1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘গিরগিটি সাংবাদিকতা' ও বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ

১৭ আগস্ট ২০২৪

ক্ষণে ক্ষণে রং বদলানো, নানা রূপে নিজেকে প্রকাশের জন্য গিরগিটি একটি অতি পরিচিত প্রাণী৷ রং বদলানোর অসাধারণ ক্ষমতা শিকারীদের থেকে নিজেদের রক্ষা করে গিরগিটিকে, প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মিশে থাকতে সাহায্য করে৷

https://p.dw.com/p/4jZRB
দেশ রূপান্তর পত্রিকার ভবনের সামনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিক্ষোভ
সাম্প্রতিক আন্দোলনে সাংবাদিকদের ওপর জনগণের অনাস্থার বিষয়টিও সামনে এসেছে।ছবি: Sazzad Hossain/DW

গিরগিটির রং বদলানোর এই ক্ষমতাকে ব্যাঙ্গার্থে অনেক সময় মানুষের চরিত্রের স্বরূপ প্রকাশ করতে ব্যবহার করা হয়৷ বলা হয়, 'গিরগিটি রং বদলায় আত্মরক্ষায়, মানুষ রং বদলায় স্বার্থ রক্ষায়'৷ রাজনীতিতেও এই গিরগিটি শব্দটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়৷ রাজনীতিতে যেমন ক্ষমতার বদল হয়, দলবাজ নেতারাও তেমন রং বদলায়, দল পাল্টায়৷ শুধু রাজনীতি নয়, গণমাধ্যমেরও গিরগিটির মতো রং বদলানোর অভ্যেস আছে৷ বাংলাদেশে ইতিহাস সৃষ্টিকারী কোটা সংস্কারকে ঘিরে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলন ও শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের ঘটনাবলীর ‍দুই পর্বে বাংলাদেশের বেশিরভাগ গণমাধ্যম এত তড়িৎ নিজেদের রং পাল্টিয়েছে, তাতে দোল উৎসবও ম্লান হয়ে যায়৷

 বাংলাদেশে যখনই কোনো সরকার বা রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয় তখনই কিছু গণমাধ্যমে ‘অমুক প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তির রং বদল' এমন শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ বা প্রচারিত হয়৷ মজার ব্যাপার হলো, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে এসব গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানও যে নিজেদের রং বদলায়, সেটি নিয়ে খবর প্রকাশিত হয় না৷ গণমাধ্যমের এই হাজার রঙের মাঝে কোনো-না-কোনোভাবে উপেক্ষিত গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশ দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা ও আমজনতা৷

কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তীব্র রূপ ধারণ করে, তখন থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ের সংবাদকর্মীরা হয়রানির শিকার হন৷ পক্ষপাতমূলক খবর ও মতামত প্রকাশ এবং প্রকৃত ঘটনার অনেক কিছু আড়াল করে যাওয়ার জন্য তাদের প্রতি আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ বাড়তে থাকে৷ বেশিরভাগ গণমাধ্যম, বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রতি মানুষের মধ্যে তীব্র আস্থার সংকট দেখা দিয়েছিল৷ মাঠ পর্যায়ের বেশিরভাগ সাংবাদিক নিরপেক্ষতা ও নিষ্ঠার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করলেও তাদের সংগৃহীত তথ্যের বেশিরভাগই প্রচারিত হতো না৷ আন্দোলনকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর ঘটনা তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটালেও স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতমূলক নীতির কাছে আত্মসমর্পণ তাদের অসহায় করে তুলেছিল৷

শেখ হাসিনা দিল্লি পালিয়ে যাওয়ার পর কয়েকটি গণমাধ্যম ভাংচুরের শিকার হয়৷ বস্তুনিষ্ঠ ও পেশাদার সাংবাদিকতার পরিবর্তে পক্ষপাতমূলক এবং প্রেইজ জার্নালিজমের চর্চা করতেন- এমন অনেক সাংবাদিককে চাকরি হারাতে হয়েছে, আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছে৷ রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের মতো সাংবাদিক এবং গণমাধ্যমের এমন পরিণতি শুধু বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার জন্যই নয়, বিশ্বের অগণতান্ত্রিক, দুর্বল গণতান্ত্রিক ও হাইব্রিড রেজিমের দেশগুলোর গণমাধ্যম ব্যবস্থার জন্য এক বিরাট শিক্ষণীয় উদাহরণ৷ কারণ, গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের এই যে আস্থার সংকট, সেটির পেছনে যেসব কারণ, তা শুধু দলীয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিক সাংবাদিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ একটি নির্বস্তুক সত্তা হিসেবে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের এই আস্থার সংকটকে শুধু গণমাধ্যমের সমস্যা হিসেবে দেখলে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা কখনোই পেশাগত দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারবে না৷ সময়ের দাবিতে গিরগিটির মতো বারংবার রং বদলাবে, কিন্তু পুরো গণমাধ্যম ব্যবস্থার উন্নতি হবে না৷

যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সে আমার পিএইডি অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ”চ্যালেঞ্জেসটুমিডিয়াফ্রিডমইনইলেকেশনরিপোর্টিংইনবাংলাদেশ”৷ নির্বাচন রিপোর্টিংয়ের চ্যালেঞ্জগুলো দেখতে গিয়ে এই গবেষণায় ২০০৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত গত ১৬ বছরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা ও সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জগুলো এবং সেসব চ্যালেঞ্জ কীভাবে সাংবাদিকরা মোকাবিলা করেছেন ও এর প্রভাবগুলো কী ছিল তা তুলে আনা হয়েছে৷ এই গবেষণার মূল ফলাফল হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের সাথে সাথে গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ এবং পুরো গণমাধ্যম ব্যবস্থার স্বরূপের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে৷ বাংলাদেশ মিডিয়াটাইনজেশন অব পলিটিক্স বা রাজনীতির গণমাধ্যমীকরণ থেকে পলিটিচাইজেশন অব মিডিয়া বা গণমাধ্যমের রাজনীতিকরণ ঘটেছে খুব দ্রুত৷ এই রূপান্তর এত দ্রুত ঘটেছে যেটির উদাহরণ বিশ্বের আর কোনো দেশে নাই৷ সাধারণ এমন রূপান্তরে কমপক্ষে এক দশক লাগলেও বাংলাদেশে এটি ঘটেছে মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে৷

বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অনেক চ্যালেঞ্জের কথা বললেও এই গবেষণায় মূলতঃ তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে৷ এক. আইনের বাড়াবাড়ি রকমের প্রয়োগের মাধ্যমে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির করে গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ; দুই. রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর মাধ্যমে অলিখিত ও গোপন চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে গণমাধ্যমের ওপর রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ; এবং তিন. গণমাধ্যম মালিকদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ৷ গবেষণাটির ফলাফল অনুযায়ী, এই তিন ধরনের রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রথমে পলিটিক্যাল প্যারালিলিজম বা রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিক গণমাধ্যম ব্যবস্থা তৈরি করা হয়৷ বিশেষ করে দলীয় লোক ছাড়া গণমাধ্যমের অনুমতি না দেয়া, বিরোধী পক্ষের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া এবং সাংবাদিক সংগঠনগুলোকে ব্যাপক মাত্রায় দলীয়করণের মাধ্যমে পলিটিক্যাল প্যারালিলিজমের স্তরটি শক্তভাবে স্থাপন করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার৷ দ্বিতীয়ত, দলীয় আস্থাভাজন গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার মাধ্যমে পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টেজিম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা  করা হয়৷ এই স্তরটি পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো কাজে লাগানো হয়৷ যেসব সাংবাদিক, গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও মালিক দলীয় লেজুড়ভিত্তিতে সায় দিতে চায়নি, তাদের ওপর সংস্থাগুলোর মাধ্যমে মানসিক ও ব্যবসায়িক চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল৷ এখানে আওয়ামী লীগ সরকার গণমাধ্যমের সাথে সংশ্লিষ্ট তিন ধরনের অংশীদারের জন্য তিন ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা নিতেন৷ সাংবাদিকদের জন্য ‘চায়ের দাওয়াত', গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের জন্য ‘সরকারি ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়া', এবং মালিকদের জন্য ‘এনবিআরের মাধ্যমে অন্যান্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সমস্যা তৈরি করা' হয়েছিল৷ এই পুরো প্রক্রিয়াটি ছিল ‘ঝিঁকে মেরে বৌকে শেখানোর' মতো৷ অর্থাৎ একজনকে শিক্ষা দিয়ে অন্যদেরকে বার্তা দেয়া হতো৷ যেমন – ২০১৫ সালে দেশের প্রধান দুটি পত্রিকা প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দিয়ে পুরো গণমাধ্যম ব্যবস্থায় ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করা হয়েছিল৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থা পৃথিবীতে খুব বিরল একটি উদাহরণ, যেখানকার গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পলিটিক্যাল প্যারালিলিজম ও পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টেলিজম সমান্তরালে কাজ করছে৷ এই দুয়ের মিশ্রণকে গবেষণাটিতে বলা হয়েছে পলিটিক্যাল ইন্সট্রুমেন্টালাইজেশন অব মিডিয়া৷ অর্থাৎ, অনুমোদন, পেশাগত ও বাণিজ্যিক সবদিক থেকে গণমাধ্যম সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে গিয়েছিল৷ যে কারণে সরকার প্রধানের জন্মদিনে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাটিকেও পুরো প্রথম পৃষ্ঠাকে উপহার দিতে হয়েছিল৷ এমন উদাহরণ একনায়কতান্ত্রিক দেশেও পাওয়া যাবে না৷ তৃতীয়ত, দলীয় আস্থাভাজন কগলোমোরেট গণমাধ্যম মালিকানা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে দলীয় লেজুড়ভিত্তিক সাংবাদিকতার পথকে অনেক বেশি সহজ করা হয়েছিল৷ এর অর্থ হলো একই মালিক বা কোম্পানির অধীনে অনেকগুলো গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্ব দেয়া যার ফলে সরকারের পক্ষে মতের ভিন্নতা ও বৈচিত্রতা রোধ করা সহজ হয়ে গিয়েছিল৷ গবেষণাটিতে দেখা গেছে, এই কগলোমোরেট মালিকানার ব্যাপকতা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে গত এক দশকে শুধু রাজনৈতিক নয় পাশাপাশি কর্পোরেট ক্লায়েন্টেলিজমের আধিপত্য তৈরি করেছে৷ যে কারণে সরকার বা রাষ্ট্র সংশ্লিষ্ট ইস্যু না হওয়া সত্ত্বেও এক কলেজ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার ঘটনায় বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোকে নীরব থাকতে দেখা গিয়েছিল৷ এই কর্পোরেট ক্লায়েন্টেজিলম বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার শেষ পেরেকটি ঠুকে দিয়েছিল৷ যে কারণে হাসিনা আমলের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকরা সমস্বরে বলেছিল যে তারা হাসিনার সাথে আছে৷ যার কারণে দলীয় ব্যবসায়ী আর দলীয় সাংবাদিকের মধ্যে পার্থক্য করা একেবারেই কঠিন হয়ে পড়েছিল৷        

৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনে গণমাধ্যম বিশেষ করে টিভি চ্যানেলের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ৷ ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে সে সময় মানুষের তাৎক্ষণিক সঠিক তথ্য জানার সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল টিভি৷ কিন্তু কারফিউ জারির পর থেকে নিহতের সংখ্যা না জানানো, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের প্রকৃত খবর প্রচার না করা, হত্যাযজ্ঞের চেয়ে ধ্বংসযজ্ঞ অনেক গুরুত্বপূর্ণ – এমন সরকারি বয়ানকে বেশি বেশি প্রচার করা, শিক্ষার্থীর খুনের চেয়ে পুলিশের খুন হওয়াকে গুরুত্ব দেয়া, আন্দোলনের সমন্বয়কদের নির্যাতনের চেয়ে তাদের কথিত চক্রান্তের কথা তুলে ধরা, টকশোগুলোতে আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসী বানিয়ে ফেলা, শিশু নিহতের খবর চেপে যাওয়া, সরকার ও সরকারি দলের প্রচার করা গুজব এবং মিথ্যা তথ্যগুলো প্রচার করা ইত্যাদির জন্য টেলিভিশনগুলো হাসিনার পতনের আগে-পরে জনরোষের শিকার হয়৷ কিন্তু ৫ আগস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের গণমাধ্যম জগতে আমরা কি দেখতে পাচ্ছি? খুব বেশি ভিন্ন কিছু কী দেখা যাচ্ছে? নাকি পরিস্থিতির কারণে গিরগিটির মতো শুধু রং বদলিয়েছে?  

গিরগিটি যখন শীতল পরিবেশে থাকে তখন তার স্নায়ুতন্ত্রের ইরিডোফোর কোষগুলোর প্রতিফলন ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয় বলে প্রাণীটি হালকা রং ধারণ করে৷ আবার যখন উষ্ণ পরিবেশে থাকে তখন মেলানোফোর কোষগুলো সক্রিয়া হয়, তখন গিরগিটি গাঢ় রং ধারণ করে৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোর ক্ষেত্রেও আমরা হাসিনার পতনের আগে এবং পরে গিরগিটির মতো একই ধরনের রং পরিবর্তনই দেখতে পেলাম৷ এখন দুটো জিনিস হচ্ছে৷ প্রথমত, গণমাধ্যমের উচ্চ পর্যায়ে দলীয় লোকদের অবস্থার পরিবর্তন৷ আগে ছিল আওয়ামীপন্থি সাংবাদিকদের পদায়ন, এখন তাদের ছাটাই করে বিএনপিপন্থী সাংবাদিকদের পুনর্বাসন হচ্ছে৷ এটাকে কোটাভিত্তিক প্রমোশনও বলা যেতে পারে৷ ফলে এজেন্ডা সেটিংয়ের ক্ষেত্রে আগে হাসিনা-জয় আর আওয়ামী লীগ প্রাধান্য পেতো৷ এখন সেখানে খালেদা-তারেক ও আওয়ামী লীগবিরোধীরা জায়গা করে নিয়েছে৷ ৫ আগস্টের পর থেকে বেশিরভাগ ধ্বংসযজ্ঞ ও হত্যাকাণ্ডের খবর শুধু টিভি চ্যানেলগুলোতে নয় পত্রিকাগুলোতেও আসেনি৷ শুধু পপুলার বা জনপ্রিয় মতের উপস্থাপন কখনই বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা হতে পারে না৷ সব মতের বৈচিত্রতা যদি আপনি তুলে ধরতে না পারেন তাহলে গণমাধ্যমের প্রতি মানুষের আস্থার সঙ্কট কখনই কাটবে না৷  হাসিনার পতনের পর যেভাবে হাইকোর্টের রায় না মেনে যেভাবে কিছু টিভি চ্যানেল খবর পরিবেশ করেছে সেটি নিয়ে ভবিষ্যতে কেউ যদি আদালত অবমাননার প্রশ্ন তুলে তাহলে তারা দায় ওই চ্যানেলগুলো এড়াতে পারবে না৷ ফলশ্রুতিতে বস্তুনিষ্ঠত সাংবাদিকতা আর আধেয় হিসেবে দেশের আমজনতা প্রাধান্য পাওয়ার যে আপ্তবাক্য সেটি অধরাই থেকে যাচ্ছে৷ গ্রেপ্তার আর রিমান্ড নাটকের যে পুরাতন স্ক্রিপ্ট সেটি ৫ আগস্টের পরও বিদ্যমান এবং আগের মতই বিনাপ্রশ্নে গণমাধ্যমে প্রচারিত হচ্ছে৷ দ্বিতীয়ত, দেশের সাংবাদিক সংগঠন ও প্রেসক্লাবগুলোতে চলছে নৈরাজ্য আর দখলের মাৎস্যন্ন্যায়৷ দেশের সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষভাবে লড়াই করার কথা তারা গাঢ় থেকে হালকা কিংবা হালকা থেকে গাঢ় রং ধারন করছে৷ ফলে পরিস্থিতি তথৈবচ৷ ৫ আগস্টের আগে এবং পরে যে সাংবাদিকতার চর্চা বাংলাদেশে হচ্ছে সেটাকে ঊষা বা গোধূলির মতো বলা যেতে পারে৷ দিন বা রাতের যে সন্ধিক্ষণ সেটা হলো গোধূলি, সেটা না  দিন না রাত, বরং দিন ও রাতের মিশ্রণ বলা যায়৷ কিন্তু সত্য ও মিথ্যার মাঝে যেমন কোনো ধূসর কিছু নেই সেরকম সাংবাদিকতায় সাদা-কালো কিছু নেই৷ সাংবাদিকতার এবিসি হলো নির্ভুলতা, স্পষ্টতা ও স্বচ্ছতা৷ এখানে ধবধবে সাদা, হালকা কালো – এমন কিছু প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই৷   

গত দেড় দশকে গণমাধ্যম ব্যবস্থার বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর কারণে সামষ্টিক পর্যায় থেকে যে চাপ আসতো সেগুলো ধীরে ধীরে ব্যষ্টিক পর্যায়ের অভ্যাসে পরিণত হতো৷ গোয়েন্দা সংস্থা, মালিকপক্ষ কিংবা দলীয় আস্থাভাজন গেটকিপারদের অলিখিত ও গোপনীয় সেন্সর নির্দেশ এতটা সহজ ও সাবলীল ছিল যে মাঠপর্যায়ের রিপোর্টার বা ডেস্কের সহসম্পাদকদের কাছে তা এক ধরনের ডাল-ভাত হয়ে গিয়েছিল৷ একজন রিপোর্টার জানতো বা সহজেই বুঝে যেতো কোন বিষয়ে খবর প্রচার করা যাবে আর কোন বিষয়ে করা যাবে না৷ ফলশ্রুতিতে সেলফ-সেন্সরশিপ গণমাধ্যমের তিনটি চ্যালেঞ্জের সহজাত এবং অবশ্যম্ভাবী ফলাফলে পরিণত হয়েছে৷ যারা এ অবস্থার সাথে মানিয়ে নিতে পারেননি তাদের হয় পেশা ত্যাগ করতে হয়েছে না হয় দেশ ছাড়তে হয়েছে৷ আর যারা জীবিকার তাগিদে পেশায় আছেন তাদের নিয়ত মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে পেশাগত চর্চা অব্যাহত রাখতে হচ্ছে৷

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশে অনেক কিছু সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে৷ এই অনেক কিছুর মধ্যে অবশ্যই গণমাধ্যমকে প্রাধান্য দিতে হবে৷ কারণ রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, প্রশাসন যত ব্যবস্থার সংস্কার করা হোক না কেন যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে গণমাধ্যম ব্যবস্থার সংস্কার করা না হয় তাহলে অন্যসব সংস্কার ব্যর্থ হতে বাধ্য৷ গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতা একটি স্ব-শাসিত পেশা ও ব্যবস্থা – এমনটা যদি প্রতিষ্ঠা করা না যায় তাহলে গণমাধ্যম গিরগিটির মত রং পাল্টাবে কোনদিন স্বাধীন ব্যবস্থা হিসেবে রূপ লাভ করবে না৷ শুধু কিছু আইন বাতিলের কথা বলে, ডিএফপির হাইহাই পত্রিকার তালিকা সমুন্নত রেখে, গণমাধ্যমের দলীয় লেবাস পাল্টে দিয়ে, সাংবাদিক সংগঠনগুলোর দলীয় পরিচয়ের সাইনবোর্ড পাল্টে গণমাধ্যমের শিরোনামের প্রটোকল সংবাদে নতুন ধরন আনা যাবে৷ কিন্তু তাতে কখনই স্বাধীন সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠিত করা যাবে না, যাবে না মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনা৷ সব ধরনের গণমাধ্যম, সাংবাদিকতার সাথে জড়িত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো, বিজ্ঞাপনী সংস্থা, পাঠক-দর্শকের গণমাধ্যম স্বাক্ষরতা – এসব কিছুকে একবিন্দুতে স্থাপন করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা ভাবতে হবে৷ অনেককে দেখলাম সামাজিক মাধ্যমে গণমাধ্যমের সংস্কারের লম্বা লম্বা দফা দিয়ে যাচ্ছেন৷ যেখানে বলা হচ্ছে বস্তুনিষ্ঠতা, নির্ভুলতাও সংস্কারের অংশ৷ এগুলো সাংবাদিকতার দর্শন৷ দর্শনের সংস্কার হয় না৷ সংস্কার হয় সিস্টেমের৷ সিস্টেমের সংস্কার করে দর্শন বাস্তবায়ন করতে হয়৷ সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও গণমাধ্যম ব্যবস্থার সমন্বিত সংস্কার ছাড়া কোনো দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থার সংস্কার সম্ভব হয়নি৷ বাংলাদেশের গণমাধ্যমেরও হবে না৷