ক্ষমতার নাম ‘এপাং ওপাং’ সাহিত্য
২ সেপ্টেম্বর ২০২২বাক্সটা দেখা ইস্তক ছেলেটির আর কিছুতেই মন বসছে না৷ মঞ্চ থেকে শিক্ষক, আমলা, মন্ত্রীরা জ্ঞান ঝাড়ছেন৷ আর ছেলেটা কেবলই বাক্সটা খোলার জন্য উশখুশ করছে৷ বছরসাতেক আগে দেখা ওই ছেলেটির মুখ লিখতে বসে আচমকাই ভেসে উঠল৷ একেবারে ছবির মতো৷
শিক্ষা-বিটের সাংবাদিক ছুটি নেওয়ায় প্রক্সি দিতে সেদিন যেতে হয়েছিল মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সংবর্ধনা সভায়৷ কৃতী ছাত্রছাত্রীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী৷ বিরাট নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে স্কুল ইউনিফর্ম পরে পৌঁছে গেছে সকলে৷ মঞ্চের সামনে বাক্সবন্দি তাদের পুরস্কার৷ বেশ বড় বড় বাক্স৷ লোভনীয়৷ কোনো এক জেলার স্কুলের ছাত্র চার ফুটিয়া কৃতী নিজের চেয়েও বড় আয়তনের বাক্স দেখে যাকে বলে যারপরনাই খুশি৷
মুখ্যমন্ত্রী এলেন৷ ছোটদের বড় হতে বললেন৷ এবং তারপর দেওয়া হলো পুরস্কার৷ সভা ভাঙলো৷ বাক্স হাতে একে একে চলে যাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা৷ কেবল ওই ছেলেটি বাক্স প্রায় জাপটে ধরে বসে আছে৷ আর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে বাক্সের সিল খোলার৷ খানিক চেষ্টায় সেলোটেপের আগল খুলল৷ ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো রাশি রাশি বই৷ নানা রঙের মলাট৷ ঝকঝকে ছাপা৷ কিন্তু লেখক একজনই৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ছাত্রছাত্রীদের ঠেসে মুখ্যমন্ত্রীর বই, শুধুই মুখ্যমন্ত্রীর বই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে৷ নিমেশে চোখের সেই দীর্ঘ বিস্ময় উধাও হয়ে গেল৷ বাক্স সেখানে ফেলে রেখেই মায়ের খোঁজে রওনা দিল দেশের ভবিষ্যৎ৷
বইগুলি সে শেষপর্যন্ত নিয়ে গেল কি না, তা আর দেখার সুযোগ হয়নি৷ যদি নিয়ে যায়, তাহলে তাকে পড়তে হয়েছে, ‘এপাং ওপাং ঝপাং/ সুর ধরেছে পটাং/ ব্যাঙ ডাকে গ্যাং গ্যাং/ হাতির কত বড় ঠ্যাং৷’ পড়তে হতো, ‘তোমার নাম? হ্যালো-হাই/ বাবার নাম সি ইউ বাই/ মায়ের নাম? হাই ফাই/ বোনের নাম? সুইটি পাই...’৷ এমন বিরাট মানের ‘হাই ফাই’ কবিতা থেকে বঞ্চিত সেই ছেলে সত্যিই বড় হলো কি না, আজ খুব জানতে ইচ্ছে করছে৷ খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ওইদিন ওই সভাস্থলে মুখ্যমন্ত্রী বই উপহার পাওয়া বাকি ছেলেমেয়েরা কবি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা অ্যাকাডেমির বিশেষ সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার পর কতটা উচ্ছ্বসিত হয়েছিল!
পাঠক, কবিতা পড়ে হাসবেন না৷ সাহিত্যের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন না৷ সে সব করার আগে জেনে নিন, মুখ্যমন্ত্রীর বই বাংলা বইয়ের জগতে সর্বকালের বেস্ট সেলার৷ হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়৷ হাজার হাজার এডিশন বের হয়৷ শুধু ২০২২ সালের বইমেলাতেই মুখ্যমন্ত্রীর ১২টি নতুন বই বার হয়েছে৷ ২০২০ সালে কেবল একটি বইমেলাতেই তার ১৩টি বই প্রকাশিত হয়েছিল৷ কারা পড়েন এসব বই? কীভাবে বিক্রি হয়? বাংলার প্রতিটি গ্রন্থাগারে মুখ্যমন্ত্রীর সমস্ত বইয়ের একাধিক কপি রাখা অঘোষিতভাবে বাধ্যতামূলক৷ ছাত্রছাত্রীদের পুরস্কারে কেবলই তার বই৷ তার তৈরি গান রাজ্যের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কার্যত বাধ্যতামূলকভাবে বাজে৷ সরকারি অনুষ্ঠানে, দলীয় কর্মসূচিতে৷ বেস্টসেলার হবে না?
বাঙালির এই এক আশ্চর্য স্বভাব! নিজেকে সাংস্কৃতিক প্রমাণ করতে না পারলে তার পেটের ভাত হজম হয় না৷ সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অনুবাদ সাহিত্য করেছেন৷ ফিল্ম নিয়ে তার এতই উচ্ছ্বাস (পড়ুন বাড়াবাড়ি) ছিল যে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় তাকে নন্দনে যেতে হতো 'নান্দনিক' আলোচনা করতে৷ তিনি চাননি, তাই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, নন্দনে ছবি দেখানো হয়নি, এমন কানাঘুঁষোও শোনা যায়৷
আর বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তো সেরার সেরা৷ সবকিছু ছাপিয়ে, সকলকে দশ গোল দিয়ে তিনি একাই লেখক, একাই কবি, একাই ছবি আঁকিয়ে, একাই গান লিখিয়ে, একাই গায়ক, একাই বাদক এবং একাই আরো আরো আরো সবকিছু৷
অথচ গল্পটা এমন ছিল না৷ রাজনীতির সঙ্গে শিল্প সাহিত্যের দূরত্ব এতটাই ছিল যে, পথের পাঁচালী ছবির জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে টাকা চাইতে গিয়ে সত্যজিৎ শুনেছিলেন, পথের গপ্পো যখন পুর দপ্তর টাকা দেবে৷ তবে বাংলার রাস্তাঘাট খারাপ দেখানো যাবে না৷ বিধান রায়ের এহেন সাহিত্যজ্ঞান ইতিহাস মনে রাখেনি৷ তবে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আরো একশ বছর তিনি প্রাসঙ্গিক থাকবেন৷ একই কথা প্রযোজ্য জ্যোতি বসুর ক্ষেত্রেও৷ অগ্রজ এক সাংবাদিকের কাছে শুনেছি, জ্যোতিবাবু নাকি সাহিত্যের বিষয়ে আলোচনা উঠলে বুদ্ধবাবুর দিকে বল ঠেলে দিতেন৷ জ্যোতি বসুকেও বাংলার ইতিহাস মনে রাখবে৷ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীকেও নিশ্চয় রাখবে, তবে তার সাহিত্যকীর্তির জন্য নয়৷ বড়জোড় ফুটনোটে তার ছবি, গান, কবিতা নিয়ে কিছু বিতর্কিত মন্তব্য থাকবে৷ সাহিত্যের ইতিহাস ন্যায্যভাবেই নিশ্চয় একদিন প্রশ্ন তুলবে, কোন তুল্যমূল্য বিচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্য পুরস্কার পেলেন?
ইতিহাসের ভূত ভবিষ্যৎ ভেবে লাভ নেই৷ আশঙ্কা হয় বর্তমান প্রজন্মের ওই কৃতী ছেলেমেয়েগুলির জন্য৷ পুরস্কারে যারা মুখ্যমন্ত্রীর বই পায় এবং বাড়ি নিয়ে যেতে বাধ্য হয়৷ গ্রন্থাগারে ঢুকেই যারা মুখ্যমন্ত্রীর বইয়ের ডিসপ্লে দেখতে বাধ্য হয়৷ খারাপ লাগে এই ভেবে যে বড্ড ছোট থেকেই, জ্ঞানচর্চার একেবারে গোড়ার ধাপেই তারা 'ইন্টেলেকচুয়াল দুর্নীতি’র সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হয়ে যাচ্ছে৷ দেখে ফেলছে ক্ষমতার দম্ভ৷