1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অস্তিত্ব রাখতে নির্বাচন, নির্বাচনী চিন্তায় অস্তিত্ব বিসর্জন

মোস্তফা মামুন
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২

একসময় এক সিনে রিপোর্টারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল৷ এতটাই যে আমরা অনেকদিন হাউসমেট ছিলাম৷ হাউসমেট হওয়ার পর সিনে তারকাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা টের পেলাম৷ একদিন ঢাকাই ছবির এক নামকরা তারকা বাসায় হাজির উপহার আর ফলমূলের পসরা নিয়ে৷

https://p.dw.com/p/46WRH
ছবি: Rajib Paul

নিজে তখন পুরোদস্তুর ক্রীড়া সাংবাদিক৷ খেলার অঙ্গনের মানুষের সঙ্গে খাতিরও আছে যথেষ্ট কিন্তু সিনে সাংবাদিকের তুলনায় সমাদর এত কম যে মাঝে মধ্যে তাকে ঈর্ষা হত৷ কোনো একদিন আড্ডায় সেটা প্রকাশও করে ফেললাম৷ সিনে সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ‘আসলে সিনেমার জগতের মানুষের মন অনেক বড়৷ বড় পর্দা তো৷ সবকিছু বড় করে দেখে৷'

কথাটা মনে ধরেছিল৷ বড় পর্দা৷ তাই এরা সব বড় মানুষ৷ সেই বড় মানুষরা সময়ে ছোট হয়েছে৷ সিনেমা জৌলুশ হারিয়ে এমন অন্ধকারে গেছে যে নিজেই ভালোমতো আর নায়ক-নায়িকাদের চিনি না৷ পত্রিকায় পড়ি, অমুক নায়িকা অতগুলো ছবি করে বসেছেন৷ নিজের অজ্ঞতায় লজ্জা পাই৷ চুপিচুপি বোঝার চেষ্টা করি, তাকে বা তাদের না চেনা আমার চেনার অক্ষমতা নাকি তাদের চেনানোর ব্যর্থতা৷ আশপাশের একে-ওকে জিজ্ঞেস করি, ‘অমুক নায়িকাকে চেনেন?'

‘কী নাম বললে?'

‘নাম শুনেননি! অতগুলো ছবিতে সাইন করেছে৷ অতগুলো মুক্তি পেয়েছি৷'

ঐ পক্ষ ভাবে৷ শেষে হাসে৷ যে হাসির অর্থ এখন ঢাকার সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের না চেনাই স্বাভাবিকতা৷

সেসব নায়ক-নায়িকা বছরে এখন একবার নিজেদের চেনান৷ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে৷ অথবা নির্বাচনী উত্তেজনায় অংশ নিয়ে৷ আর নিজেদের চেনাতে গিয়ে যা যা করেন তাতে ভেবে অবাক হই, একসময় এই সিনেমা জগতে কীসব কিংবদন্তিরা ছিলেন! ব্যক্তিত্বের বিস্তৃত ছায়া আর কৃতিত্বের দ্যুতি দিয়ে পুরো দেশকে কেমন চমকাতেন৷ না, এ বড় লজ্জার কথা যে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মতো নির্বাচনে নেমে তাদের নিজেদের চেনাতে হয়৷ এবং আরও লজ্জা লাগে যখন দেখি মানেও তারা সেই পর্যায়ে নেমে গেছেন৷ সেভাবেই নির্বাচন জেতার চেষ্টা৷ তীব্র কাদা ছোঁড়াছুড়ি৷ বাংলা সিনেমা নষ্ট হয়েছে অশ্লীলতায়৷ অকথ্য সব সংলাপে মানুষ কানে হাত দিয়েছে৷ এবার নির্বাচন যেন সেরকম পচনেরই প্রতীকী ছবি৷ যেসব কারণে সিনেমা মানুষ থেকে দূরে গেছে সেগুলোর প্রদর্শনী দিয়ে তারা যেন ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন কেন বর্তমান সিনেমার প্রতি আর কোনো আকর্ষণ থাকা উচিত না৷ রাজনীতির নির্বাচনের মতো টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ উঠল৷ সেখানকার মতো নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা হয়তো নেই কিন্তু অশ্লীলতা ঠিকই আছে৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার, যিনি নিজেও একজন অভিনেতা, তিনি নাকি সাধারণ সম্পাদক নারী প্রার্থীর কাছে একটা চরম অশ্লীল দাবি করেছিলেন৷ পতনের মাত্রাটা ভাবা যায়! ধরা যাক, এই অভিযোগ সত্য নয়৷ কিন্তু সত্য যদি না হয় তবুও কথা শেষ হয় না৷ ঘায়েল করার জন্য একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছেন! আর সেটাই সিনেমার মানুষ বা সিনেমা শিল্পের প্রতি অনুরাগের বদলে রাগ তৈরির জন্য যথেষ্ট৷

দেখতে দেখতে আবছা হয়ে যাওয়া পুরানো দিন বেদনা নিয়ে ভেসে আসে৷ মনে পড়ে প্রথম সিনেমা দেখার স্মৃতিটা৷ কী উৎসব! খুব সম্ভব ছবির নাম ছিল গোলাপী এখন ট্রেনে৷ মফস্বলের সাদামাটা হল, কাঠের চেয়ার, মশা-টশাও ছিল, কিছুই গায়ে লাগেনি৷ অন্ধকার ঘরে যেন অন্য এক পৃথিবী৷ দৈনন্দিন জীবনের যত দুঃখ, যত অপ্রাপ্তি সব কিছু মুক্ত সেই পৃথিবীতে গিয়ে মিলত সত্যিকারের পৃথিবীর সঙ্গে লড়াইয়ের জ্বালানি৷ সেই দিনগুলো কোথায় গেল!

ভেবেছি অনেক৷ খালি আর খোলা চোখে সবাই বলবে, এখন আর সেই সব সিনেমা আছে নাকি! খুব সরলীকৃত বিশ্লেষণ মনে হয়৷ মাঝে মধ্যে টিভি স্যাটেলাইটে পুরনো সেসব ছবি দেখি৷ আবেগের অংশটুকু বাদ দিয়ে নির্ভেজাল বিচারে গেলে মানতে হবে কিছু ভালো ছবি ছিল কিন্তু এমন আহামরি কিছু নয় বেশিরভাগই৷ তাই সিনেমার মান কমে গেছে এটা একমাত্র কারণ নয়৷ যেমন এটাও কারণ নয় যে মানুষ টিভি-স্যাটেলাইট বা ওটিটিতে সব পেয়ে যাচ্ছে বলে আর হলে যেতে চায় না৷ তাই যদি হত, তাহলে তো অ্যামেরিকা-ইউরোপে সব হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা৷ ভারতে কেন আজও লাইন ধরে মানুষ সিনেমা দেখে৷ আকাশ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়াতে বাইরের মানসম্পন্ন সিনেমার সঙ্গে লড়তে হয় বলে অসম প্রতিযোগিতার কথা বলেন আরেক দল৷ এটা একটা যুক্তি৷ একমাত্র অবশ্যই নয়৷ তাহলে পৃথিবীতে হলিউড-বলিউড এরকম কয়েকটা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া সব শেষ হয়ে যেত৷ হয়নি৷

মাঝে মধ্যে মনে হয়, বাংলা সিনেমার সঙ্গে আমাদের ফুটবলের অবিশ্বাস্য মিল৷ দুটোরই সোনালী অতীত, অগোছালো বর্তমান আর অন্ধকার ভবিষ্যৎ৷ এবং দুটোর ক্ষেত্রেই আমাদের খণ্ডিত বোধ আর একপেশে বিশ্লেষণেরও দায় আছে৷ ফুটবলে যেমন আমরা ধরে নেই, পৃথিবীর উন্নত লিগ দেখার সুযোগের কারণেই দেশের ফুটবলের প্রতি এই নিরাসক্তি৷ কিন্তু একটু তলিয়ে দেখি না তা হলে পৃথিবীতে কয়েকটা লিগ ছাড়া আর সব দেশের ফুটবল শেষ হয়ে যেত৷ ওরাও মেসি-রোনালদোকে আমাদের মতো দেখে তবু দেশের ফুটবলে মেতে থাকে৷ ঠিক এমনই, পৃথিবীর সব দেশই কুরোসওয়া- কিয়ারোস্তামি-ফেলিনির ছবি দেখে, তবু নিজেদের সিনেমাকে ফেলনা মনে করে না৷ আসলে দুটো ক্ষেত্রেই, এই নিজেদের জিনিস মনে করার বোধটাই আমরা তৈরি করতে পারেনি৷ সুসময় যখন ছিল তখন অসময়ের কথা কারো মাথায় আসেনি৷ কেউ দূরটা দেখেননি, দূরের দিনের জন্য নিজেদের তৈরি করেননি৷ যখন স্যাটেলাইট প্রথম এল তখন মধ্যবিত্তকে হারিয়ে সিনেমা আশ্রয় খুঁজল শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের কাছে৷ আর তাদেরকে রুচিকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে তৈরি হল অশ্লীল সিনেমা৷ ওদিকে এদের পেছনে তেমন বিনিয়োগ দরকার নেই বলে হলের সুযোগ-সুবিধার কথাও ভাবা হল না৷ ফলে মধ্যবিত্তের সাময়িক মোহ কেটে হলে ফেরার যে সুযোগ ছিল সেটা নষ্ট হল৷ আমাদের যে সমাজ কাঠামো তাতে সাংস্কৃতিক কোনো প্রবাহে মধ্যবিত্ত যুক্ত না থাকলে তাকে ধরে রাখা যায় না৷ মানুষ বা দর্শকের ভোক্তা হয়ে ওঠা বাজারের সময়ের স্বাভাবিক প্রবণতা আর মধ্যবিত্ত দর্শকশ্রেণীকে হারানোয় আবেগের লাইনটা গেল কেটে৷ তাই এখন সিনেমা নিছক পণ্য, সেই পণ্যের জন্য চাই বড় বিনিযোগ৷ ভোক্তা নেই বলে বিনিয়োগ আসে না৷ আবার বিনিয়োগ সীমিত বলে মানসম্মত কাজ হয় না৷ সব মিলিয়ে এমনই দুর্বোধ্য আর দুর্ভেদ্য চক্র যে সিনেমা তাতে হাঁসফাঁস করে মরছে৷

মোস্তফা মামুন, নির্বাহী সম্পাদক, দেশ রূপান্তর
মোস্তফা মামুন, নির্বাহী সম্পাদক, দেশ রূপান্তরছবি: MIRFARID

আর এখানেই আবার দেখি চলচ্চিত্র শিল্পের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা৷ যে চ্যালেঞ্জে পড়েছে সঠিক বোধ আর দূরদর্শী ভাবনা দিয়ে সেখান থেকে বের করার জন্য দরকার মানসম্মত নেতৃত্ব৷ যারা সময় আর প্রয়োজনটা বুঝতেন৷ কেটে যাওয়া সুতাটাকে জোড়া দিতে পারতেন৷ কিন্তু সেই সুতা জোড়ার বদলে যে ফাঁক তৈরি হয়েছে সেই ফাঁকটাই ব্যবহৃত হচ্ছে নেতা হওয়ার সিঁড়ি হিসাবে৷ কাজ-কর্ম কমে গেছে বলে শিল্পীদের বড় একটা অংশ ভুগছেন আর্থিক অনিশ্চয়তায়, সামান্য কিছু সহায়তার সম্ভাবনা দেখিয়ে নেতা হয়ে গেছেন মোটা মাথার কিছু মানুষ৷ দুস্থ শিল্পীদের সাহায্য করা অবশ্যই একটা কাজ, মূল কাজ মোটেও নয়৷ প্রধান কাজ সিনেমাকে জাগানোর চেষ্টা করা, শিল্পের মান বাড়ানোর উদ্যোগ৷ তা হলে শিল্পীদের আর হাত পাতার জায়গায় খাকতে হবে না৷ সমস্যা হলো, জেঁকে বসা এসব নেতাদের আবার সুবিধা শিল্পীরা অসহায় আর শিল্পটা রুগ্ন থাকলেই৷ আর এজন্যই তাদের কাছে এই ভোটটাকে ইউনিয়ন পর্যায়ের ভোট আর শিল্পীদের শিল্পসত্তা ভুলিয়ে ভোটার করে রাখতে পারলেই সুবিধা৷ সেই চর্চা চলে বলেই নির্বাচনটা এমন গ্রাম্য লড়াইয়ে পৌঁছায়৷ অভিনেতারা সব নামেন পাতি নেতা হওয়ার দৌড়ে৷

এক সহকর্মীকে দেখলাম, নির্বাচন নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজিত৷ বারবার খোঁজ নিচেছন, ‘কী বললে নিপুণ এই বলেছে...৷' ‘আচ্ছা, জায়েদ খান জবাব দেবে কখন?'

মনে হল, বাংলা সিনেমা নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহী মানুষ৷ তার সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলা যায় সিনেমার ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে৷

তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি বাংলা সিনেমার ভক্ত কে বলল?'

‘এই যে এমন উত্তেজনা দেখাচ্ছেন৷'

‘আরে এই সময়ই তো যা মজা৷ সবাইকে একসঙ্গে দেখা যায়৷ সিনেমার মতোই ডায়লগ, হুংকার...৷ আগে পর্দায় যা দেখতাম, এখন বাস্তবে দেখি৷'

‘নতুন সভাপতি হলেন, নিশ্চয়ই একটা বদল আশা করা যায়৷ সিনেমার প্রতি মনযোগ হয়তো বাড়বে৷'

‘আমার ভাই ওসবে কোনো আগ্রহ নেই৷ এক বছর পর আবার আরেকটা সিনেমা হবে৷ যাই বলো, এরা সারা বছরের বিনোদনের অভাব এক নির্বাচন দিয়ে পুষিয়ে দেয়৷'

ভাবলাম৷ ভেবে আরও দ্বিধান্বিত হযে গেলাম৷ আমরা সারা বছর তাদের ভুলে থাকি বলেই তারা নির্বাচনের সময় নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে এমন মরিয়া হয়ে হাজির হন নাকি তারা শুধু নির্বাচন আর নেতৃত্ব নিয়ে মেতে থাকেন বলে বাকি বছর আসল কাজ, মানে সিনেমা-অভিনয় দিয়ে আমাদের টানার সময় করে উঠতে পারেন না!