে গেঁথে আছে৷ এখান থেকে বেরুতে হলে দরকার সামাজিক কাঠামোগত পরিবর্তন৷ সেই পরিবর্তন তখনই কমবে, যখন রাষ্ট্র সবাইকে সমান সুযোগ দিতে পারবে, এবং ঘৃণা ছড়িয়ে যখন লাভবান হওয়ার পথ সংকীর্ণ হয়ে আসবে৷
হেট স্পিচ বা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য কতটা ক্ষতিকর? লিখুন নিচের মন্তব্যের ঘরে৷