1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘এক টাকা আয় হলে চার টাকা ঋণ বাবদ খরচ হবে’

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৯ ডিসেম্বর ২০২৩

অধ্যাপক ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি নিয়ে কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে।

https://p.dw.com/p/4ah9i
বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লোগো
পুঁজি পাচারের ঘটনা তদন্ত না করায় সার্বিক লেনদেনে বড় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

ডয়চে ভেলে: গত এক বছর বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক জীবন কেমন ছিল?

রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর: বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতির চাপ তাদের জীবন প্রবাহের ওপর বড় রকমের অভিঘাত তৈরি করেছে।  একদিকে যেমন তাদের প্রকৃত আয় বাড়েনি, অন্যদিকে এই সময়ে সরকারের দিক থেকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় যে সহায়তা আসার কথা তা পর্যাপ্ত পরিমাণে আসেনি। ফলে একদিকে তাদের  যে সঞ্চয় ছিল তা ভেঙে খেয়ে ফেলেছে। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে। বিভিন্ন দেশে মূল্যস্ফীতি কমলেও উল্টো আমাদের যেসব পণ্য দেশে উৎপাদিত হয় তার দাম বেড়েছে। বাজার ব্যবস্থাপনা সঠিক না থাকায় বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে সিন্ডিকেটের হাতে। মানুষের আয় কমায় ভোগ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে পুষ্টির অভাবে ভুগছে। দারিদ্র্য বেড়েছে। দারিদ্র্য বেশি বেড়েছে ঢাকা বিভাগে।

সেখানে সরকারের করণীয় কী ছিল? সরকার সেটা করতে পারেনি কেন?

বাংলাদেশে যখন বেতন বাড়ে, তা সরকারি পর্যায়ে বাড়ে। আর বেসরকারি খাতে উচ্চ পর্যায়ে বেতন বাড়ে। এখানে খাদ্য ও জ্বালানি নিরাপত্তার সংকট তৈরি হয়েছে। আমদানি পণ্যের নিয়ন্ত্রণ সিন্ডিকেটের হাতে। আর দেশে উৎপাদিত পণ্যের নিয়ন্ত্রণ মধ্যস্থতাকারীদের হাতে। ফলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নাই। এতে বিশাল জনগোষ্ঠীর প্রকৃত আয় কমে গেছে। এ থেকে উত্তরণের কোনো প্রয়াস আমরা দেখিনি।

বছর জুড়ে রিজার্ভ সংকট , ডলার সংকট আমরা দেখেছি। এর জন্য কি শুধু বিশ্ব পরিস্থিতিই দায়ী , না আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনার দায় আছে?

সরবারাহ শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতির ওপর একটা প্রভাব পড়েছে। তবে আমরা যদি দেখি, তাহলে দেখবো ২০২২ সালে  জানুয়ারিতে আমাদের সার্বিক ব্যালেন্স ঋণাত্মক হয়। ৬.৬ বিলিয়ন ডলার হয়। ওই বছরে আমদানির ক্ষেত্রে বড় রকমের একটা উল্লম্ফন ঘটেছে। ৬০.৬৮ বিলিয়ন থেকে ৮২.৫ বিলিয়ন ডলার উল্লম্ফন ঘটেছে। বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি যদি ১০ শতাংশ হয় তাহলে এত বড় উল্লম্ফন ঘটার কথা নয়। সেক্ষেত্রে ফরেনসিক অডিট করার দরকার ছিল কেন এত বড় উল্লম্ফন ঘটলো। এই উল্লম্ফনের কারণে সার্বিক ভারসাম্য ঋণাত্মক হয়। এর পরের বছর আমরা দুইটি তথ্য জানতে পারি। এই সার্বিক ভারসাম্যের একটি অংশ হলো ফিনান্সিয়াল আ্যাকাউন্ট।  এটা ২.১ বিলিন ডলার ঋণাত্মক হয়, যা জিডিপির ০.৫ শতাংশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা ঋণাত্মক হওয়ার ঘটনা এই প্রথম। এর সঙ্গে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ৫৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানির কথা জানালো। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়েছে এর চেয়ে ১২ বিলিয়ন ডলার কম। এই তথ্যগুলো নির্দেশ করে, বাংলাদেশ থেকে পুঁজি পাচারের যে অভিযোগ ছিল সেই অভিযোগ অনুসন্ধান করার দরকার ছিল। তার মাধ্যমে বাজার ব্যবস্থায় সংকেত দেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। ফলে সার্বিক লেনদেনে বড় রকমের একটি ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।

পুঁজি পাচারের সঙ্গে দুর্নীতি, খেলাপি ঋণ এই বিষয়গুলো মিলে অর্থনীতি আরো বিপজ্জনক জায়গায় যেতে পারে কিনা...

বাংলাদেশ ব্যাংক যদি পুঁজি পাচার রোধে ব্যবস্থা নিতো তাহলে অর্থনীতিতে শৃঙ্খলা ফিরে আসতো। তা না করায় খেলাপি ঋণ  বাড়ছে। ২০০৮ সালের ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ এখন প্রায় দুই লাখ কোটি টাকা। এর বাইরে আরোখেলাপি ঋণ আছে যা নানা মারপ্যাচে দেখানো হচ্ছে না। এই ঋণ খেলাপি কিন্তু অনেক নয়, কয়েকজন। তাদের বার বার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, কিন্তু শৃঙ্খলায় আনা হচ্ছে না। ২০০৯ সালে বৈদিশিক ঋণ ছিল ২৫ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এখন সেটা ১০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। ঋণ যদি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব রাখে, তাহলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আপনি একটি টানেল করেছেন, এর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ যদি আয়ের চেয়ে বেশি হয়। অথবা একটি রাস্তা করলে সেখানে যদি শিল্পায়ন না হয়, তাহলে সেটা অর্থনীতির জন্য মঙ্গল না হয়ে দায়ে পরিণত হয়। আর ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঋণের খরচ আরো বেড়ে যাবে।অন্যদিকে আয় হচ্ছে না। মোট কর মোট দেশজ উৎপাদনের ৮ শতাংশ। এক টাকা যদি আয় হয়, ঋণ বাবদ খরচ হবে চার টাকা।

অর্থনীতির মূল সূচকগুলোতে আপনি কোথাও কোনো ইতিবাচক দিক দেখতে পান?

বাংলাদেশকে আমরা এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির দেশ হিসেবে দেখতে চাই। এর জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিকমতো কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলো  এমনভাবে কাজ করবে, যার মাধ্যমে বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু গত এক দশকে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের তুলনায় স্থবির, অথবা মাঝে মাঝে কমেছে। ফলে কর্মসংস্থান হবে না। যে প্রবৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে, সেটা কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি। এবং প্রবৃদ্ধির যে ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে, সেগুলো সরকারই এখন খন্ডন করছে। যেমন, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান বলছেন যে অবস্থা এখন ৩৬ বছরেও এই অবস্থা তৈরি হয়নি। অথবা এই অবস্থা চলতে থাকলে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ ধরনের কথা কাঙ্খিত হতে পারে না।

বাংলাদেশে কি দুর্ভিক্ষ হতে পারে? এমন পরিস্থিতি কি তৈরি হয়েছে?

বলা হলো বাংলাদেশ খাদ্যে সয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ শ্রীলংকায় ২২৫ ডলার দামে ৫০ হাজার টন খাদ্য রপ্তানি করলো। কিন্তু এটা গণমাধ্যমে আসেনি যে, ওই বছরই ১৩ লাখ টন চাল আমদানি করা হয়েছিল। সেটা গড়ে ৩০০ ডলারের বেশি দামে। এখন পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশ খাদ্য আমদানিতে বিশ্বে তৃতীয বৃহত্তম দেশ। আবার যখন বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লো, তখন সবাই মিলে বড় রকমের উল্লাস করলো। কিন্তু সেটাকে তো টেকসই করতে হবে। একদিকে যেমন দাম বাড়ছে, অন্যদিকে কারখানাগুলোকে তাদের চাহিদা মতো বিদ্যুৎ দেয়া হচ্ছে না। ফলে সক্ষমতার তুলনায় উৎপাদন হ্রাস করছে। সেখানেও আমদানি নির্ভর করা হলো। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিস্কার ও উত্তোলনের ব্যবস্থা নেয়া হলো না।  ফলে খাদ্য নিরাপত্তা যেমন হুমকির মুখে, জ্বালানি নিরাপত্তাও হুমকির মুখে। ফলে বাংলাদেশের উন্নয়নের যে ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে তা ভুল, অর্ধ সত্য বা মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। এর সাথে বাস্তবতার মিল নেই।

বাংলাদেশে একটি একপাক্ষিক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনে নেই। ফলে রাজনীতি একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। নির্বাচনের কারণে এখন প্রয়োজনীয় অর্থনেতিক সংস্কারগুলোও করা হচ্ছে না। এই পরিস্থিতি সামনের অর্থনীতিকে কীভাবে প্রভাবিত করবে?

ক্ষমতার ব্যবহার করে জোর জবরদস্তির মাধ্যমে সম্পদ আহরণের নজির পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে।  কিন্তু তারা সেই পরিস্থিতির উত্তরণ করেছে গণতন্ত্রায়ন করে, সংস্কারের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার দিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ঘটেনি। এই এজ অব রাইট বা এজ অব রিফর্ম করতে পারে জনগণের প্রতিনিধি। বাংলাদেশে এখন জনগণের প্রতিনিধিত্বের সংকট চলছে।

গত ৫২ বছরে কোনো নির্বাচিত রাজনৈতিক দল আরেকটি নির্বাচিত রাজনৈতিক দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেনি। তারপরও ১৯৯১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত একটি ত্রুটিযুক্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। যেখানে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্পের মধ্যে নিজস্ব নির্বাচন করার ক্ষমতা ছিল। কিন্তু সেটাও এখন আর নেই। অর্থনীতিবিদরা আগে রাজনীতিকে গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু তারা এখন মনে করেন, অর্থনীতি রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান