ইডি-র তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলে জ্যোতিপ্রিয়কে জামিন আদালতের
১৬ জানুয়ারি ২০২৫২০২৩ সালের ২৭ অক্টোবর রাতে ইডি গ্রেপ্তার করে জ্যোতিপ্রিয়কে। এরপর একাধিকবার জামিনের আবেদন করেও ছাড়া পাননি তিনি। অবশেষে বুধবার সাবেক মন্ত্রীকে জামিন দিয়েছে ইডি বিশেষ আদালত। দুর্নীতির বিপুল অভিযোগ করা সত্ত্বেও তদন্তকারীরা জামিন খারিজের পর্যাপ্ত কারণ আদালতের সামনে পেশ করতে পারেননি।
শর্তাধীন জামিন
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ওরফে বালুকে ৫০ লক্ষ টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে জামিন দিয়েছে বিশেষ আদালত। এছাড়া তার উপর চাপানো হয়েছে একাধিক শর্ত। তাকে পাসপোর্ট জমা রাখতে হবে আদালতের কাছে। সব সময়ে মোবাইলে যেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। সংবাদমাধ্যমের কাছে এই মামলা সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না তিনি।
তাই বুধবার সন্ধেয় নীরবে সল্টলেকের বাড়িতে ফেরেন জ্যোতিপ্রিয়। যদিও অনুগামীদের ভিড় ছিল বাড়ির সামনে। সাংবাদিকরা এগিয়ে গেলেও কোন কথা বলেননি উত্তর ২৪ পরগনা জেলার এই শীর্ষ নেতা। পরে তার দাদা দেবপ্রিয় মল্লিক বলেন, "বালুর শরীর ভালো নেই। তার উপর এতদিন ধকল গিয়েছে।"
জ্যোতিপ্রিয়র অসুস্থতাকে একাধিকবার জামিনের কারণ হিসেবে সামনে রেখেছিলেন তার আইনজীবী। সাবেক মন্ত্রীর আইনজীবী শ্যামল ঘোষ বলেন, "৬৬ বছর বয়স জ্যোতিপ্রিয়র। তার ডায়াবেটিস ছাড়াও অন্যান্য সমস্যা রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। ভবিষ্যতে তদন্তে সহযোগিতা করবেন। এই মামলার ট্রায়াল কবে হবে সেটা অনিশ্চিত। সে কারণেই আমরা জামিনের আবেদন করেছিলাম। আদালত তাতে সাড়া দিয়েছে।"
আদালতের পর্যবেক্ষণ
রাজ্যের গণবন্টন ব্যবস্থার উপর বিপুল সংখ্যক মানুষ নির্ভরশীল। রেশনে যে খাদ্যশস্য বন্টন করা হয়, তা খোলা বাজারে পাচার করে বিপুল টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ ওঠে। এই দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় গ্রেপ্তার হন।
তার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত বাকিবুর রহমানকে প্রথমে গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় সংস্থা। এরপর পাকড়াও করা হয় জ্যোতিপ্রিয়কে। এই দুর্নীতিতে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বনগাঁ পুরসভার সাবেক চেয়ারম্যান শঙ্কর আঢ্য। বাকিবুর ও শঙ্কর জামিন পেয়ে গেলেও জেলে ছিলেন জ্যোতিপ্রিয়।
একটানা কোনো অভিযুক্তকে আটকে রাখার জন্য পর্যাপ্ত কারণ দেখতে পায়নি আদালত। বিচারকের পর্যবেক্ষণ, অনুমানের উপর ভিত্তি করে ও অদূর ভবিষ্যতের বিচারের কথা ভেবে কাউকে দিনের পর দিন আটকে রাখা যায় না। সে কারণেই সাবেক মন্ত্রীকে জামিন দিয়েছে আদালত। এর পাশাপাশি আদালত জানিয়েছে, জ্যোতিপ্রিয় সংক্রান্ত মামলায় কেন্দ্রীয় সংস্থা কয়েকটি ক্ষেত্রে তাদের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়েও কাজ করেছে।
ইডিকে ঘিরে প্রশ্ন
জ্যোতিপ্রিয়কে জামিন দিতে গিয়ে আদালত যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে, তাতে তদন্তকারী সংস্থার দেওয়া তথ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ আদালতের বিচারক প্রশান্ত মুখোপাধ্যায় বলেন, "আর্থিক দুর্নীতি বৃহত্তর অপরাধ। এক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক প্রমাণের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে অভিযুক্তের যোগ পাওয়া যাচ্ছে না। আর্থিক লেনদেনের সূত্রটি জ্যোতিপ্রিয়র ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত নয়।"
আদালত বলেছে, রেশন দুর্নীতি মামলায় 'মানি ট্রেইল' বা টাকার হাতবদল নিরবচ্ছিন্ন নয়। ইডি যে চক্রের অভিযোগ তুলেছিল, সেখানে এই লেনদেন ছিল ধারাবাহিক বা অবিচ্ছিন্ন। এক্ষেত্রে প্রিভেনশন অফ মানি লন্ডারিং আইনে কাউকে অভিযুক্ত করা যায়। এই মামলায় তা হয়নি।
ইডি সম্পর্কে বিশেষ আদালত বলেছে, কয়েকটি বিচ্ছিন্ন কাগজের উপর ভিত্তি করে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। তথ্যপ্রমাণ হিসেবে এগুলি অপ্রাসঙ্গিক ও গ্রাহ্য নয়। এছাড়া মামলা চলাকালীন হঠাৎই তিনজনের গ্রেপ্তারি নিয়ে আদালত প্রশ্ন তুলেছে। শান্তনু ভট্টাচার্য, সুব্রত ঘোষ ও হিতেশ চন্দককে গত মাসে পাকড়াও করে কেন্দ্রীয় সংস্থা ।
বিচারকের প্রশ্ন, ২০২৪ এর ২৪ ডিসেম্বর হঠাৎ কেন গ্রেপ্তার করা হল এদের। তিনজনের বয়ান এক বছর আগেই নেয়া হয়েছিল। যখন অনেকে রেশন দুর্নীতি মামলায় জামিন পাচ্ছেন, তখন কেন এই গ্রেপ্তারি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ নিয়ে রাজনৈতিক তরজা চলেছে। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর মন্তব্য, "জামিন মানে খালাস নয়। এই মামলায় সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। দেড় বছর সাজা খাটা হয়ে গেলেও বাকি সময়টা আছে। সম্পত্তি সিজ করা আছে।"
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, "এটা আইনি বিষয়। সেই প্রক্রিয়ায় জামিন পেয়েছেন প্রাক্তন খাদ্যমন্ত্রী। তবে আদালতের পর্যবেক্ষণে এই বিষয়টি উঠে এসেছে, তথ্যপ্রমাণ না থাকলেও জোর করে আটকে রাখা হচ্ছে।"
এই দাবি খারিজ করে বিজেপি নেতা বিমলশঙ্কর নন্দ বলেন, "যদি তথ্যপ্রমাণ না থাকে, তা হলে কীভাবে ১৫ মাস জেলে থাকলেন জ্যোতিপ্রিয়। অনেক প্রমাণ গোপন করা হয়েছে, সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাই সেগুলি জোগাড় করতে সময় লাগছে। মামলা চলাকালীন সেসব পেশ করবে তদন্তকারী সংস্থা।"
বাম ও কংগ্রেস এর পিছনে গোপন বোঝাপড়ার অভিযোগ তোলে বারবার। এর আগে গরু পাচার মামলায় জামিন পেয়েছেন তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় আপাতত মুক্ত তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য, জীবনকৃষ্ণ সাহা। এখনো জেলে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, যার জামিন নিয়ে জোর জল্পনা চলছে।
আইনজীবী ও সিপিএম নেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য বলেন, "বিচারাধীন বন্দি হিসেবে কাউকে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না। ভারতীয় সংবিধান সেই রক্ষাকবচ দিয়েছে। কিন্তু সন্দেহের বিষয়, ট্রায়াল শুরু হওয়ার আগে অন্যতম অভিযুক্ত জামিন পেয়ে যাচ্ছেন। এতেই প্রশ্ন উঠছে, তদন্তকারী সংস্থা কি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে তদন্ত করতে পারছে। না কি তাদের তদন্তকে প্রভাবিত করা হচ্ছে।"