1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আইন কি গণপিটুনিতে হত্যা কমাতে পারবে?

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৩ মার্চ ২০২৩

বাংলাদেশে গণপিটুনি নিয়ে কখনো কখনো কখনো কথা হয়। সাধারণ মানুষ কখনো কখনো বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। ওই পর্যন্তই। কিন্তু এরপরও যে সমানভাবে গণপিটুনি চলে। অনেক মানুষের মুত্যু হয় সেই খবর আমরা আর রাখি না। হয় না বিচার।

https://p.dw.com/p/4Oc7X
মর্গে মৃতদেহের প্রতীকী ফাইল ফটো
মর্গে মৃতদেহের প্রতীকী ফাইল ফটো ছবি: Colourbox

বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই বিচারহীনতার কারণেই গণপিটুনিতে হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। দেশের প্রচলিত আইন ও তদন্ত ব্যবস্থায় সেটা অনেক কঠিনও। তাই ভারতের মত বাংলাদেশে গণপিটুনিতে হত্যার ব্যাপারে নতুন আইনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে।

বাংলাদেশে গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এই দুই মাসে আটজন নিহত হয়েছেন গণপিটুনিতে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে পাঁচজন এবং ফেব্রুয়ারিতে তিনজন। এই সংখ্যাই বলে দেয়, আলোচনায় আসুক আর না আসুক বাংলাদেশে গণপিটুনতে হত্যা চলছেই। আর আলোচনায় না আসলে পুলিশেরও কোনো তৎপরতা থাকে না। মামলা হয়। কিন্তু সেই মামলার তদন্ত বিচার ঝুলে থাকে বছরের পর বছর।

গণপিটুনিতে হত্যার বিচারের উদাহরণ মাত্র একটি:

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত একটি গণপিটুনির ঘটনায় বিচারের নজির পাওয়া যায়। ২০১১ সালের ১৭ জুলাই শবেবরাতের রাতে ঢাকার পাশেই আমিন বাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। আর ওই হত্যাকাণ্ড নিয়ে তখন সারাদেশে তোলপাড় হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পর আদালত ১৩ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৯ জনকে কারাদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু এই রায় চূড়ান্ত নয়। এখনও মামলাটি আপিল আদালতে ঝুলে আছে।

আর ২০১৯ সালের জুলাই মাসে ঢাকার উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলে ধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনু নামে এক মাকে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। তখন সারাদেশের মানুষ গণপিটুনির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। সেই ঘটনায় মামলা হলেও তার বিচার এখনো শেষ হয়নি। রেনুর ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু জানান, "এই মামলায় ১৫ জন আসামির সবাকেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিলো। কিন্তু আট জন হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে বের হয়ে গেছেন। মামলাটি দুই আইনে বিচার হচ্ছে। হত্যা মামলা এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে।”

‘শত শত লোক যখন গণপিটুনিতে অংশ নেয় তখন সবাই সমানভাবে দায়ী’

মামলায় এ পর্যন্ত ১১ জনের সাক্ষী নেয়া হয়েছে। এই মামলায় মোট সাক্ষী ৩১ জন। তিনি বলেন, "মামলার সাক্ষীদের এখন আদালতে হাজির করাই বড় চ্যালেঞ্জ। তারা সাক্ষী দিতে আসতে চান না। সমনও ঠিকমত হয় না। আর যারা জামিনে আছেন তারা নানাভাবে মামলা প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। আমাদের সঙ্গেও বার বার যোগাযোগ করছেন ৷''

রেনুকে যে বছর গণপিটুনিতে হত্যা করা সেই ২০১৯ সালেই গণপিটুনির শিকার হয়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হন, ৬৫ জন। 

কিন্তু রেনু ছাড়া আর কোনো ঘটনার বিচার শুরু তো দূরের কথা তদন্ত শেষ হয়েছে বলেও কোনা তথ্য পাওয়া যায়নি। এরপর ২০২০ সালে সারাদেশে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন ৩৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ জন। ২০২২ সালে নিহত হয়েছেন হয়েছেন ৩৬ জন।  চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে নিহত হয়েছেন আট জন। সবমিলিয়ে ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ১৭২ জন। এই তথ্য  মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। আর গণপিটুনির সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটে ঢাকা বিভাগে।

কেন বন্ধ হচ্ছে না?

আসকের সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন,"গণপিটুনি কখনোই বন্ধ হয়নি এবং অব্যাহতভাবে চলছে। দুই একটি ঘটনা আলোচনায় এলেও তার যে বিচার হয় তা কিন্তু নয়। আলোচনা- প্রতিবাদেই শেষ হয়ে যায়। এর কারণ বিচারহীনতা।”

তিনি বলেন, "আমরা দেখেছি নির্বাচনের আগে বা কোনো বিশেষ সময়ে গুজব রটিয়ে বা অন্য কোনো কারণে গণপিটুনি বেড়ে যায়। এবার নির্বাচনের আগেও সেটা হতে পারে। আর এইসব ঘটনায় মামলার কোনো তদন্ত না হলেও শত শত অজ্ঞাত আসামি থাকে, যা পুলিশকে বাণিজ্যে সুবিধা করে দেয়।”

তার কথা," গণপিটুনির পিছনে মতলববাজ বা সুযোগ সন্ধানীরা কখনো কখনো থাকে। কিন্তু অপরাধের বিচার না হওয়ার কারণেও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা আছে। তাই অপরাধের বিচার হলে মানুষ হয়তো গণপিটুনি থেকে নিবৃত্ত হতো। আর গণপিটুনিরও বিচার না হওয়ায় যারা এতে অংশ নেন তারা নিবৃত্ত হচ্ছেন না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান বলেন,"যারা এই গণপিটুনিতে অংশ নেন তাদের একাংশকে বলা হয় মব। মব সাইকোলজি খুব ভয়ঙ্কর। কয়েকজন হয়তো কোনো ঘটনায় অথবা উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাউকে পিটাতে শুরু করলো কোনো একটি অপরাধের কথা বলে তখন অনেক মানুষ কোনো কিছু না জেনেই পিটানো শুরু করে। এটা হতে পারে আমাদের সভ্যতার সংকটের কারণে, অবদমিত হওয়ার কারণে অথবা প্রচলিত বিচারের প্রতি আস্থা না থাকার কারণে। তবে যে কারণেই হোক এটা একটি বড় সংকট।”

তার কথা, "সমাজে অনেক বড় বড় অন্যায় হচ্ছে, অর্থ পাচার হচ্ছে তার কোনো বিচার হচেছ না। তা নিয়ে মানুষের কোনো প্রতিবাদ নেই। কিন্তু ছোটোখাটো অপরাধের অভিযোগে বা অভিযোগ তুলে মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হচ্ছে-এর কী ব্যাখ্যা দেয়া যায়? হতে পারে অবদমিত মানুষ যেখানে পারছে তার ক্ষোভ প্রকাশ করছে।

যেখানে ক্ষোভ প্রকাশ করে যে নিরাপদ থাকবে সেখানে করছে। হয়তো সে মনে করছে অনেক মানুষের মধ্যে তাকে চিহ্নিত করা যাবেনা। তবে সবটাই আমাদের  মানসিক, সামাজিক, আইন-শৃঙ্খলা ও বিচার ব্যবস্থার প্রতিফলন।”

আর সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু বলেন,"রেনু হত্যার বছর আরো তো অনেকে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছেন। তাদের ব্যাপারে তো বিচারের কোনো উদ্যোগ দেখছিনা। রেনু হত্যার বিচারও তো ঝুলছে। এটার বিচারও দ্রুত হলে মানুষের কাছে একটা মেসেজ যেত। আসলে গণপিটুনি বন্ধে প্রয়োজন বিচার এবং দ্রুত বিচার।

নতুন আইনের কথা ভেবে দেখা দরকার:

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, "আমাদের এখানে গণপিটুনি বা গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনায় দণ্ডবিধিতে মামলা হয়। দুই-চারজন মিলে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করলে নির্ণয় করা সম্ভব কার পিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শত শত লোক যখন গণপিটুনিতে অংশ নেয় তখন তা নির্ণয় করা কঠিন। সেক্ষেত্রে সবাই সমানভাবে দায়ী। কিন্তু সাক্ষ্য আইনে আবার হত্যাকাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিলো তা আদালতে সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণ করতে হয়। আবার সাক্ষী পাওয়াও কঠিন হয়। রেনুর মেডিকেল রিপোর্টে দেখা গেছে  আঘাতে তার পুরো শরীরেই রক্ত জমে গেছে, থেতলে গেছে। ফলে কোন আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে তা নির্ণয় করা কঠিন। এর বাইরে গণপিটুনির ঘটনায় আলামত পাওয়া কঠিন এবং মামলা করতে দেরি হলে আলামত নষ্ট হয়ে যায়৷”

এইসব কারণে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত গণপিটুনির ঘটনায় কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে দ্রুত মামলা করা, আলামত সংরক্ষণ করা, এএসপির নিচে নয় এমন পুলিশ কর্মকর্তাকে দিয়ে মামলার তদন্ত করা। ইশরাত হাসান বলেন,"গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা জটিল প্রকৃতির বলে আদালত ওই নির্দেশনা দেন। কিন্তু তা অনুসরণ করা হচ্ছে না।”

তার কথা,"ভারতে আদালতের নির্দেশে এব্যাপারে আলাদা আইন হয়েছে। আমাদের এখানেও সেটা ভেবে দেখা যায়। তবে আমাদের সাক্ষ্য আইনে এখন ভিডিও, ফটো, অডিও গ্রহণ করার বিধান আছে। তাই এখন অপরাধীদের সনাক্ত করা আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। সাক্ষী না পাওয়া গেলেও ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে বিচার করা যায়।”

"আর বিচার হতে হবে দ্রুত। গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে করা উচিত। দ্রুত বিচার হলে টনক নড়বে। রেনু হত্যার বিচার কিন্তু এখনো হয়নি,” বললেন এই আইনজীবী৷