''আমাদের জাতীয়তাবাদী শাসকেরা সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট''
১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ড. সলিমুল্লাহ খান অবশ্য মনে করেন, জাতীয়বাদের দুই রূপ থাকলেও তাকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই৷ আর এখন বাংলাদেশে চলছে ইংরেজি জাতীয়তাবাদ৷
ডয়চে ভেলে: ১৮ শতকে জাতীয়তাবাদের ধারণার প্রয়োজন কী ছিল?
সলিমুল্লাহ খান: সাম্রাজ্যের ভিতরে বাস করার যে কঠিন অভিজ্ঞতা মানুষের সেখান থেকেই জাতীয়তাদের উন্মেষ ঘটে৷ এটা ১৮ শতকে নয়, আরো আগে ১৬ শতকে এর উন্মেষ৷ জনগণ যখন তাদের ভাষা, সংস্কৃতি বা তাদের জীবনের অন্যান্য সমৃদ্ধি বাড়াতে বাধা পায়৷ তখন মনে করে রাষ্ট্রই যখন সকল ক্ষমতার উৎস তখন আমরা আলাদা একটা রাষ্ট্র করি না কেন৷ আবার দুই সাম্রাজ্যের মধ্যে যখন দ্বন্দ্ব হয়, ধর্মীয় সাম্রাজ্য আরেকটি ধর্মনিরপেক্ষ সাম্রাজ্য তখন মানুষ নিজেকে আলাদা করার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে৷ কেউ জাতিগোষ্ঠীর ভিত্তিতে করেছে৷ কেউ ধর্মের পরিচয়ে আলাদা হওয়ার চেষ্টা করেছ৷
জাতীয়তাবাদের উন্মেষের জন্যতো নানা উপাদান কাজ করেছে...
দু'টো উপাদান কাজ করেছে৷ একটা হলো জাতি বলতে জাতির শাসকদের বুঝায়৷ আরেকটা জতির হলো জনগণকে বুঝায়৷ আমরা যাকে বলি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার৷ এটা হলো জাতীয়তাবাদের প্রগতিশীল দিক৷ আমি অপর জাতি দিয়ে শাসিত হবো৷ আমি দ্বিতীয় শ্রেণি, তৃতীয় শ্রেণির প্রজা হবো কেন? এটার নাম জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার৷ এর একটা প্রতিক্রিয়াশীল দিকও আছে৷ এক জাতি আরেক জাতিকে নির্যাতন করার জন্য জাতীয়তাবাদের পতাকা তুলে ধরে৷ আমরা ব্রিটিনের হাত থেকে মুক্ত হয়ে জাতি রাষ্ট্রের দাবি তুলেছি৷ গঠন করেছি৷ কিন্তু পরে দেখা গেছে শাসকরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে শাসন করেছে৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরোধী হিসেবে নয়৷ এটা দুর্ভাগ্যজনক৷ আফ্রিকাতেও একই ঘটনা ঘটেছে৷ তার মানে আমাদের শাসকরা জাতীয়তাবাদের নামে যারা লাভবান হয়েছে তারা কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হয়েছে মাত্র৷
বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের নির্ধারক তাহলে কী?
এখানে কোনো কিছুই নির্ধারক নয়৷ এটা কৃষ্ণ সাহেবদের ক্রোধ৷ কৃষ্ণ সাহেব কী? আমরা, আপনি আমি৷ যারা দুই ধরনের পুঁজির মালিক৷ টাকা পয়সাও একটা পুঁজি৷ বিদ্যা বুদ্ধিও একটা পুঁজি৷ এই দুই ধরনের পুঁজি নিয়ে যারা ইংরেজ তাড়ানোর পরে রাজকীয় আসন নিয়ে বসে আছে তারা জাতির নামেই কিন্তু ক্ষমতা দখল করেছে৷ তারা গাছে উঠে মইটা লাথি মেরে ফেলে দিয়েছে৷ ইংজেরা যেভাবে আমাদের দেশের জনগণকে শোষন করত৷ আমাদের বর্তমান শাসকরা কি তার চেয়ে কম শোষন করছে?
আমরা পাকিস্তানি জাতীয় শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলেছিলাম৷ কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ছিল স্রেফ হিন্দু জাতীয়তাবাদ৷ কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক শাসন জারি করতে খন্দকার আব্দুল হামিদ, জিয়াউর রহমান এরা বললেন তাহলে আমরা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ব্যবহার করি৷ এটার মধ্যে তারা হিন্দু গন্ধ পেয়েছিলো৷ বাঙালি জাতির মাধ্যমে যদি হিন্দু মুসলিমকে ঐক্যবদ্ধ না করতে পারি তাহলে এটার দরকার কী৷ যেই তারা গাছে উঠে গেল৷ মইটা আবার ফেলে দিল৷ হিন্দুদের মাইনরিটি করল৷ এবার মেজরিটি মুসলিমদের একটা জাতীয়তাবাদ করলো৷ সেটা হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ৷
এখন বাংলাদেশে যে জাতীয়তাবাদ চলছে৷ বাঙালি আর বাংলাদেশি যাই হোক৷ এটা হলো ইংরেজি জাতীয়তাবাদ৷ সংবাদমাধ্যম, রেডিওর নাম ইরেজিতে৷
জাতীয়তাবাদের নামে কি ক্ষূদ্র জাতিসত্বাকে গ্রাস করা হচ্ছে না?
জাতীয়তাবাদতো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুই সময়ে দুই ধরনের ভূমিকা পালন করেছে৷ এক সময় সে জাতীয় মুক্তির পতাকা তুলে এসেছে৷ তারপরে সে শুধু স্বৈরাচারী নয়, হত্যাকারী হয়েছে৷
তাহলে জাতীয়তাবাদ কি বিভক্তি তৈরি করছে? বিশ্বায়নের যুগে তার প্রয়োজনীয়তা কোথায়?
জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে সেই জাতির নাম মানব জাতি৷ সেই জাতিতে পৌঁছার পর আমরা এখন যে জাতির মধ্যে বাস করি সেই ভাষা ভিত্তিক বা অন্য ভিত্তিতে যে জাতি সেটাকে অতিক্রম করার কোনো সুযোগ নেই৷ জাতীয় পরিচয়কে অবহেলা করে আন্তর্জাতিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই৷
ড. সলিমুল্লাহ খানের সাক্ষাৎকারটি নিয়ে আপনার মতামত জানান নীচের ঘরে৷