লেখাটি নিয়ে ভাবতে বসে আজ বন্ধুর সেই উক্তিটিই বারবার মনে পড়ছে। সেইসঙ্গে এ-ও ভাবাচ্ছে, গত প্রায় ৫৫ বছরে আমরা কি পেরেছি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে নানা আঙ্গিকে, নানামাত্রায় সততার সাথে দেখতে? আমরা কি পেরেছি আমাদের ইতিহাসের অনিবার্যতাকে সকল স্বার্থ ও সংকীর্ণতার উর্ধ্বেউঠে বিবেচনা করতে?
ষাটের দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস পড়লে আমরা দেখি, কী চমৎকারভাবে সংস্কৃতি আর রাজনীতি হাত ধরাধরি করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য জনগণকে তৈরি করে চলেছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ বাংলার মানুষের মনে যে সাম্প্রদায়িক বিষ ঢেলেছিল, বছর না ঘুরতেই, ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন তার বিরুদ্ধে জাতিগত পরিচয়ের মশাল তুলে ধরে। মানুষের পরিচয় তার ভাষা, সংস্কৃতি, নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস এই প্রবল সত্যকে সামনে নিয়ে আসে বাংলার মানুষের ভাষা আন্দোলন। শুরু হয় আলোর দিকে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জয়যাত্রা। এই জয়যাত্রা কেবল রাজনৈতিক ছিল না, তাতে ছিল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও মেলবন্ধন। আর পাকিস্তানের তৎকালীন জান্তা সরকারও স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিল, বাংলার মানুষের অধিকার সচেতনতার পিছনে সাংস্কৃতিক বোধের অবদান কতখানি।
এ কারণেই ১৯৫২ সালের এক দশক পরই শুরু হয় বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক বোধকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রবল বাধার মুখেও বাংলার মানুষ উদযাপন করেন প্রতিবাদী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ। এজন্য একটি জাতীয় কমিটিও গঠন করা হয়েছিল, যার সভাপতি ছিলেন বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ। কমিটির অন্যান্য সদস্যের মধ্যে ছিলেন, অধ্যাপক জি সি দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সুফিয়া কামাল, আহমেদুর রহমান, সন্জীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখ। এই কমিটির সদস্যদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর খড়্গ নেমে এসেছিল। কমিটির প্রথম সারির কয়েখজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল।
১৯৬৬ সালে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা, বাঙালির মুক্তির সনদ। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯- এই তিন বছরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত তৈরি হয়েছিল, তার রাজনৈতিক রূপান্তর ঘটে ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি থেকে পঁচিশে মার্চের আগপর্যন্ত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে পরিপূরক মিশেল আমরা দেখি, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে সম্ভবত একমাত্র ঘটনা। একাত্তরের পহেলা মার্চে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণার পর সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও অসহযোগে যোগ দেয়। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের ইতিহাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুব বেশি আলোচিত হয় না, কিন্তু এই সংগঠনটি আমাদের মুক্তিসংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মুক্তিসংগ্রামের দিনগুলোতে সংস্কৃতিকর্মীদের একত্রিত করে রাজনৈতিক আদর্শের আলোকে সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিচালনার জন্য গঠন করা হয়েছিল ‘শিল্পী সমিতি' নামে সংগঠন, যার সভাপতি ছিলেন শিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানু এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ আব্দুল হাদী। মূলত এই শিল্পী সমিতির সভাতেই পরবর্তীতে বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ গড়ে উঠেছিল, যার আহ্বায়ক ছিলেন অভিনয় ও আবৃত্তিশিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম, যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন বুলবুল ললিতকলা একাডেমির শিক্ষক আতিকুল হক ও ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম ওয়াহিদুল হক। কোষাধ্যক্ষ ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। বিক্ষিুব্ধ শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে পূর্ববাংলার ন্যায্য অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ব্যক্ত করে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন সংবাদপত্রে। এতে ৩৩জন চলচ্চিত্রশিল্পী স্বাক্ষর করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, আলতাফ মাহমুদ, জহির রায়ন, নারায়ন ঘোষ মিতা, সত্য সাহা, সুচন্দা, রোজী সামাদ, রাজ্জাক, আবুল খায়ের প্রমুখ। বিক্ষুব্ধ শিল্পী সংস্থার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় কোনো তৎকালীন রেডিও-টেলিভিশন প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। রেডিও তবুও কিছু কিছু চলছিল, যেহেতু রেকর্ডিং সুবিধা ছিল; কিন্তু টেলিভিশনে কোনো রেকর্ডিং সুবিধা ছিল না। তাই টেলিভিশন চালানো পাকিস্তান সরকারের পক্ষেও প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জেনোসাইডের পর বাংলার মানুষ শুরু করে প্রতিরোধ, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের অবদান অপরিসীম। একাত্তরের ১০ এপ্রিল গঠিত হলো মুজিবনগর সরকার ও এই সরকার শপথ নিলো ১৭ এপ্রিল। তথ্য, বেতার ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের হাতেই। মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রচার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ১৯৭১ সালের ২৫ মে (বাংলা ১১ জ্যৈষ্ঠ) কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র তার আনুষ্ঠানিক সম্প্রচার শুরু করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন গড়ে ওঠে, যার নাম ছিল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি, যার সভাপতি ছিলেন খ্যাতিমান চলচ্চিত্রনির্মাতা জহির রায়হান ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন চলচ্চিত্রশিল্পী সৈয়দ হাসান ইমাম। এই সংগঠনটির উদ্যোগেই নির্মিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ দলিল জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড। এই চলচ্চিত্রটি করার জন্য বিনা ভাড়ায় একটি ক্যামেরা দিয়েছিলেন ভারতের বিখ্যাত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হরিসাধন দাশগুপ্ত। স্টপ জেনোসাইডের ইংরেজি ন্যারেশনটি লিখেছিলেন চলচ্চিত্রনির্মাতা আলমগীর কবির, পাঠও করেছিলেন তিনিই। আর বাংলা ধারাভাষ্যটি পড়েছিলেন প্রয়াত সংস্কৃতজন জনাব আলী যাকের।
মুক্তিযুদ্ধকালীন আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংগঠন হলো মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা। এই সংস্থার ওপরই পরবর্তীতে নির্মিত হয়েছে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের মুক্তির গান প্রামাণ্যচিত্রটি। সংগঠনটি মুক্তিযুদ্ধ শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের গান শোনাতো, পরিবেশনা করতো শরণার্থী শিবিরগুলোতেও। তাদের এই সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ইতিহাস ক্যামেরাবন্দী করেছিলেন মার্কিন প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতা লিয়ার লেভিন।
মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার সভাপতি ছিলেন সন্জীদা খাতুন ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান বেনু। কোলকাতার ১৪৪ লেনিন সরণিতে ছিল তাঁদের দপ্তর। তাঁদের উদ্যোগেই পরিবেশিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন জনপ্রিয় গীতি-আলেখ্য রূপান্তরের গান। এটি লিখেছিলেন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শাহরিয়ার কবির এবং মঞ্চ, পোশাক ও আলোক পরিকল্পনা করেছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার।
দুই
মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস, স্মৃতিচারণ ও নানা ঘটনাবলী নিয়ে গত ৫৫ বছরে নানা ধরনের কাজ হয়েছে। কিন্তু সে কাজগুলোর কতটা প্রকৃত অর্থেই মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে তুলে ধরেছে, তা নিয়ে নানা মতবিরোধও আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যে বিষয়গুলো নিয়ে মতবিরোধ আছে, আমরা কি সেগুলো সমাধানের কোনো আন্তরিক চেষ্টা করেছি? বাংলাদেশে দীর্ঘ একটি সময় স্বাধীনতাবিরোধীরা ইতিহাসের বিকৃতি ঘটিয়েছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পড়েছে তার কুপ্রভাব। জানি না, সেই কুপ্রভাবের প্রতিফলনই এখন দেখতে হচ্ছে কি না!
ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না, বদলানোও যায় না। সবকিছুর উর্ধ্বে ইতিহাস চলে তার নিজস্ব গতিতে। ক্ষমতার জোরে বা ষড়যন্ত্র করে চাইলেই একটি দেশের জনগণের রক্ত দিয়ে কেনা জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করা যায় না, বদলানো যায় না পতাকা, মুছে দেওয়া যায় না জাতির পিতার নাম কিংবা জাতীয় স্লোগান ‘জয় বাংলা'। সাতই মার্চ বাংলার মানুষের সার্বভৌমত্ব অর্জনের এক চূড়ান্ত ঘোষণা, তাকে অস্বীকার করা আর বাংলাদেশের অস্তিত্ব অস্বীকার করা একই।
কিন্তু দহনকালে অন্ধত্বের চেয়ে বড়ো রোগ আর কী আছে? এই অন্ধত্ব ঘুচাতে ইতিহাসের পাঠ সবচেয়ে জরুরি বলেই মনে করি। বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস, দর্শন, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের মূল চারনীতির নিবিড় পাঠ জরুরি। এই জরুরি কাজটি করার দায় যেমন অগ্রজদের আছে, তেমনি যারা তরুণ, তাদেরও আছে। ইতিহাসচর্চার কাজটি কখনও একমুখী হতে পারে না। পাঠাভ্যাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে দেয়ালে পিঠ ঠেকতে বেশি সময় লাগে না। পৃথিবীর বহু জাতি আমাদের সামনে এই সত্যের নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।