গৃহকর্মী নির্যাতনের বিচার নাই
১৩ অক্টোবর ২০২১২৪ জুন সিলেট শহরের শাহজালাল উপশহরে রুনা আক্তার (১৬) নামের এক গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হন। তাকে বাসার বাথরুমে আটকে রেখে তালাবদ্ধ করে নির্যাতন করা হয়। রুনার চিৎকার ও কান্না শুনে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে পুলিশ ওই বাসায় গিয়ে রুনা আক্তারকে উদ্ধার করে।
৯ জুন নিয়াসা আক্তার (১৮) নামে এক গৃহকর্মী ঢাকার উত্তরা এলাকার বাসায় দুপুরে ভাত রান্না করতে দেরি করায় গৃহকর্তার মেয়ে চুলায় বসানো পাতিল থেকে ভাতের গরম মাড় নিয়াসার পিঠে ঢেলে দেন। এতে নিয়াসার ঘাড় ও পিঠ ঝলসে যায়।
১৯ মে সিদ্ধেশ্বরী রোডের একটি বাসায় জামেনা বেগম (১৯) নামের এক গৃহকর্মীর রহস্যজনক মৃত্যু হয়। তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়।
১৮ মে গাজীপুরের টঙ্গীতে শিশু গৃহকর্মী মিমি আক্তারকে (৯) শারীরিক নির্যাতন করে বাড়ির পাশে ফেলে রাখেন গৃহকর্তা। সে তার বাবা-মার কাছে যেতে চেয়েছিল। তাকে যোগাযোগও করতে দেয়া হত না।
চাঁদপুরে এক বছর ধরে এক গৃহকর্মীকে ধর্ষণ করা হয়। এই অভিযোগে ২ মে ওই বাসার বড় ছেলে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
চলতি বছরে করোনার মধ্যে গৃহকর্মী নির্যাতনের খণ্ডচিত্র এখানে তুলে ধরা হলো। আর এগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু অনেক নির্যাতনের ঘটনাই সংবাদমাধ্যমে আসে না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্ট্যাডিজ (বিলস) ২৮৭ জন গৃহশ্রমিকের ওপর এক জরিপ করে ১২ সেপ্টেম্বর তার ফল প্রকাশ করে । জরিপে অংশগ্রহণকারী গৃহকর্মীদের মধ্যে ৬০ ভাগ আবাসিক এবং ৪০ ভাগ অনাবাসিক শ্রমিক। জরিপে অংশ নেয়া ৫০ ভাগ শ্রমিক জানিয়েছেন তারা শারীরিক বা মানসিক কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন এই ছয় মাসে মোট ২২ জন গৃহকর্মীর সহিংসতার শিকার হওয়ার কথা জানিয়েছে বিলস । নির্যাতনে নিহত হয়েছেন আট জন, ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন দুইজন। ১২ জন আহত হয়েছেন।
বিলস বলছে, সারাদেশে যত গৃহকর্মী আছেন তার ৯৫ ভাগেরও বেশি নারী। যারা ধর্ষণ, হত্যা এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তাদের বয়স ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে। তারা বলছে , এই তথ্য পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য । বাস্তব অবস্থা আরো ভয়াবহ। গৃহকর্মীদের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তারা মামলা করতে চান না বা মামলা করলেও তা চালাতে চান না বলে জানায় বিলস।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) শুধু নারী গৃহকর্মীদের প্রতি সহিংসতার তথ্য সংরক্ষণ করে। তাতে দেখা যায় চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ৩৮ জন নারী গৃহকর্মী সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে ১২ জন নিহত আর তিনজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ২৫টি। ২০২০ সালে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৪৫ জন। ১৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন আট জন। মোট মামলা হয়েছে ৩১টি। ২০১৯ সালে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি। মামলা হয়েছে ১৮টি। হত্যার শিকার ১০ জন, ধর্ষণের শিকার ১২ জন। এই তথ্যে দেখা যায় করোনার সময় নির্যাতন বেড়েছে। আর কমপক্ষে তিন ভাগের এক ভাগ ঘটনায় কোনো মামলাই হয় না। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা আরো কম। আসক বলছে, ২০১৯ সালে ১০টি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র চারটি, ২০২০ সালে ১৩টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র পাঁচটি আর চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে ১২ টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলা হয়েছে ছয়টি।
বাংলাদেশে কত গৃহকর্মী রয়েছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয় এই সংখ্যা ২০ লাখের কম হবে না।
২০১৫ সালে গৃহশ্রমিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি করা হয়। কিন্তু গৃহকর্মীদের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ না করা , জিডিপিতে অবদানের অংশ নির্ধারণ না করা, ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি না দেয়ার কারণে তার কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছেনা।
ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স রাইট নেটওয়ার্কের কনভেনর আবুল হোসেন বলেন, গৃহশ্রমিকেরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হওয়ায় অনেক ঘটনায় মামলাই হয় না। আর মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার পাওয়া যায় না। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন,"প্রথমত, মামলার বাদী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় পুলিশ। এজাহার থাকে দুর্বল, চার্জশিটও হয় দুর্বল। আর এরমধ্যে আসামিরা অর্থ ও প্রভাব খাটিয়ে আদালতের বাইরে মামলা মিটিয়ে ফেলেন।”
তার কথা,"গৃহশ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না দিলে এর সমাধান হবে না। একই সঙ্গে সংগঠনকে মামলার বাদী হতে আইন করতে হবে।”
আসক-এর পর্যবেক্ষণ বলছে, গৃহকর্মী নির্যাতনের মামলায় শেষ পর্যন্ত বিচার পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে। আসকের উপ-পরিচালক নীনা গোস্বামি বলেন,"আমরা চেষ্টা করেও বিচারে ফল আনতে পারি না। অনেক সময় আদালতে গিয়ে ভিকটিম ঘটনার বর্ননা পাল্টে ফেলে।”
তার মতে,"অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের তাদের মামলার বাদী হন তাদের অভিভাবক। ফলে এক পর্যায়ে গিয়ে তারা অর্থ বা যে কোনো চাপের মুখে আপস করে ফেলেন। আর প্রাপ্তবয়স্ক হলেও বছরের পর বছর মামলা চালানোর পরিবর্তে তারা অর্থের বিনিময়ে মিটিয়ে ফেলেন।”
গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা সাধারণত ঘরের মধ্যে হয়। তাই যারা নির্যাতনের শিকার হন তাদের পক্ষে তেমন কোনো সাক্ষী থাকে না। ফলে মামলাটি দুর্বল হয়ে যায়। নীনা গোস্বামি বলেন,"আগের চেয়ে মামলার হার বেড়েছে। কিন্তু বিচার আগের মতই শূণ্যের ঘরে আছে।”