1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে উৎসব, বিএনপি কার্যালয়ে তালা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৯ নভেম্বর ২০২৩

বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতিতে দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কার্যালয়ের সামনে এখন বিপরীত চিত্র।

https://p.dw.com/p/4Z9HO
রোববার দুপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় শত শত নেতা-কর্মীর ভিড়
রোববার দুপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় শত শত নেতা-কর্মীর ভিড়ছবি: Mamun Shohag/DW

আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে এখন দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী ও তাদের অনুসারীদের বেজায় ভিড়। এত ভিড় যে তা ঠেলে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও রোববার কার্যালয়ে ঢুকতে ব্যর্থ হন।

আর বিপরীতে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রতিবাদে বিএনপির ডাকা ৪৮ ঘণ্টা হরতালের প্রথম দিনে দলটির নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে কোনো নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি। এখনো কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। সামনে আছেন শুধু পুলিশ এবং সাংবাদিক।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন," এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। পরিস্থিতি যা তাতে মনে হচ্ছে ২০১৪ সালের মতো একটা এক পাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। এতে রাজপথে অস্থিরতা আরো বাড়বে।”

এদিকে সরকারের তিন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ও পাঁচ উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন।সংসদ সদস্য নন মন্ত্রিসভার এমন তিনজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। আর সংসদ সদস্য নন প্রধানমন্ত্রীর এমন পাঁচ উপদেষ্টাও পদত্যাগ করেছেন।

বাংলাদেশে আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণের তফসিল দিয়েছে নির্বাচন।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এখনো তালা ঝুলছে
নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এখনো তালা ঝুলছেছবি: Mamun Shohag/DW

কমিশন। ৩০ নভেম্বর মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন। বিএনপি ও তাদের সমমনা রাজনৈতিক দল ওই তফসিল প্রত্যাখ্যান করে সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের  অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির নয়া পল্টনের সমাবেশে সহিংসতার পর থেকে দলটি টানা হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিদিয়ে আসছে। শুধু শুক্র ও শনিবারে তাদের ওই ধরনের কর্মসূচি থাকছেনা।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির শীর্ষ নেতারা এখন কারাগারে আছেন। বিএনপি অভিযোগ করেছে, ২৮ জুলাই থেকে এ পর্যন্ত তাদের ১৬ হাজার ১৯১ জন নেতা-কর্মীকে আটক করা হয়েছে। মামলা দেয়া হয়েছে ৬৮৯টি আর এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৫৭ হাজার ৫২৩ জনকে। এই সময়ে একজন সাংবাদিকসহ নিহত হয়েছেন ১৪ জন। আহত হয়েছেন ছয় হাজার ২২৪ জনের বেশি। এই সময়ে " মিথ্যা মামলায়” ১৪৪ জনকে আদালতের মাধ্যমে দণ্ড দেয়া হয়েছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ পণ্ড হওয়ার দিন থেকেই তালা ঝুলছে। যদিও গত সপ্তাহে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান দাবি করেছেন, বিএনপি কার্যালয়ে তারা নয়, বিএনপিই তালা দিয়ে চাবি নিয়ে গেছে। কার্যালয়ে ঢুকতে নেতা-কর্মীদের কোনো বাধা নেই। তবে  এরপর কেউ কেউ কার্যালয়ের সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের আটক করে বলে বিএনপির অভিযোগ।

রোববার দুপরের পর বিএনপি কার্যালয়ে গিয়ে তালা ঝুলতে দেখা গেছে। সাংবাদিক ও পুলিশ ছাড়া বিএনপির কাউকে পাওয়া যায়নি।

বিএনপি নেতারা যারা বাইরে আছেনতাদের তেমন প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছেনা। গ্রেপ্তার এড়াতে তারা সাবধানে চলাফেরা করছেন।  ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির  সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রহুল কবির রিজভি দলের পক্ষে নিয়মিত ব্রিফিং করলেও তা অনলাইনে অজ্ঞাত স্থান থেকে করছেন।

এদিকে তফসিল ঘোষণার পর থেকেই নির্বাচনের কাজ শুরু করে দিয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। শনিবার থেকে তারা বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর দলীয় কার্যালয় থেকে ৩০০ আসনে দলীয় মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি শুরু করেছে। মঙ্গলবার পর্যন্ত মনোনয়ন ফর্ম কেনা ও জমা দেয়া যাবে। প্রথম দিন এক হাজার ৫৪টি মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি হয়েছে। দ্বিতীয় দিন রবিবার দুপুর একটা পর্যন্ত ৬০৫টি মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি হয়েছে।

প্রতিটি ফর্ম ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার রেকর্ড পরিমাণ মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি হতে পারে বলে জানা গেছে। একটি আসনে ছয়-সাত জন করে মনোনয়ন ফর্ম কিনছেন। যদি পাঁচ হাজার মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি হয় তাহলে এই খাতে আওয়ামী লীগের আয় হবে ২৫ কোটি টাকা।

একটা এক পাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ: ফারুক ফয়সাল

প্রথম দিনেই দলের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন ফর্ম কিনেছেন। কিনছেন সেলিব্রেটিরাও। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার আশায় তিনটি আসনের জন্য ফর্ম কিনেছেন।

রোববার দুপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় শত শত নেতা-কর্মীর ভিড়।  মনোনয়ন প্রত্যাশীরা ব্যান্ড পার্টি নিয়ে, নেচে গেয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাজির হচ্ছেন।অনুসারীরা প্রার্থীদের ছবি দেয়া রঙ-বেরঙের টি শার্ট পরে , ব্যানার ও ফেস্টুন নিয়ে  আনন্দ মিছিল  নিয়ে হাজির হচ্ছেন।

ভিড় সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মিছিলের কারণে বিএনপির হরতালের মধ্যেও আশপাশের সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বেলা ১২টার দিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে ভিড়ের কারণে কেন্দ্রীয় কার্যলয়ে ঢুকতে ১০ মিনিট ধরে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন বলে জানা গেছে। পরে তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যান।

বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন," এখন যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া চলছে এই ধরনের নির্বাচন আমরা চাইনা। ২০১৪ সালের মতো একটা এক পাক্ষিক নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে দেশ। এতে রাজনৈতিক সহিংসতা আরো বাড়বে। আর চলমান সহিংসতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন আছে। এই সহিংসতা কারা করছে তা নিয়ে প্রশ্ন আছে।”

তার কথা," এখনো সংলাপের সুযোগ আছে। সংলাপের মাধ্যমে সব দলকে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা দরকার। নয়তো এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি খুবই কম হবে। ভোটাররা তাদের পছন্দের প্রার্থী পাবেন না। ভোট দিতে পারবেন না।”

"একটি দলের অফিসের সামনে উৎসবের আমেজ আর আরেকটি দলের অফিসে তালা। তাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। এটা কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। মানুষ আতঙ্কে আছে। নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নাই। সবার জন্য সমান সুযোগ নেই,” বলেন ফারুক ফয়সাল।

এদিকে তৃণমূল বিএনপিও মনোনয়ন ফর্ম বিক্রি শুরু করেছে। প্রথম দিন শনিবার তারা ৩৭টি ফর্ম বিক্রি করেছে।

জাতীয় পার্টিতে নেতৃত্বেও কোন্দল শুরু হয়েছে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং একাদশ সংসদেও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের মধ্যে। তাদের পক্ষ থেকে আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন কমিশনে চিঠি দেয়া হয়েছে।

রওশন এরশাদ রবিবার রাষ্ট্রপতি মো. শাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করেছেন। তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে মনোনয়ন পত্র দাখিলের সময় ৩০ নভেম্বও থেকে আরো বাড়ানোর অনুরোধ করেছেন। কারণ ৩০ নভেম্বর আয়কর রিটার্ন দাখিলেরও শেষ দিন।

অনেকেই রিটার্ন দাখিল নিয়ে ব্যস্ত আছেন। তিনি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর করতে সবার সঙ্গে আলোচনা করা যায় কি না রাষ্ট্রপতিকে সেই অনুরোধ করেন।

আর জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, "সঠিকভাবেই যদি নির্বাচন হয় তবে আমরা এককভাবে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দিতে চাই। আমরা এবার কোনো জোট, মহাজোট করতে চাই না। আমরা একটি আসন না পেলেও কোনও সমস্যা নেই। যে দল বেশি আসন পাবে সেই দল সরকার গঠন করবে।”

তিনি আরো বলেন, "নির্বাচনে যাবো কিন্তু এখনো সিদ্ধান্তে আসতে পারিনি। তবে আমাদের সকল প্রস্তুতি নেয়া আছে।”

জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন,"  আমাদের প্রত্যাশা ছিলো একটি অবাধ, শান্তিপূর্ণ , নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এখনকার বাস্তব চিত্র তার বিপরীত। এমনটা আমাদের প্রত্যাশা ছিলোনা। দেশের জনগণও এরকম প্রত্যাশা করেনা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও নয়।”

তবে তার কথায়," এখনো আশা শেষ হয়ে যায়নি। একাদশ সংসদেও বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশান রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে মনোনয়ন পত্র দাখিলের তারিখ পিছিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেছেন। সবার সঙ্গে আলোচনার কথা বলেছেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলার  আশ্বাস দিয়েছেন। সেটা হলে তফসিল রিশিডিউল হবে। তখন  সংলাপ ও সমঝোতার সময় পাওয়া যাবে। আর আন্তর্জাতিক কূটনীতি তো আছেই।”

'প্রত্যাশা ছিলো অবাধ নির্বাচনের, বাস্তবে তা বিপরীত'

এদিকে এদিকে বিএনপির সঙ্গে যারা আন্দোলনে আছে তাদের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন বাতিলের হাইকোর্টের আদেশকে বহাল রেখে রবিবার রায় দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে দলটির নিবন্ধন থাকল না।

অন্যদিকে কমনয়েলথ-এর নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অগ্রবর্তী প্রতিনিধি দল রবিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে দেখা করেছেন। তারা কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতির ব্যাপাওে জানতে চেয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের( সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন," ৭ নভেম্বর যে নির্বাচনের কথা হচ্ছে সেটা একটা এক পাক্ষিক নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এরমধ্য দিয়ে রাজনৈতিক সংকট কাটবেনা। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবেনা। বিএনপিসহ  অনেক বিরোধী দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেনা। এটা আসলে কোনো নির্বাচন হবেনা। ”

তিন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ও পাঁচ উপদেষ্টার পদত্যাগ:

সংসদ সদস্য নন মন্ত্রিসভার এমন তিনজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। আর সংসদ সদস্য নন প্রধানমন্ত্রীর এমন পাঁচ উপদেষ্টাও পদত্যাগ করেছেন।

পদত্যাগ করা মন্ত্রীরা হলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম।

পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টারা হলেন- ড. গওহর রিজভী, তারিক আহমেদ সিদ্দীক, ড. মসিউর রহমান, ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও সজিব আহমেদ ওয়াজেদ।

রোববার (১৯ নভেম্বর) সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে তারা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান সংসদ সদস্য হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেননি বলে জানা গেছে।