1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ঋণখেলাপিদের তালিকা : কার স্বার্থে গোপনীয়তা?

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৯ জুন ২০২৪

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮২ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা, গত ডিসেম্বরে যা ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা৷

https://p.dw.com/p/4heOr
বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবনের সামনের দেয়ালে সোনালি লোগো
২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর প্রতিশ্রুতি আইএমএফকে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা বেড়েছে৷ এক বছর আগের তুলনায় বেড়েছে ৫০ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা৷

এভাবে প্রতিনিয়তই ঋণখেলাপি বাড়লেও তাদের নাম প্রকাশে এক ধরনের অনীহা দেখা যায়৷ কেন এই অনীহা- এ প্রশ্নই জাতীয় সংসদে তুলেছেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য৷ এর মধ্যে সরকার দলীয় বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যও আছেন৷

আইএমএফের ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের শর্ত মেনে ২০২৬ সালের মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের নিচে এবং সরকারি ব্যাংকের ১০ শতাংশের নিচে নামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক৷ তবে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে এখনকার মতো নীতি-সহায়তা রাখা যাবে না৷

গত বছরের ২৪ জানুয়ারি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল শীর্ষ ২০ খেলাপির তালিকা সংসদে তুলে ধরেন৷ ওই তালিকার বেশির ভাগই ছিল বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার জনতা ব্যাংকের গ্রাহক৷ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের সংসদে যাদের নাম এসেছিল বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এখনও শীর্ষ ঋণখেলাপির তালিকায় তারাই রয়েছেন৷ তবে গত বছরের শীর্ষ খেলাপির তালিকায় জনতা ব্যাংকের বড় গ্রাহক এননটেক্সের নাম ছিল না৷ ব্যাংকটির ২০২৩ সালভিত্তিক এক প্রতিবেদনে এননটেক্সের ৭ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা খেলাপি দেখানো হয়েছে৷ জনতা ব্যাংকে রতনপুর গ্রুপের ১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা ঋণের সবই খেলাপি দেখানো হয়েছে৷ গত বছর শীর্ষ খেলাপির তালিকায় এই গ্রুপের নামও ছিল না৷

জানা গেছে, শীর্ষ ২০ ঋণখেলাপি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিভিন্ন ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা৷ এ তালিকায় ব্যাংক খাতের ঋণ জালিয়াতিতে আলোচিত সাদ মুসা গ্রুপ, এননটেক্স গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, মাইশা গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপসহ বিভিন্ন গ্রুপের নাম রয়েছে৷ শীর্ষ খেলাপিদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি মালিকানার জনতা এবং বেসরকারি মালিকানার ন্যাশনাল ব্যাংক৷

জাতীয় সংসদে ঋণখেলাপিদের তালিকা প্রকাশের দাবি তুলেছেন সতন্ত্র সংসদ সদস্য এ কে আজাদ৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এই ঋণখেলাপিরাই ব্যাংকের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা৷ মূলত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ লাখ কোটি টাকা৷ এই টাকা কারা নিলো, তা সবার জানা৷ অর্থমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছি, আপনি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির জন্য সংসদে তাদের নাম প্রকাশ করুন৷ তারাই ব্যাংকের টাকা লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন৷ আমরা ব্যবসায়িরা ৩০ শতাংশ হারে ট্যাক্স দেই৷ অথচ যারা টাকা পাচার করেছেন তারা যদি এখন টাকা ফেরত আনেন তাহলে তাদের ১৫ শতাংশ কর দিলেই হবে৷ আবার এই টাকা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারবে না৷ কীভাবে সার্বভৌম সংসদ কালো টাকা সাদা করার বৈধতা দিতে পারে, তা বোধগম্য নয়৷ কেন কালোটাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না?”

আওয়ামী লীগ দলীয় সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ফরিদা ইয়াসমিনের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী দুই দিন আগে সংসদে বলেছেন, ‘‘ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছে৷ ফরিদা ইয়াসমিন তার প্রশ্নে শীর্ষ ৩০ ঋণখেলাপি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে চেয়েছিলেন৷ আওয়ামী লীগ দলীয় আরেকজন সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, "আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ কেলেঙ্কারি বন্ধে খেলাপি ঋণ গ্রহীতা ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা চিহ্নিতকরণ এবং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণসহ বিভিন্ন নিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে৷ বিদ্যমান আইনে খেলাপি ঋণ গ্রহীতা ও ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ গ্রহীতা সম্পর্কিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে সার্কুলার জারি করা হয়েছে৷ এ ছাড়া ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে এক খাতের নামে ঋণ নিয়ে যেন অন্য খাতে ব্যবহার না হয় এবং অর্থের সঠিক ব্যবহার হয়, তা নিয়মিত তদারকির জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে৷”

বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তো ঋণখেলাপিদের হালনাগাদ তালিকা থাকার কথা৷ তা প্রকাশে অনীহার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যিনি ৬ মাসের খেলাপি, তিনিও ঋণখেলাপি৷ এভাবে তো গণহারে তালিকা প্রকাশ করা যায় না৷ তবে যারা বড় ধরনের খেলাপি তাদের তালিকা তো প্রকাশ করতে বাধা থাকার কথা না৷ গণহারে ঋন খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হলে ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে৷ সামাজিকভাবেও ব্যবসা বাণিজ্যে প্রভাব পড়তে পারে৷ তবে একেবারে তালিকা প্রকাশ না করার পক্ষে আমি না৷ আমি চাই যারা ঋণ নিয়ে আর দিতে চান না, এমন খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করা হোক৷”

জানা গেছে, নানা জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেওয়ায় আলোচিত সাদ মুসা গ্রুপের দুই প্রতিষ্ঠানকে খেলাপি দেখানো হয়েছিল গত বছরের তালিকায়৷ এর মধ্যে সাদ মুসা ফেব্রিক্সের কাছে এখন ন্যাশনাল ব্যাংকের পাওনা ১ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা৷ আর তার বেনামি কোম্পানি রেডিয়াম কম্পোজিটের কাছে একই ব্যাংকের পাওনা ৭৫৪ কোটি টাকা৷ সাদ মুসা গ্রুপের কর্ণধার মোহাম্মদ মহসিনের ২৪টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা৷ গত বছরে খেলাপির তালিকায় শীর্ষে ছিল ঢাকার মিরপুরের প্রয়াত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মাইশা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সিএলসি পাওয়ার৷ তার ঋণের সবই বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকে৷ গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংকে মাইশা গ্রুপের খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৫৫ কোটি টাকা৷ অনেক আগে থেকে ঋণ পরিশোধ না করলেও আসলামুল হক জীবিত থাকা অবস্থায় নানা উপায়ে এসব ঋণ নিয়মিত দেখানো হতো৷

অনেকেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে টাকা পাচার করেছেন৷ তাদের ব্যাপারে কি খোঁজ খবর নেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট? জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের (বিএফআইইউ) সাবেক প্রধান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কোনো না কোনো সূত্র থেকে তথ্য পেলে বিএফআইইউ অনুসন্ধান করতে পারে৷ ঋণখেলাপির বিষয়টা কিন্তু বিএফআইইউ'র তফসিলভুক্ত না৷ তবে কেউ যদি টাকা পাচার করেন সেটার বিষয়ে বিএফআইইউ অনুসন্ধান করতে পারে৷ অনেকের বিষয়েই বিএফআইইউ অনুসন্ধান করে এবং যথাযথ ব্যবস্থা নেয়৷”

জাতীয় সংসদে গত বছর প্রকাশিত তালিকায় নাম উঠে আসা রাইজিং স্টিলের ১ হাজার ১৪৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে ৯৯০ কোটি টাকা ছিল খেলাপি৷ চট্টগ্রামের মোহাম্মদ ইলিয়াস ব্রাদার্স লিমিটেডের  খেলাপি ছিল ৯৬৬ কোটি টাকা৷ আসবাব নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান অটোবির কোয়ান্টাম পাওয়ার সিস্টেমের ৮১১ কোটি টাকা ঋণের সবই ছিল খেলাপি৷ আশিয়ান এডুকেশন লিমিটেডের ৬৫৩ কোটি টাকা ঋণের ৬৩৬ কোটি, এসএম স্টিল রি-রোলিং মিলের ৮৮৯ কোটি টাকা ঋণের ৬৩০ কোটি, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত অ্যাপোলো ইস্পাত কমপ্লেক্সের ৮৭৩ কোটি টাকা ঋণের ৬২৩ কোটি এবং সিদ্দিকী ট্রেডার্সের ৬৭১ কোটি টাকা ঋণের ৫৪১ কোটি টাকা খেলাপি ছিল৷

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)-এর গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘খেলাপি ঋণ এখন অর্থনীতিতেই একটা নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে৷ এখনই যদি এটার সংস্কার এবং তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি না দেওয়া হয় তাহলে কিন্তু পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে৷ আমাদের যে তারল্য সংকট, ব্যাংকে আস্থার সংকট সবকিছুর মূলেই কিন্তু এই খেলাপি ঋন৷ এখন সংসদে যে কথাগুলো হচ্ছে, এটা অবশ্যই ইতিবাচক৷ ব্যাংকগুলো তো ভালো করেই জানে কারা ঋন খেলাপি৷ এদের নাম প্রকাশ্যে আনার আগে সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে৷ কারণ, এদের অধিকাংশের বিদেশে বাড়ি আছে৷ অনেকেই ক্যানাডা, মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম করেছেন৷ এখন তালিকা প্রকাশ করলেন, এরাও দেশ ছেড়ে চলে গেল তাহলে তো ব্যবস্থা নিতে পারবেন না৷ এই কারণে তালিকা সামনে আনার আগে ভেতরে ভেতরে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে৷ যাতে এরা পালিয়ে যেতে না পারে৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য