আরো কত দিন জেলে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী?
৫ ডিসেম্বর ২০২৪স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জামিন পেয়েছেন পার্থ ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়। পুজোর আগে জামিন পেয়েছেন প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান তথা পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য, তার স্ত্রী ও পুত্র। মুর্শিদাবাদের বড়ঞার তৃণমূল বিধায়ক জীবনকৃষ্ণ সাহাও জেলের বাইরে। জামিন পেয়েছেন বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা কুন্তল ঘোষ ও শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। ইডির মামলায় এরা ছাড়া পেলেও সিবিআই দুজনকে নিজেদের হেফাজতে রেখে দিয়েছে। এর আগে স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জামিন পেয়েছেন মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গঙ্গোপাধ্যায়।
পার্থের আবেদন
একের পর এক জামিন হওয়ায় জেল থেকে বেরোতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বিশেষত তার বান্ধবী বলে পরিচিত অর্পিতার জামিনের পর। সুপ্রিম কোর্টে তার সওয়াল, "অর্পিতা জামিন পেলে আমি পাব না কেন?" তবে এমন সওয়াল করার জন্য রীতিমতো ভর্ৎসনার মুখে পড়েছেন পার্থ।
২০২২ সালে নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার হন পার্থ। গত দুই বছরে বহুবার জামিনের আর্জি জানিয়েও লাভ হয়নি। এদিকে অর্পিতা-সহ দুর্নীতি মামলায় ধৃত অনেকেই জামিন পেয়েছেন। বুধবার সুপ্রিম কোর্টে তাদের প্রসঙ্গ তুলে ধরেই জামিনের আবেদন করেন পার্থের আইনজীবী মুকুল রোহতোগি। বলেন, "টাকা উদ্ধার হয়েছে যেখানে, তার সঙ্গে পার্থর কোনও সম্পর্ক নেই। ওই ঠিকানার মালিকও তিনি নন। অর্পিতা-কল্যাণময় জামিন পেয়ে গিয়েছেন। তাহলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় কেন পাবেন না?" জামিন পেলে প্রয়োজনে পার্থ চট্টোপাধ্যায় বাংলা ছাড়তেও রাজি বলে জানিয়েছেন আদালতে।
এই আর্জি শুনে কার্যত পার্থকে ভর্ৎসনা করেন বিচারপতি সূর্য কান্ত। তিনি বলেন, "যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন ও জামিন পেয়েছেন, তারা কেউ মন্ত্রী ছিলেন না। পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। আপনার দপ্তরে কী হচ্ছে, সেটা আপনার জানার কথা। শুধু অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে নয়, একাধিক সংস্থায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের টাকা ছিল বলে তথ্য মিলেছে।" বিচারপতি এটাও বলেছেন, পার্থ চট্টোপাধ্যায় জামিন পেলে তদন্ত কীভাবে প্রভাবিত করতে পারেন, তা আগে খতিয়ে দেখতে হবে।
নিয়োগ দুর্নীতির মামলা দীর্ঘ দিন ধরে লড়ে চলেছেন আইনজীবী ফিরদৌস শামীম। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট যেটা বলেছে সেটাই হওয়া উচিত। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নিয়োগ দুর্নীতির একেবারে মাথায় বসে। তিনি তার পরিচিত ব্যক্তিকে ব্যবহার করে এই অপরাধ সংগঠিত করেছিলেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন যে পাঁচ সদস্যের এক্সপার্ট কমিটি, তারও আইনগত কোন ভিত্তি নেই। এই এক্সপার্ট কমিটি বিভিন্ন ধরনের অবৈধ কাজকর্ম করেছে। তাদের মধ্যে যিনি কনভেনার, তিনি এখনো জেলে আছেন, এসপি সিনহা। ফলে এই যে বিভিন্ন অবৈধ কাজ, যেগুলো একেবারে সরাসরি যিনি সর্বোচ্চ কর্তা তার নজরদারিতে হয়েছে। তিনি ছাড় পেয়ে যাবেন, এটা কখনোই হতে পারে না।"
মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী রঞ্জিত শূর ডিডাব্লিউকে বলেন, "পশ্চিমবঙ্গের জেলে যে ২৮ হাজার বন্দি আছে, তার মধ্যে ৭৭ শতাংশ হচ্ছে বিচারাধীন। যাদের বছরের পর বছর জামিন না দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে। তাদের বিচারও শেষ হচ্ছে না, জামিনও হচ্ছে না। এটা শুধু পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলে নয়, একটা সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তি বলে ওর ক্ষেত্রে শুনানি হচ্ছে, সওয়াল হচ্ছে। অনেকের ক্ষেত্রে শুনানির তারিখই পাওয়া যায় না। বছরের পর বছর শুনানি হয় না।"
সুদীপ্ত সেনের নজির
সারদা অর্থলগ্নি মামলায় অভিযুক্ত সুদীপ্ত সেন ও তার ঘনিষ্ঠ দেবযানী মুখোপাধ্যায়ের কারাবাস এক যুগেরও বেশি হয়ে গেল। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে এই দুজন গ্রেপ্তার হন। তারা যে ধরনের অপরাধে অভিযুক্ত, সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে সাত বছরের কারাদণ্ড। তাদের ক্ষেত্রে তদন্ত প্রক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয়নি, বিচার প্রক্রিয়া নিয়েও কোনো সাড়াশব্দ নেই। অথচ তারা জামিনও পাননি।
নিয়োগ মামলায় জামিন দিতে গিয়ে হাইকোর্ট তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছে বিনা বিচারে অভিযুক্তকে জেলবন্দি রাখা মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধে। অথচ সারদা সংস্থার কর্ণধার সুদীপ্ত সেন ও অন্যতম কর্তা দেবযানী এখনো জেলেই রয়েছেন। সুদীপ্ত সরাসরি আদালতে তার আর্জি পাঠিয়েছিলেন যে তাকে জামিন দেয়া হোক।
ভারতের আইন অনুযায়ী, প্রথমবার যদি কেউ জেলবন্দি থাকে তাকে অবশ্যই ৫০ শতাংশ সাজা খাটা হয়ে যাওয়ার পর জামিনে মুক্তি দিতে হবে। রঞ্জিত বলেন, "ভারতের আইন অনুযায়ী কাউকে দীর্ঘকাল বিনা বিচারে জেলে আটক রাখা যায় না। আইপিসির ধারাতে পরিষ্কার বলা আছে, কারো বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়, তার ৫০ শতাংশ যদি সাজা খাটা হয়ে গিয়ে থাকে এবং বিচার যদি শেষ না হয়, তাহলে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে হবে। একমাত্র সন্ত্রাসবাদী এবং জঘন্য অপরাধে অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে অন্যথা হতে পারে।"
যদিও এর সঙ্গে একমত নন তৃণমূল মুখপাত্র তথা আইনজীবী বৈশ্বানর
চট্টোপাধ্যায়। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "এরকম কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই যে বিচার শেষ হয়নি, অথচ ৫০ শতাংশ সাজা খাটা হয়ে গেলে জামিনে মুক্তি হবে। বহু ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা অনেকদিন ধরে কাস্টডিতে আছে, কোর্ট মনে করেছে এই কেসে তাদের জামিন দেবেন না, বিরল থেকে বিরলতম ঘটনায় তারা জামিন দেয়নি। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছে, এটার একটা সামাজিক ইম্প্যাক্ট আছে। তাই তারা জামিন দেয়নি।"
রঞ্জিতের বক্তব্য, "এটা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট লাগাতার সমস্ত রাজ্য সরকার এবং জেল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ পাঠাচ্ছে। তাতে বলা হচ্ছে, যে বিচারাধীন বন্দিদের সম্ভাব্য সাজার ৫০ শতাংশ এবং নতুন আইনে সাজার এক-তৃতীয়াংশ খাটা হয়ে গিয়েছে, তাদের জামিনে মুক্তি দিতে হবে।"
নিয়োগ দুর্নীতিতে বিপুল টাকার লেনদেন হয়েছে। তাই দীর্ঘ দিন জামিন না পেলে অপরাধ লঘু হয় না।
ফিরদৌস শামীমের যুক্তি, "অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হয়েছে। এমনি এমনি তো আর তিনি তার বাড়িতে কাউন্টার খোলেননি যে লোকে সেখানে গিয়ে টাকা জমা দিয়ে এসেছে। তা তো নয়। যদি না তার সঙ্গে কারো সংসর্গ থাকে যিনি প্রভাব খাটিয়ে চাকরি দিতে পারেন। এছাড়া অর্পিতার সঙ্গে তার যৌথ সম্পত্তিও পাওয়া গেছে। সুপ্রিম কোর্ট সে কথাও বলেছে।"
প্রভাবশালী তত্ত্ব
প্রভাবশালীর তত্ত্ব মেনে শামীম বলেন, "পার্থ চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত প্রভাবশালী মানুষ, তিনি যে কোনো সময় সাক্ষীদের ভয় দেখাতে পারেন। যে কোনো সময় তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে পারেন। এইরকম একজন প্রভাবশালী মানুষকে কেন জামিন দেওয়া হবে এই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে? খুব সঙ্গত কারণেই সুপ্রিম কোর্ট তাকে জামিন দেয়নি।"
ফিরদৌস শামীম মনে করেন, "হোয়াইট কলার অফেন্ডার দের বিরুদ্ধে আরও কঠোর আইন আনা উচিত। আদালত যদি মনে করে এমন একজন মানুষকে জেলে রেখে ট্রায়াল সম্পন্ন করা উচিত, তা হলে সেটাই করা উচিত। এই ধরনের উচ্চ পদমর্যাদাসম্পন্ন মানুষদের বিচার পর্বে কখনোই জেলের বাইরে আনা উচিত নয়। "
বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "জামিন নিয়ম, জেল ব্যতিক্রম--- কথাটা সাধারণ কথা। কিন্তু যখন দেখা যায় যে, কোনো একজন অভিযুক্ত যার বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তাকে মুক্ত রাখলে বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে, তখন বিচারকরা তাকে জামিন দেন না। পার্থ চট্টোপাধ্যায় মন্ত্রী ছিলেন, মন্ত্রী থেকে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে তিনি এই দুর্নীতিগুলো লালনপালন করেছেন। এত ক্ষমতাশালী মানুষ যদি ছাড়া পেয়ে যান, তার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষ্য দেবেন, তাদের প্রভাবিত করতে পারেন। সেই কারণেই জামিন দেয়া হচ্ছে না পার্থকে।"
তিনি মনে করেন, "তৃণমূলের মন্ত্রিসভা থেকে তিনি সরেছেন। তা সত্ত্বেও তার একটা ব্যাপক প্রভাব থাকবে, যিনি এত দিন মন্ত্রী ছিলেন। আর খানিকটা নৈতিকতার প্রশ্নও থাকে। যারা ক্ষমতা পেয়েছেন জনগণের সেবা করবেন বলে, সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করেন, এই সামগ্রিক বিষয়টার বিচার হয়।"
যদিও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে রঞ্জিতের বক্তব্য, "সুপ্রিম কোর্ট যে যুক্তিগুলো তুলেছে, তার মধ্যে যথেষ্ট মেরিট আছে। এটা তো ঠিক কথা যে পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিয়োগ দুর্নীতিতে কিং পিন ছিলেন। তবে তার বিচার দ্রুত শেষ করে, হয় তাকে শাস্তি দেয়া হোক, নয় তো তাকে জামিন দিতে হবে। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে শুধু নয়, সবার ক্ষেত্রে একই নিয়ম অনুসরণ করা উচিত।"