1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ক্যানাডায় স্থায়ী হতে আসা বাংলাদেশিদের চাকরি না পাওয়ার হতাশা

আবু সাদাত
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

সুমিত আহমদ৷ সিলেট থেকে ক্যানাডার টরন্টোতে এসেছেন পাঁচ মাস হলো৷ এখনো কোনো কাজ পাননি৷ প্রতিদিন হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন৷ কিন্তু কোথাও তিনি ইতিবাচক কোনো সাড়া পাচ্ছেন না৷

https://p.dw.com/p/4ch9p
সম্প্রতি অনেক বাংলাদেশিই ক্যানাডায় স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করছেন৷
ক্যানাডার টরন্টোর ড্যানফোর্থ এলাকার দৃশ্যছবি: Abu Sadat

প্রতিদিন দুবেলা করে বাংলাদেশি এলাকাখ্যাত ড্যানফোর্থে আসেন, যদি কারো মাধ্যমে কোনো কাজের সুযোগ পাওয়া যায়৷ এ অবস্থায় কিভাবে চলছেন জানতে চাইলে সুমিত আহমেদ বলেন, ‘‘সরকার যে টাকা (রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলে প্রতি ব্যক্তিকে মাসে ৭০০ ডলারের মতো) দেয়, আপতত সেটা দিয়েই চলছি৷’’

একই অবস্থা এক সময়ের কাতার প্রবাসী হাসমত শিকদারের৷ তার বাড়ি সিলেটের বিয়ানী বাজারে৷ উন্নত জীবনের আশায় তিন মাস আগে সুমিত আহমেদের মতো তিনিও টরন্টোতে এসেছেন ভ্রমণ ভিসায়৷ তবে স্থায়ী হওয়ার জন্য নিজেকে ‘রিফিউজি' দাবি করেছেন৷ তবে এখনও ওয়ার্ক পারমিট পাননি৷ তাই বৈধ কোনো কাজের সন্ধান করতে পারছেন না৷ ক্যাশে কোথাও কাজ পাওয়া যায় কিনা তাই আপতত খুঁজছেন৷ কিন্তু সেটাও পাচ্ছেন না৷ একদিকে ধারণার চেয়ে অনেক বেশি বাড়ি ভাড়া আর খাওয়া খরচের চিন্তায় রীতিমতো দিশেহারা তিনি৷ কারণ, যে টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তা প্রায় শেষের পথে৷

সুমিত ও হাসমতের মতো প্রতিদিন অনেক বাংলাদেশির দেখা মেলে টরন্টোর ড্যানফোর্থ এলাকায় গেলে৷ সকাল থেকে রাত, যখনই যাবেন, কিছু মানুষকে পাওয়া যাবে যাদের আলোচনার মূল বিষয়ই কিভাবে, কোথায় একটা কাজ পাওয়া যাবে৷ এর মধ্যে আবার বড় একটা অংশ আছেন, যারা ভ্রমণ ভিসায় এসেছেন, কিন্তু স্থায়ীভাবে থেকে যেতে চান৷

মোট কথা, দেশ ছেড়ে ক্যানাডায় আসা নতুন বাংলাদেশিরা কেমন আছেন, তার খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, টরন্টোর ড্যানফোর্থ এলাকায় গেলে৷ ভিসার ক্যাটাগরির ভিন্নতা থাকলেও, সবার সমস্যা এক এবং অভিন্ন -  কাজ না পাওয়া৷

‘ইমিগ্র্যান্টদের জন্য ক্যানাডা অবশ্যই ভালো, কিন্তু সবার জন্য নয়’

কথা হয় ইমিগ্র্যান্ট হিসেবে টরন্টোতে আসা বাংলাদেশি তরুণ সুলাইমান সাহিদের সঙ্গে৷ তিনি এবং তার স্ত্রী দু'জনই ঢাকায় বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানে মোটামুটি ভালো বেতনে চাকরি করতেন৷ এক্সপ্রেস এন্ট্রির দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষ করে তারা টরন্টোতে এসেছেন গত বছরের অক্টোবরে৷ স্ত্রী একটা এনজিওতে চাকরি শুরু করলেও, এখনও নিজের পছন্দের কোন কাজ খুঁজে পাননি সুলাইমান৷ তিনি বলছিলেন, ‘‘দেশ হিসেবে ইমিগ্র্যান্টদের জন্য ক্যানাডা অবশ্যই ভালো, কিন্তু সবার জন্য নয়৷ বিশেষ করে, কেউ এসেই চাকরি পেয়ে যাবে- ব্যাপারটা তেমন নয়৷ ন্যূনতম ছয় মাস থেকে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে একটা মোটামুটি মানের চাকরির জন্য৷ ফলে, মাঝের সময়টায় টিকে থাকার জন্য হাতে টাকা থাকতে হবে৷ না থাকলে কঠিন হয়ে যাবে৷’’

সুলাইমান বলছিলেন, ‘‘গত কয়েক মাসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দরখাস্ত করেছি, কিন্তু কোথাও থেকে সেভাবে সাড়া পাচ্ছি না৷ আমার মতো নতুনদের নিয়ে ক্যানাডিয়ান সরকারের অনেক ভালো ভালো প্রোগ্রাম আছে, কিন্তু সেগুলো সবই অনেক সময়সাপেক্ষ৷’’

 বাংলাদেশের শক্তিশালী কমিউনিটি না থাকাও নতুন এসে তাড়াতাড়ি চাকরি না পাওয়ার একটা কারণ বলে মনে করেন সুলাইমান৷ তার মতে, ভারতীয়, কিংবা পাকিস্তানিরা নতুন এসে তাদের কমিউনিটির কাছ থেকে যে ধরনের সহযোগিতা পেয়ে থাকেন, সেটা বাংলাদেশিরা পায় না৷ আবার দক্ষতারও অভাব আছে বলে মনে করেন সুলাইমান৷ বিশেষ করে, এখানে কাজ করার জন্য ন্যূনতম যে ইংরেজি জানা দরকার, বেশিরভাগেরই সেটা জানা নেই৷

বাংলাদেশিদের কাজ না পাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন সাংবাদিক গাজী সালাউদ্দিন মাহমুদ৷ তিনি বলেন, ‘ক্যানাডার মেইনস্ট্রিম যে জব মার্কেট, সেখানে কিন্তু কোনো ঘাটতি নেই৷ কারণ, সরকার এটা নিয়ন্ত্রণ করে৷ অর্থাৎ, এই দেশে প্রতিবছর যে পরিমাণ লোকবল প্রয়োজন, সেই পরিমাণ ইমিগ্র্যান্ট আনে৷ সালাউদ্দিন মাহমুদের মতে, ‘‘মেইনস্ট্রিম জব মার্কেটের বাইরে চাকরির সমস্যা আছে৷ কিন্তু সেটা বুঝতে দুটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে৷ এক, দক্ষতা, দুই, ক্যানাডায় আসার ভিসার ধরন৷'' তিনি বলেন, ‘‘গত দুই বছরে অনেক বাংলাদেশি এসেছে ভ্রমণ ভিসা নিয়ে৷’’

ইটালিতে কেমন আছেন বাংলাদেশিরা?

আর এই ভিসা দিয়ে বৈধভাবে কাজ পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়৷ তবে, ভিন্নভাবে আয়-রোজগারের পথ আছে৷ সেটা হলো, নগদ পারিশ্রমিকে কাজ করা৷ আর এই নগদ টাকার কাজগুলো সাধারণত হয় কমিউনিটি-বেজ'৷ অর্থাৎ, একজন বাংলাদেশি আরেকজন বাংলাদেশিকে ‘ক্যাশে' কাজ দিয়ে সহযোগিতা করে, বিনিময়ে অবশ্য অনেক সস্তায় শ্রম কেনা হয়৷ কাজ দিতে পারেন এমন বাংলাদেশির সংখ্যা খুব বেশি না হওয়ায় গত দুই বছরে ভ্রমণ ভিসায় আসা মানুষের সংখ্যা যত বেড়েছে, সে তুলনায় কাজের ক্ষেত্র বাড়েনি৷ ফলে, এই শ্রেণির মানুষ যে কাজের সংকটে ভুগছে, তাতে সন্দেহ নেই৷

আর যারা স্টুডেন্ট ভিসায় আসছেন, তাদের একটা অংশের দক্ষতার বিরাট অভাব রয়েছে বলে মনে করেন সালাউদ্দিন মাহমুদ৷ তার মতে, ‘‘ভারতীয় ছেলে-মেয়েরা যত দ্রুত যে কোনো পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে, বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা সেটা পারে না৷ ফলে, যারা চাকরি দিচ্ছে, তারা বেটার পার্সনকে বেছে নিচ্ছে৷ আর সেখানেই পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশিরা৷’’

গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ থেকে যারা ক্যানাডায় এসেছে, এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ ভিসা নিয়ে৷ এদের একটা  অংশ স্থায়ী হতে চান ক্যানাডায়৷ তাদের এই স্থায়ী হওয়ার প্রক্রিয়াটা মোটেও  সহজ না৷ কারণ, প্রথমত, ভ্রমণ ভিসা নিয়ে বৈধভাবে কোথাও কোন কাজ পাওয়া সম্ভব নয়৷ কাজ পেতে তাদেরকে জব অফার ম্যানেজ করতে হবে৷ এবং সেটাও হতে হবে ক্যানাডিন সরকারের তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান৷ বিশেষ কাজে বিশেষভাবে দক্ষ না হলে, কোনো প্রতিষ্ঠানই সাধারণত ভ্রমণ ভিসায় আসা কাউকে চাকরির জন্য বিবেচনা করে না৷

ফলে ভিজিটর ভিসায় বাংলাদেশ থেকে আসা বেশিরভাগ মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা করে৷ কিন্তু এই প্রক্রিয়াটাও যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি সময়সাপেক্ষ৷ যে কোনো একজন ভালো মানের আইনজীবীর মাধ্যমে অ্যাসাইলামের আবেদন করলে, পারিশ্রমিক হিসেবে তাকে দিতে হয় ১০ থেকে ১২ হাজার ক্যানাডিয়ান ডলার৷ বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ৯ থেকে ১০ লক্ষ টাকা৷ আর এই রাজনৈতিক আশ্রয়ের পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে সময় লাগ লাগে ন্যূনতম ৫ বছর৷ 

তারপরও ক্যানাডায় এসে বাংলাদেশের অনেক মানুষ বেছে নিচ্ছে এই পথ৷ এমনই দুজনের সঙ্গে কথা হলো টরন্টোর স্কারবরো এলাকায়৷ এরমধ্যে একজন শাহ ফরহাদ,  আরেকজন আবুল আহসান৷ দুজনই এসেছেন সিলেট থেকে৷ সেখানে দুজনই ব্যবসা করতেন৷ এরমধ্যে আইনজীবীর মাধ্যমে আবুল আহসান শরণার্থী হওয়ার আবেদন করলেও আরো কিছুদিন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে চান শাহ ফরহাদ৷ তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন ক্যানাডায় থেকে যাবেন নাকি দেশে ফিরে যাবেন৷

‘সরকার যে টাকা দেয়, আপতত সেটা দিয়েই চলছি’

তবে অল্প দিনের মধ্যেই তারা বুঝতে পারছেন স্বপ্ন আর বাস্তবতার ফারাক অনেক৷ একদিকে ওয়ার্ক পারমিট না থাকায় কোথাও কোনো কাজ পাচ্ছেন না, অন্যদিকে প্রতিমাসে গুণতে হচ্ছে মোটা অঙ্কের বাড়িভাড়া আর খাওয়ার খরচ৷ সঙ্গে আইনজীবীর খরচ তো আছেই৷

এমন পরিস্থিতিতে দেশে ফিরে যাবেন কিনা জানতে চাইলে সিলেটের আবুল আহসান বলেন, ‘‘ফিরে যাওয়ার আর কোন পথ নাই৷ যেহেতু অনেক টাকা খরচ করে এখানে এসেছি, যত কষ্টই হোক না কেন এখানেই থাকতে হবে৷’’

চাকরি না থাকা বিভিন্ন দেশের এমন মানুষদের পাশে দাঁড়িয়েছে ক্যানাডার কিছু প্রতিষ্ঠান৷ বিভিন্ন এলাকায় তারা সপ্তাহে তিন দিন বিনামূল্যে নানারকম খাবার দিয়ে সহযোগিতা করছে৷ তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান 'ফিড স্কারবোরো'৷ মাইনাস ১০-১২ ডিগ্রি ঠান্ডার মধ্যে লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করতে দেখা যায় অনেক বাংলাদেশিকে৷ এই লাইনে অবশ্য অন্য অনেক দেশের মানুষকেই দেখা যায়৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য