‘শোক কাটে নি'
২১ এপ্রিল ২০১৫৯৩ বছর বয়স্ক অস্কার গ্র্যোনিং নাৎসি আমলের কুখ্যাত আউশভিৎস নিধন শিবিরের ‘অ্যাকাউন্টেন্ট' হিসেবে পরিচিত৷ ১৯৭৭ সালেই তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিলো৷ দীর্ঘ তদন্তের পর ১৯৮৫ সালে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়৷ এতকাল পরে আবার নতুন করে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হলো কেন? নাৎসি আমলে যারা ভয়াবহ অন্যায়ের শিকার হয়েছিলেন, তাঁরা ও তাঁদের বংশধরদের আইনজীবী টোমাস ভাল্টার ডয়চে ভেলে-র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বর্তমান আইনি প্রক্রিয়ার নানা দিক মূল্যায়ন করেছেন৷
এ প্রসঙ্গে টোমাস ভাল্টার প্রথমেই ২০১১ সালে মিউনিখে জন ডেমইয়ানইয়ুক-এর বিরুদ্ধে মামলার কথা মনে করিয়ে দেন৷ ততদিন পর্যন্ত জার্মানির বিচার ব্যবস্থায় শুধুমাত্র নাৎসি আমলের নিধন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা চালানোর সুযোগ ছিলো৷ ভাল্টার-ই সেই মামলায় আদালতের অবস্থান বদলাতে সমর্থ হয়েছিলেন৷ ফলে সরাসরি যুক্ত না থাকা সত্ত্বেও এই হত্যাযজ্ঞে সহায়তার অভিযোগও সমান গুরুত্ব পায়৷ তাছাড়া এ ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে শুধু ইহুদি নিধনযজ্ঞ নয়, আউশভিৎস-এ হাঙ্গেরীয় ইহুদিদের ডিপোর্টেশন-এর নির্দিষ্ট অপরাধ বিবেচনা করা হচ্ছে৷ এই সময় প্রায় ৩ লক্ষ হাঙ্গেরীয় ইহুদিকে হত্যা করা হয়৷
টোমাস ভাল্টার জানালেন, এমন এক প্রেক্ষাপটেই অস্কার গ্র্যোনিং-এর বিরুদ্ধে দুটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে৷ প্রথমত বন্দিদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়ার আওতায় গ্র্যোনিং ইহুদিদের অর্থ সংগ্রহ করে হিসেবনিকেশ করে বার্লিনে নিয়ে আসেন৷ তাঁর দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল, আউশভিৎস-এ বন্দিদের আনার পর বাছাই পর্ব সারা৷ অর্থাৎ ট্রেন থেকে তাদের সুটকেস, জামাকাপড়, মৃতপ্রায় মানুষ ও মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা৷
অতীতে ডেমইয়ানইয়ুক-এর মতো অনেক অভিযুক্ত ব্যক্তি সরাসরি হত্যাযজ্ঞে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন৷ কিন্তু অস্কার গ্র্যোনিং-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম হবে বলে টোমাস ভাল্টার মনে করেন৷ কারণ গ্র্যোনিং ইহুদি নিধনযজ্ঞ বা আউশভিৎস-এ নিজের উপস্থিতি মোটেই অস্বীকার করছেন না৷ শুধু নিজের ভূমিকাকে হত্যাযজ্ঞে সহায়তা হিসেবে মানতে প্রস্তুত নন তিনি৷ ফলে এই বয়সে তাঁর স্মৃতিশক্তি ও তিন লাখ মানুষের হত্যাযজ্ঞে সহায়তার অপরাধ শিকার করতে তিনি কতটা প্রস্তুত, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়৷ হয়তো নৈতিকভাবে তিনি তাঁর দায় মেনে নেবেন, যা মোটেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ নয়৷ জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত মামলা চলার কথা৷ তার মধ্যে তিনি হয়তো অপরাধ স্বীকারও করতে পারেন৷ এমনটা হলে ইতিহাস সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন টোমাস ভাল্টার৷
টোমাস ভাল্টার যাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তাঁদের মধ্যে একজনের ৮, অন্য আরেকজনের ৯ জন ভাইবোন ছিল৷ আউশভিৎস-এ পৌঁছনোর পর বাবা-মা সহ তাঁদের সবাইকে হত্যা করা হয়৷ ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যে একটি বড় পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল৷ মাত্র ১৪ বছর বয়স্ক এক সদস্য বেঁচে রইলো৷ এমন মর্মান্তিক পরিণতি কল্পনা করাও কঠিন৷ এভাবে এতকাল আগে যাঁরা পরিবারের প্রায় সব সদস্যদের হারিয়ে এখনো বেঁচে আছেন, তাঁদের দুঃখ-কষ্টের মাত্রা আজও একচুল কমেনি৷ তাঁদের কাছে অপরাধীর শাস্তি বড় বিষয় নয়৷ তাঁরা চান, জার্মানির এক আদালতে তাঁদের পরিবারের সদস্যদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হোক – তাঁদের নাম, পরিচয়, ছবি তুলে ধরা হোক৷ তাঁরা যেন তাঁদের মর্যাদা ফিরে পান৷ জার্মানির বিচার ব্যবস্থা নিহতদের পরিবারবর্গের কণ্ঠ শুনুক, এটা তাঁদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ এমনকি অভিযুক্তের সঙ্গেও একটা সংলাপ গড়ে উঠতে পারে৷
টোমাস ভাল্টার এ প্রসঙ্গে জার্মানির বৃহত্তর সমাজের প্রতিক্রিয়াও তুলে ধরেন৷ সংবাদ মাধ্যম শুধু দায়িত্ব পালন করছে না, বিষয়টিকে যথাযথ মর্যাদা দিচ্ছে৷ যারা এতদিন পর নাৎসি আমলের অপরাধ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেছিলেন, তাঁদের মধ্যেও অনেকে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারছেন৷ ইহুদি নিধন শিবিরের ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় তাঁদের সংশয় দূর হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করেন টোমাস ভাল্টার৷ বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের মধ্যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে৷ টোমাস ভাল্টার নিজে বিভিন্ন স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন৷ উল্লেখ্য, ২০০৬ সাল থেকেই তিনি নাৎসি আমলের অপরাধ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন৷