কোটা আন্দোলনের আদ্যোপান্ত

২০১৮ সালের ৮ এপ্রিল, রোববার৷ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে পদযাত্রাসহ নানা কমর্সূচি পালন করে ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’৷ পদযাত্রা কর্মসূচি শেষে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা৷

ওইদিন দুপুর ২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চলতে থাকে৷ এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের বেশ কয়েকবার উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেও শিক্ষার্থীরা অনড় থাকে৷

রাত ৮টার দিকে লাঠিপেটা ও রাবার বুলেট-কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে অবরোধকারীদের উঠিয়ে দেয় ‍পুলিশ৷ অবরোধকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির দিকে পিছু হটলে তাদের উপর ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীর চড়াও হওয়ার অভিযোগ ওঠে৷

শাহবাগ ছাড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি সংলগ্ন এলাকায় রাতে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ চলে; পুলিশও তাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ছোঁড়ে৷ দু’পক্ষের সংঘাত ছড়িয়ে পরে৷

গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে ভাঙচুর হয়৷ বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুরের পাশাপাশি দুটি গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়৷ ভাংচুর শুরুর আগে সব সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়৷

তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান৷ তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তার প্রাণনাশের জন্যই বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে৷ তিনি আরো বলেন, এমন হামলা সাধারণ ছাত্ররা চালাতে পারে তার কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়৷

২০১৮ সালের ৯ এপ্রিল ওই সময়ের সড়ক যোগাযোগন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে সরকারের একটি প্রতিনিধি দল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেন৷ মীমাংসাও হয়৷ ফলে আলোচনায় অংশ নেয়া নেতারা আন্দোলন স্থগিত ঘোষণা করেন৷ তবে আন্দোলনকারীদের একাংশ আন্দোলনে থেকে সরে আসেনি৷

সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ নারী কোটা থাকলেও কোটা সংস্কার আন্দোলনে প্রচুর নারী অংশ নেন৷

ঢাকা তো বটেই পুরো দেশের অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানই একে একে অচল হয়ে পড়ে৷ রাস্তা বন্ধ করে শিক্ষার্থীরা দাবি আদায়ের আন্দোলন শুরু করেন৷

দেশব্যাপী আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায়৷ আন্দোলনরতরা ছাত্রলীগের একাংশের নির্যাতন এবং সরকারের দুই মন্ত্রীর ‘আপত্তিকর’ বক্তব্যের প্রতিবাদে সমাবেশ ও প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে৷

কোটা বৈষম্যের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য দাবি করে আন্দোলনকারীরা৷ ১১ এপ্রিল বিকালে প্রধানমন্ত্রী সংসদে এ বিষয়ে কথা বলছেন জানালে শুরু হয় অপেক্ষার প্রহর৷

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে সব কোটা তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলে আন্দোলনকারীরা তার এবং বঙ্গবন্ধুর ছবি নিয়ে আনন্দ মিছিল করে৷

২০২১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের অংশটিকে চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করেন৷ রিটের শুনানিতে ৩০ শতাংশ কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করা হয়৷ এ বছরের ৫ জুন সেই রুল যথাযথ ঘোষণা করে রায় দেয় হাইকোর্ট৷ সেই রায় ১১ জুলাই প্রকাশিত হয়েছে৷

উচ্চ আদালতের রায়ের পর তারা কোটা সংস্কার দাবিতে আবারো রাজপথে নেমেছে শিক্ষার্থীরা৷ সরকারি চাকরির সব পদে কোটা সংস্কারের দাবি করছেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা৷ তারা মনে করছেন, এটি সরকারের সিদ্ধান্তের বিষয়৷

সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দিয়েছে আপিল বিভাগ৷ ১০ জুলাই প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ সিদ্ধান্ত দেয়৷ চার সপ্তাহ পর এ বিষয়ে পরবর্তী শুনানি হবে৷ এ সময়কালে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে সরকারের দেয়া পরিপত্র বহাল থাকবে৷

শিক্ষার্থীদের অবরোধে ১০ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ৷ সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্লকেড চলে৷ সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ঢাকা৷ দাবি আদায়ে ১১ জুলাই আবারও সারা দেশে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা৷

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনের নাম দিয়েছে ‘বাংলা ব্লকেড’৷ এই কর্মসূচিতে শুরুতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোর অংশগ্রহণ ছিল৷ ধীরে ধীরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন৷