1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বাণিজ্যইউরোপ

ইইউর নতুন বিধান : পোশাক শিল্পে সংকটের শঙ্কা

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৬ এপ্রিল ২০২৪

কারখানাসহ পণ্য সরবরাহ ও বিপণনের সার্বিক প্রক্রিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি বন্ধে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পদক্ষেপ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা আরোপ করে নতুন একটি বিধান পাস করেছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট৷

https://p.dw.com/p/4fEmf
বাংলাদেশের একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত নারী শ্রমিক৷
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ৷ ফাইল ফটো৷ ছবি: picture-alliance/NurPhoto/M. Hasan

বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ৷ তাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নতুন এই বিধিবিধান পাস হওয়ার ফলে সংকটে পড়বে দেশের অন্তত অর্ধেক গার্মেন্ট৷ মালিকরা বলছেন, এই শর্তগুলো পূরণ করতে অনেক টাকার প্রয়োজন৷ এখন তারা যদি আর্থিকভাবে সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তাহলে দ্রুতই পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে৷

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো এতদিন তাদের সব শর্ত মেনেই পোশাক রপ্তানি করে আসছি৷ বিশেষ করে রানা প্লাজার ঘটনার পর আমাদের গার্মেন্ট সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে৷ আমরা আস্তে আস্তে সবগুলো ফ্যাক্টরিকেই গ্রিন ফ্যাক্টরিতে রূপান্তরের চেষ্টা করছি৷ আশা করি নতুন যে সিদ্ধান্ত হয়েছে সেগুলোও আমরা সঠিক সময়ের মধ্যে করে ফেলবো৷’’

গত বুধবার ইইউ পার্লামেন্টে নতুন এই ‘অবশ্যপালনীয়’ নির্দেশনার ওপর ভোটাভুটি হয়৷ এর পক্ষে ৩৭৪ ও বিপক্ষে ২৩৫ ভোট পড়ে৷ ১৯ জন এমপি ভোটদানে বিরত ছিলেন৷ এই বিধানের ফলে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি তারা যেসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবসা পরিচালনা করে, সবার জন্য নতুন বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়েছে৷ এর ফলে কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও পরিবেশের ক্ষতি প্রতিরোধ, নির্মূল ও প্রশমনে ব্যবস্থা নিতে হবে৷ এর মধ্যে রয়েছে দাসত্ব, শিশুশ্রম, শ্রমশোষণ, জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি, দূষণ এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ক্ষতি প্রতিরোধ, বন্ধ ও কমানোর ব্যবস্থা গ্রহণ৷

পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সিনিয়র পরিচালক শহীদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ইইউ পার্লামেন্টে নতুন বিধান পাশ হয়েছে, এটা সবার জন্যই ভালো৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো এই কাজগুলো করতে গেলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন৷ এই টাকা কে দেবে? তারা তো আর্থিকভাবে আমাদের কোনো সহযোগিতা করে না৷ মাঝে মধ্যেই নতুন বিধিবিধান নিয়ে হাজির হয়৷ সেগুলো বাস্তবায়ন করতে আমাদের প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়৷ রানা প্লাজার ঘটনার পর তারা আমাদের যে সংস্কারের রূপরেখা দিয়েছিল, সেটা করতে ছোট ফ্যাক্টরিরও ৫-৭ কোটি টাকা খরচ হয়েছে৷ এখন তারা যদি আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসে, তাহলে ভালো৷ সরকারকেও এগিয়ে আসতে হবে৷ না হলে অর্ধেক ফ্যাক্টরি ভয়াবহ সংকটে পড়বে৷’’ 

উৎস থেকে উৎপাদন পর্যন্ত তাদের মানদণ্ড মেনে চলতে হবে: দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

ইউরোপীয় ইউনিয়নের এই বিধান কার্যকর হলে বাংলাদেশে এর কী প্রভাব পড়বে জানতে চাইলে নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম ডয়চে ভেলেকে বলেন, “ইইউর এই বিধানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই দিকই আছে৷ ইতিবাচক দিক হচ্ছে ইইউর সব দেশের ব্র্যান্ডগুলো উন্নত কর্মপরিবেশের দিকে নজর দেবে৷ মানবাধিকার ও শ্রমিকের অধিকারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীন ও ভিয়েতনামের তুলনায় ভালো অবস্থানে থাকায় খুব বেশি চ্যালেঞ্জ হবে না৷ আর নেতিবাচক দিক হচ্ছে ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র পণ্য সরবরাহকারীরা ব্যবসা থেকে ছিটকে যেতে পারেন৷ এই ধরনের ফ্যাক্টরির সংখ্যাও কম না৷’’

ইউরোপীয় কোম্পানির পাশাপাশি ওই সব দেশে ব্যবসা করা বাইরের কোম্পানিগুলোর ওপরও এই বিধান কার্যকর হবে৷ কোম্পানিগুলোকে অবশ্যপালনীয় বিষয়গুলোকে তাদের নীতিতে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে৷ বাধ্যবাধকতার বিষয়গুলো প্রতিপালনে বিনিয়োগ করতে হবে৷ ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক অংশীদারদের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষেত্রে এসব বিষয় মেনে চলা হচ্ছে কিনা, তার নিশ্চয়তা চাইতে হবে৷ ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের ব্যবসায়িক অংশীদারেরা যাতে নতুন বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলতে পারে, সে জন্য তাদের সহায়তায় ব্যবসা পরিকল্পনা নতুন করে সাজাতে হবে৷ ব্যবসা মডেল যেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্যারিস চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, সেদিকে কর্যক্রম নিয়ে যাওয়ার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে৷

কঠোর এই বিধিবিধান প্রতিপালনে কতটুকু প্রস্তুত বাংলাদেশের গার্মেন্ট সেক্টর? এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র সম্মানীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের বুঝতে হবে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে পরিবর্তন আসছে৷ এর অন্যতম হলো আগে আমরা পণ্যের মান নির্ণয় করতাম৷ এখন পণ্য থেকে প্রক্রিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে৷ অর্থাৎ, পণ্য উৎপাদন যে প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছু৷ একেবারে উৎসমুখে যেতে হচ্ছে৷ এই আইনটা হচ্ছে, সেটাই৷ উৎপাদনের ক্ষেত্রে মনোভাবের যে পরিবর্তন সেদিকেই নজর দেওয়া হয়েছে৷ এখন আমাদের উৎস থেকে উৎপাদন পর্যন্ত সব জায়গাতেই তাদের দেওয়া মানদণ্ড মেনে চলতে হবে৷ পণ্যের মানের পাশাপাশি এর সঙ্গে যে মানুষগুলো জড়িত, তাদের যে অধিকার আছে সে বিষয়ে শক্তভাবে নজর দিতে হবে৷’’  

ইইউর নতুন বিধান কোম্পানিগুলো মানছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা এবং বিধান লঙ্ঘনের জন্য কোম্পানিকে দণ্ড দেওয়ার জন্য একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলো৷ যেসব কোম্পানি বিধান লঙ্ঘন করবে, তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশের পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী ওই কোম্পানির মোট লেনদেনের ৫ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করা হবে৷ এ বিষয়গুলোতে সহযোগিতা ও সর্বোত্তম চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ইউরোপীয় কমিশনও একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করবে৷ অবশ্য পালনীয় বাধ্যবাধকতা পূরণে ব্যর্থ হলে যে ক্ষতি হবে, তার দায় কোম্পানিকে নিতে হবে এবং ক্ষতিগ্রস্তকে পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷

তারা বিধিবিধান নিয়ে হাজির হয়, আর্থিকভাবে সহযোগিতা করে না: শহীদুল্লাহ আজিম

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইর সাবেক সহ-সভাপতি এ বি এম শামসুদ্দিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আশপাশের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ অনেক ভালো৷ আমরা তো তাদের শর্তগুলো মেনেই ফ্যাক্টরিকে নতুনভাবে সাজিয়েছি৷ এখন এই বিধিবিধানের ফলে যেটা হবে, বেশ কিছু ছোট গার্মেন্ট ক্ষতিগ্রস্থ হবে৷ এমনকি বন্ধও হয়ে যেতে পারে৷ আমাদের যে এক্সপোর্ট তার অর্ধেকের বেশি করে ২৫ ভাগ ফ্যাক্টরি৷ বাকি অর্ধেক করে ৭৫ ভাগ ফ্যাক্টরি৷ এই ৭৫ ভাগই বেকায়দায় পড়বে৷ এ থেকে পরিত্রানের পথ যদি বলেন, তাহলে বায়ারদের এগিয়ে আসতে হবে৷ পাশাপাশি আমাদের সরকারকেও ভূমিকা নিতে হবে৷’’

ইইউর এই বিধিবিধান সম্পর্কে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা তো ইইউর এই উদ্যোগকে খুবই সাধুবাদ জানাই৷ কারণ, এতে আমাদের শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ যেমন ভালো হবে, তেমনি তাদের স্বার্থের বিষয়টি নিশ্চিত হবে৷ পাশাপাশি আমরা এটাও বলতে চাই, এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে গেলে অনেক টাকার প্রয়োজন৷ সেই টাকা যেন বায়াররাও দেন৷ আমাদের মালিকদের এটা নিয়ে কথা বলতে হবে৷ সরকারকে ভূমিকা নিতে হবে৷ কিছু ফ্যাক্টরি হয়ত নিজেদের উদ্যোগেই করতে পারবে৷ কিন্তু অনেক ফ্যাক্টরি সংকটে পড়বে৷ আমাদের ফ্যাক্টরি যদি তিন হাজার হয়, তাহলে অর্ধেক অর্থাৎ দেড় হাজার ফ্যাক্টরির এসব শর্ত পূরণের সামর্থ নেই৷ তাদের সহযোগিতা দিয়ে কাজগুলো করতে হবে৷ তাহলেই মূল উদেশ্য বাস্তবায়ন হবে৷’’