1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আবাসে মানুষের হানা, বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্তির পথে হাতিরা

সমীর কুমার দে ঢাকা
২৭ নভেম্বর ২০২১

বাংলাদেশে হাতি চলাচলের স্থান, বাসস্থান সবকিছুই দখল করে নিচ্ছে মানুষ৷ নিজেদের আস্তানা হারিয়ে লোকালয়ে গেলে মেরে ফেলা হচ্ছে হাতিদের৷ এভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি থেকে এশীয় হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷

https://p.dw.com/p/43ZbQ
কক্সবাজারে গত ৯ নভেম্বর একটি মৃত হাতিকে ঘিরে মানুষছবি: Bangladeschs Forest Department/AFP

গত দুই বছরে বাংলাদেশে অন্তত ২১টি হাতির মৃত্যু হয়েছে৷ আর ২৫ বছরের হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা ১৫০টিরও বেশি৷ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) এবং বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালেই ১১টি হাতির মৃত্যু হয়েছে৷ সব ঘটনাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার এলাকার৷ আর চলতি বছরে মারা গেছে আরও ১০টি হাতি৷ এর সবগুলোই গুলি করে বা বিদ্যুৎস্পর্শে মারা হয়েছে৷ 

গত শতাব্দীর শেষদিকেও দেশে হাতি ছিল ৫০০টি৷ ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই সংখ্যা নেমে এসেছে ২৬৩ তে৷ 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং এশিয়ান এলিফেন্ট স্পেশালিষ্ট গ্রুপের সদস্য মোহাম্মদ মোস্তাফা ফিরোজ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এভাবে একের পর এক হাতি মারা যাচ্ছে, অথচ এটা নিয়ে সরকারের কোন পক্ষই ভাবছে না৷ বেসরকারি সংস্থাগুলোরও কোন তৎপরতা নেই৷ এভাবে চলতে থাকলে হাতি রক্ষা করাই কঠিন হয়ে যাবে৷ আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে৷ হাতি লোকালয়ে আসছে না বরং হাতির আবাসভূমিতে মানুষ ঢুকে পড়ছে, হাতির জায়গা দখল করছে৷’’

মোহাম্মদ মোস্তাফা ফিরোজ

কেন মারা যাচ্ছে এত হাতি? 

বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে হাতির বিচরণের পথ দ্রুত কমে আসছে৷ গত ছয় বছরে বন্ধ হয়ে গেছে হাতি চলাচলের অন্তত তিনটি করিডোর৷ বাধ্য হয়ে বিশালাকার এ প্রাণীটি মানুষের বসতি এলাকা দিয়েই চলাচলের চেষ্টা করছে৷ আর মানুষ আতঙ্কিত হয়ে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে তাদের হত্যা করছে৷

বাংলাদেশের মোট হাতির ৫৫ শতাংশই থাকে কক্সবাজার অঞ্চলে৷ বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কক্সবাজারের যেখানটায় রোহিঙ্গারা বসতি করেছে, তার পুরোটাই ছিল হাতির বিচরণক্ষেত্র৷ সেই আবাস এখন ধ্বংস হয়ে গেছে৷ অন্যদিকে, শেরপুরের বনাঞ্চলে অনেক হাতি ভারতের মেঘালয় থেকে খাবারের সন্ধানে বাংলাদেশের দিকে চলে আসে, বিশেষ করে বর্ষার পরে যখন নতুন ঘাস জন্মায় এবং পাকা ধানের মৌসুমে৷ অনেক হাতিই এখানে থেকে যাচ্ছে, বাচ্চা প্রসব করছে৷ কিন্তু গত এক দশকে বন বিভাগের বহু জমি মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় হাতির এই বিচরণক্ষেত্র হাতির জন্য আর নিরাপদ নেই৷’’

বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় থাকা এশীয় হাতির এভাবে একের পর এক মৃত্যুতে উদ্বেগ জানিয়েছেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা৷ এ নিয়ে সম্প্রতি চট্টগ্রাম, শেরপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো৷ নির্বিচারে বন্য হাতি হত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করে তারা বলেছে, হাতি রক্ষায় প্রশাসনের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই৷ হাতির মৃত্যুর ঘটনায় সঠিকভাবে মামলাও হয় না৷ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হলে বাংলাদেশ থেকে এশীয় হাতি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা পরিবেশবাদীদের৷

রফিকুল ইসলাম চৌধুরী

তবে বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘সম্প্রতি যে হাতিগুলোর মৃত্যু হয়েছে সবগুলো ঘটনায় মামলা হয়েছে৷ হাতিকে গুলি করে হত্যাকারী একজনকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে৷ তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে৷’’

কমছে বিচরণক্ষেত্র, চলার পথ

ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার-আইইউসিএন বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর রাকিবুল আমিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘হাতির অবাধে বিচরণের জায়গাগুলো দ্রুত কমে আসছে৷ বন এলাকায় মানুষের বসতি বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রকল্পের কারণে হাতির চলাচলের অনেক করিডোর বন্ধ হয়ে গেছে৷ হাতির চলাচলের পথে বাধা এলে ঘটে মানুষের সঙ্গে সংঘাত৷ খাবারের ভাণ্ডারে টান পড়ার কারণেও জনপদে হানা দিচ্ছে তারা৷ বাধা পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে চড়াও হচ্ছে মানুষের ওপর৷ ২০১৬ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, বৃহত্তর চট্টগ্রামে হাতি চলাচলের ১১টি করিডর ছিল৷ এর বেশির ভাগ কার্যত বন্ধ৷''

আইইউসিএনের ২০১৬ সালের সমীক্ষায় হাতির জন্য ঝুঁকি হিসেবে বনভূমি দখল ছাড়াও বন ঘেঁষে ধানসহ ফসল চাষ বৃদ্ধি পাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছিল৷ পাহাড় ও বনে অবৈধ বসতি স্থাপন করার কারণে বন্য হাতির আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে৷ শেরপুর সহকারী বনরক্ষকের কার্যালয়ের হিসাবে, জেলার প্রায় ২০ হাজার একর বনের মধ্যে অবৈধ দখলে রয়েছে দুই হাজার ৪০০ একর৷

হাতি আর মানুষের সংঘাত কমাতে অভিনব উদ্যোগ

হাতি রক্ষায় আইনে কী আছে?

বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে হাতি হত্যার মামলা জামিনের অযোগ্য৷ অপরাধীকে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারদণ্ড এবং সর্বনিম্ন এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে৷ একই অপরাধ পুনরায় করলে সাজা সর্বোচ্চ ১২ বছর কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা৷ 

বন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে হাতি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৪টি৷ তবে একটিরও নিষ্পত্তি হয়নি৷ কেউ সাজা পেয়েছে- এমন নজির নেই৷

হাতির বিচরণ নিয়ে ২০১৯ সালে আইইউসিএন গবেষণায় বলা হয়, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে হাতির আবাসভূমি ও চলাচলের পথগুলো নিয়মিতভাবে দখল হয়ে যাচ্ছে৷ সেখানে গাছপালা কেটে ফসলের চাষ হচ্ছে৷ বনের বাইরেও ধানের চাষ বাড়ছে৷ খাদ্য সংকটে অভুক্ত হাতি আমন ধান পাকলে তা খেতে বনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে৷ এ সময় কিছু মানুষ বিদ্যুতের তারের ফাঁদ পেতে অথবা গুলি করে হাতি মেরে ফেলছে৷

রাকিবুল আমিন

ক্ষতিপূরণ পাওয়ার নিয়ম কী?

হাতি যাদের ফসল নষ্ট করছে, তাদের ক্ষতিপূরণ বাবদ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার নিয়ম রয়েছে৷ কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষতিপূরণ পেতে পদে পদে ভোগান্তির শিকার হতে হয়৷ চলতি বছর চট্টগ্রাম অঞ্চলে ১৫ জন ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক আবেদন করলেও বেশিরভাগই টাকা পাননি৷ এ বিষয়ে বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, অনেকে নিয়ম মেনে আবেদন করছেন না৷ এতে ক্ষতিপূরণ দিতে সময় লাগছে৷

হাতি রক্ষায় কী করা প্রয়োজন?

হাতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এইচ এম রায়হান সরকার৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘হাতির প্রতি মানুষ এতটা নির্মম হচ্ছে কেন- তা খতিয়ে দেখতে হবে৷ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নতুন করে ভাবতে হবে বন বিভাগকে৷’’ 

তার মতে, ‘‘রাজনৈতিক সরকারের নেতাদের প্রতিশ্রুতি নেই৷ হাতি রক্ষায় প্রথমে তাদের প্রতিশ্রুতি দরকার৷ এখন বনের মধ্যে আপনি বাড়ি করলে, চাষাবাদ করলে হাতি যাবে কোথায়? ফলে সেখানে যারা মারা যাচ্ছে তারা কিন্তু ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না৷ মানুষ কেন বনের মধ্যে যাচ্ছে? সেটা আগে শনাক্ত করতে হবে৷ সেই অনুযায়ী সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে৷ তাহলেই হাতি রক্ষা করা সম্ভব৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান