কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে বহরমপুরের ‘রবিন হুড' অধীর
১ মে ২০২৪বহরমপুরের কংগ্রেস অফিসের একতলার বারান্দায় এক মধ্যবয়সী মুসলিম নারী এলেন। তার আত্মীয়ের জন্য রক্ত দরকার। হাসপাতাল দিতে পারছে না। সঙ্গে সঙ্গে জনা তিনেক কর্মী চলে এলেন। ব্লাড ব্যাংকে এবং আরো কয়েকটি জায়গায় খোঁজ নিলেন। তারা ওই নারীকে জানালেন, ব্লাড ব্যাংকে রক্ত নেই। কাল পাওয়া যাবে। ওই নারী যেন পরের দিন সকালে চলে আসেন। তার আত্মীয়ের জন্য রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
অধীর যখন রাজনীতিতে দ্রুত উঠে আসছেন, তখন একটা বিশেষণ তার সম্পর্কে প্রায়ই ব্যবহার করা হতো, তিনি হলেন বহরমপুরের 'রবিন হুড'। তার কাছে সাহায্য চাইতে গেলে সচরাচর খালি হাতে কেউ ফেরেন না। অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদের মতো এই রবিন হুড ভাবমূর্তি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, তারপর থেকে ভোটে শুধু জয়ের মুখই দেখেছেন অধীর। নবগ্রামের এক লড়াকু, সাধারণ যুবক পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে শুধু যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন তাই নয়, লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা পর্যন্ত হয়েছেন।
অধীর সম্পর্কে একটা ধারণা আছে, বহরমপুরে তিনি মাখনের মধ্যে ছুরি চালানোর মতো মসৃনভাবে জিতবেন। গত পাঁচবার তাই হয়েছে। এই ধারণার মূলেও আছে অধীরের ওই ভাবমূর্তি।
বাম আমলে ফেরার অবস্থায় নবগ্রাম থেকে বিধানসভা নির্বাচনে জিতেছিলেন অধীর। সেবার শুধু গাছে গাছে মাইক বেঁধে ক্যাসেটে তার বক্তৃতা শোনানো হয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বহরমপুর থেকে বিধানসভা বা লোকসভা নির্বাচনে হারাতে পারেনি সিপিএম।
তৃণমূল আমলেও লোকসভায় বহরমপুর থেকে অধীরের বিজয়রথ থামানো যায়নি। ফলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যাবতীয় চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
শহরে ঢুকে যে কোনো মানুষকে জিজ্ঞাসা করুন, তিনি বলবেন, বহরমপুরের জন্য অধীর চৌধুরী অনেক কিছু করেছেন। তারপরেই তিনি যে কথাটা উচ্চারণ করবেন, তা হলো, তবে এবার তার লড়াইটা কঠিন। খুবই কঠিন। বস্তুত রাজনৈতিক জীবনে এত কঠিন লড়াইয়ে আগে কখনো পড়েননি অধীর রঞ্জন চৌধুরী।
কেন তারা এই কথা বলছেন? কারণ, এই প্রথমবার এমন দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখে পড়েছেন অধীর, যারা তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে বাধ্য করছে। প্রথমজন হলেন তৃণমূল প্রার্থী ইউসুফ পাঠান। তিনি ভিনরাজ্যের মানুষ, মোদীর গুজরাট থেকে সোজা পশ্চিমবঙ্গের ভোটে ল্যান্ড করেছেন, এ সবই সত্য। তার সঙ্গে এটাও সত্য, মুসলিম যুবকদের একাংশ এই সাবেক ক্রিকেটারে মজে আছেন। দুই দিন ধরে বহরমপুরে বিভিন্ন জায়গায় মুসলিমদের সঙ্গে কথা বলার ফলে মনে হয়েছে, দুইটি ফ্যাক্টর ইউসুফকে সাহায্য করছে। এক, সাবেক ক্রিকেটার হিসাবে তার জনপ্রিয়তা। দুই, বহুদিন পর বহরমপুরে একজন শক্তিশালী মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন তারা। বহরমপুরের ৬৪ শতাংশ ভোটদাতা যেখানে মুসলিম, সেখানে এই দুইটি কারণ বড় হয়ে দেখা দিতে পারে।
এর সঙ্গে আরো একটি কারণ যুক্ত হয়েছে। বিজেপি এবার তাদের প্রার্থী করেছে নির্মল কুমার সাহাকে। বহরমপুরের বাইরে তিনি খুব বেশি পরিচিত নন। তিনি পেশায় চিকিৎসক। সরকারি হাসপাতালে চাকরি করার পর অবসর নিয়েছেন। চিকিৎসক হিসাবে রীতিমতো জনপ্রিয়। হাজার হাজার অপারেশন করেছেন। প্রচুর মানুষকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা করেছেন এবং করছেন। প্রচুর মুসলিমও তার চিকিৎসার সুফল পেয়েছেন। নির্মল কুমার সাহা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রবাদী মানুষ এবং চিকিৎসক হিসাবে তার ধর্ম পালন করেছেন। হিন্দু-মুসলিম অনেকেই তাকে বলেছেন, ভোটটা তারা পদ্মে দেবেন। তার উপর মোদী-বিজেপি-হিন্দুত্বের প্রশ্ন আছে। ফলে নিজভূমে এবার কঠিন রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হচ্ছে অধীরকে।
আরেকটা কথা মাথায় রাখা দরকার। ১৯৯৬ সালের নবগ্রাম বা তার পরবর্তীকালের বহরমপুর আর নেই। ক্লিশে হয়ে যাওয়া বিশেষণটাই বলতে হচ্ছে, গঙ্গা দিয়ে এরপর অনেক জল বয়ে গেছে।
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মুর্শিদাবাদে একটিতেও কংগ্রেস জেতেনি। উপনির্বাচনে একটি কেন্দ্রে জিতলেও সেই বিধায়ক পরে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। পুরসভা কংগ্রেসের হাতছাড়া। আগে তাকে ঘিরে থাকত যে বিশ্বস্ত নেতাদের বলয়, তাদের বেশিরভাগই তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন।
যে ডেভিড(অপূর্ব সরকার)কে তিনি অতীশ সিংহের বিরুদ্ধে নির্দল হিসাবে দাঁড় করিয়ে জিতিয়ে এনেছিলেন তিনিও তৃণমূলে। যে হুমায়ুন কবীরকে অধীর হাতে ধরে রাজনীতি শিখিয়েছিলেন, তিনিও তৃণমূলে। এরকম আর কত নাম বলব। আগের তুলনায় অধীর তাই অনেক বেশি নিঃসঙ্গ।
নেতারা গেছেন, তবে তার কাছে এখনো যা আছে, তা অন্য অনেকের কাছে নেই। সেটা হলো, একনিষ্ঠ কিছু কর্মী। তারা এখনো অধীরের সঙ্গে আছেন, যারা দাদা বলতে অজ্ঞান। যাদের জন্য অধীরের শক্তি এখনো অনেকটাই অটুট।
এই অবস্থায় ওই কর্মীদের নিয়ে অধীর এই ভয়ংকর গরমে সারাদিন ধরে বহরমপুর চষে বেড়াচ্ছেন। সকাল নয়টা নাগাদ সারগাছি রামকষ্ণ মিশনের কাছ থেকে শুরু হলো অধাীরের রোড শো। হুডখোলা জিপের উপর অধীর। সামেন পিছনে শ-দুয়েক বাইক এবং অন্তত শখায়েনক টোটো। পিছনে প্রবল জোরে গান বাজছে গাড়ি থেকে। এখানকার মানুষের ভাষায় ডিজে গাড়ি। এখন এই ঝম্পর ঝম্পর গানওয়ালা ডিজে গাড়িও প্রচারের অঙ্গ। তার সামনে উদ্দাম নৃত্য করেন যুবকরা।
যে জায়গাটা দিয়ে অধীরের রোড শো এগোতে শুরু করলো, সেটা মুসলিম এলাকা। তারপর সেই রোড শো ঢুকলো হিন্দু এলাকাতে। এরপর বড় রাস্তায় উঠে একের পর এক গ্রামের ভিতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলতে লাগলো সেই মিছিল। যত এগোচ্ছে, ততই তা আকারে বড় হচ্ছে। দুই দিকে তাকিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে চললেন অধীর রঞ্জন চৌধুরী।
তারপর বিকেলে গেলেন মুর্শিদাবাদে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের সঙ্গে একযোগে জনসভা করতে। এখন অধীরের জিপেও লাগানো থাকছে সিপিএমের পতাকা। যে অধীর আগে নিজের শক্তিতে সব হিসাব উল্টে দিতেন, অন্য কারো সাহায্য তার দরকার হতো না, সেই তিনিই এখন সিপিএমের পতাকা লাগিয়ে ঘুরতে বাধ্য হচ্ছেন।
তবে এ সবই রাজনৈতিক রণনীতির অঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গে একটা প্রবাদ আছে, খোঁচা খাওয়া বাঘ বড়ই মারাত্মক। চক্রব্যূহের মধ্যে ফেলে অধীরকে রাজনৈতিকভাবে শেষ করতে চাইছেন তৃণমূল নেত্রী। আর এই অবস্থায় অধীরও দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছেন। বহরমপুরের কাছে তাকে নতুন করে নিজেকে চেনাতে হবে না। তবে মানুষকে আস্বস্ত করতে হবে, আগের মতোই কাজ করার ক্ষমতা তিনি রাখেন। আগের মতোই লড়াই করতে পারেন তিনি, আগের মতো রবিন হুডের ভাবমূর্তি তার রয়েছে। অতীতে অনেক কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মোকাবিলা করেছেন তিনি। এবারও দাবি করছেন, ''আমি জিতবই। মুর্শিদাবাদের তিনটি আসনই আমরা পাব।''